বিশুদ্ধ পানি কি বিশুদ্ধ

আমরা প্রতিদিন যে পানি পান করছি, তা আসলে কতটুকু বিশুদ্ধ? সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। ঢাকায় ব্যবহূত জারের পানিতে পাওয়া গেছে কলিফর্ম আর ফেকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া।

কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মূলত ই.কলি (E.coli) ব্যাকটেরিয়া। পানিচক্রের যেকোনো অবস্থানেই এরা পানির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে ফেকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া শুধু বিশেষ স্থানেই পাওয়া যায়। বিশেষ স্থানটি হলো মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর অন্ত্র। মলত্যাগের মাধ্যমে এটি পরিবেশে উন্মুক্ত হয়। পেটব্যথা, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, বমিভাব, জ্বর-ঠান্ডার মতো রোগগুলোর জন্য দায়ী এই ব্যাকটেরিয়া। তাই জারের পানিতে এসব ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক বটে। জারের পানি থেকে রক্ষা পেতে যদি বোতলজাত পানির দিকে এগোনো যায়, তবু বিপদ। কারণ বোতলজাত পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার মতো কোনো দূষিত পদার্থ আছে কি না, তা জানার কোনো উপায় নেই। বোতলজাত পানির খনিজ উপাদানের মাত্রা আদর্শ মাত্রা থেকে বিচ্যুত।

তাহলে বাসায় বসে ফুটিয়ে পানি পান করাই কি নিরাপদ? সেই পানি কি বিশুদ্ধ হবে? না, তা খাওয়ার উপযোগী হলেও পুরোপুরি বিশুদ্ধ হবে না। তাহলে আদৌ কি বিশুদ্ধ পানি বাস্তবে পাওয়া যায়?

‘না, যায় না!’ বলেছেন অরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মে নাইম্যান। রসায়নের এই অধ্যাপক লাইভ সায়েন্সকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, পুরোপুরি বিশুদ্ধ পানি বলে আসলে কিছু নেই। অন্তত পৃথিবীতে এই ধরনের কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। তার মানে কিন্তু এই নয় যে জারের পানিতে কলিফর্ম দূর করা যায় না কিংবা বোতলজাত পানির উপাদানের মাত্রা আদর্শ মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা সম্ভব নয়! খাওয়ার উপযোগী পানি উত্পাদন করা সম্ভব হলেও একদম ভেজালমুক্ত বিশুদ্ধ পানি উত্পাদন করা সম্ভব নয়।

পানি বিশুদ্ধকরণ কোম্পানিগুলো পৃথিবীজুড়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবসা করছে। তারা চেষ্টা করছে পানি থেকে সবকিছু ছেঁকে নিয়ে শুধু H2O উত্পাদন করতে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা একটা নির্দিষ্ট সীমার পরে আর সম্ভব নয়। পানি তার চারপাশ থেকে খুব দ্রুত আয়ন টেনে নেয়। এই অত্যধিক আয়ন আসক্তির জন্য বিশুদ্ধ পানি পাওয়া অসম্ভব। পানির অণু দেখতে অনেকটা মিকি মাউসের মাথার মতো। অক্সিজেন পরমাণুটি হলো মিকি মাউসের মুখ আর কান দুটো হলো দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু। পরমাণুগুলো একত্রে বন্ধন গঠন করে চার্জের আকর্ষণের কারণে। কিন্তু এই আকর্ষণে শুধু তারা নিজেরাই বাধা পড়ে না, অন্য কোনো অণু কাছে এলে তাদেরও আকর্ষণ করে।

এই কারণে একটা পাত্রে পানি রাখা মাত্রই সে পাত্র থেকে কিছু আয়ন পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। যত বিশুদ্ধ পানি তৈরির চেষ্টা করা হয়, এই আকর্ষণের মাত্রা তত বেড়ে যায়। অধ্যাপক নাইম্যান বলেন, পানির আয়ন আসক্তি আছে, তাই এটি গ্লাসের বাইরের স্তর থেকে আয়ন টেনে নিয়ে গ্লাসকে ধীরে ধীরে দ্রবীভূত করে ফেলতে পারে।

অধ্যাপক মে নাইম্যানের মতে, এই আসক্তি এতটাই শক্তিশালী, তা পুরোপুরি উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা বিজ্ঞানীদের নেই। খুব কম পরিস্থিতিতেই বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন পড়ে। যেকোনো গবেষণাগারেই পানি পাতিত করে মোটামুটি বিশুদ্ধ পানি তৈরি করা যায়। এই পানিতে যে অতি অল্প ভেজাল থাকে, কোনো কিছুতেই তার প্রভাব বোঝা যায় না। এই পানি দিয়েই সব কাজ করা যায়। কিন্তু তাই বলে পুরোপুরি বিশুদ্ধ পানি? না, তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ডটকম

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত