বিশ্বের নিয়ম, নিয়মের বিশ্ব

চারদিকে আমরা কী দেখি! মানুষ গাছ মাটি ইট পাথর পানি—এগুলোই দেখি। একটু গোছানো দৃষ্টিতে দেখতে গেলে আমরা দেখি প্রাণী, উদ্ভিদ, আর জড়বস্তু। আর যদি পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে আমরা আসলে দেখি পদার্থ আর শক্তি। মাটি পানি গাছ—এগুলো পদার্থ। আর শব্দ আলো তাপ—এগুলো শক্তি। এবার আমাদের দৃষ্টিটা পৃথিবীর বাইরে নিয়ে গেলে আরো অনেক কিছুই দেখতে পাওয়ার কথা। যেমন দিনের আকাশে আমরা দেখতে পাই সূর্য, আর রাতের আকাশে দেখতে পাই চাঁদসহ অনেক তারা। কয়েকটি বাদে তারারা আসলে সূর্যের মতো নক্ষত্র। কিন্তু ভাবনার দৃষ্টিতে দেখলে আবার সেই পদার্থ আর শক্তি!

ভাবনার গভীরতাটা একটু বাড়িয়ে দিলে আরো একটা কিছু ধরা পড়ে, সেটা হল নিয়ম। প্রকৃতিতে অনেক ধরণের নিয়ম আছে। আমাদের চারপাশের সাধারণ একটি নিয়ম হল পানি উপর থেকে নিচে পড়ে, যা আসলে প্রকৃতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি সব সময়ই সবচে কম শক্তিতে থাকতে পছন্দ করে। এরকম অনেক অনেক নিয়ম প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে। এগুলো নিয়ে ভাবতে গেলে অনেক আনন্দ লাগে। আর ভাবতে গেলেই অনেক অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়। প্রকৃতিতে যেহেতু শুধু পদার্থ আর শক্তি, পদার্থ শক্তির অনুপাত কত, কেন এই অনুপাতে আছে, কিংবা সব পদার্থ শক্তি হলে কি হত, সব শক্তি পদার্থ হল কি হত—এগুলো ভাবতে গেলে বেশ ভালো লাগে।

এখন নিয়মের একটু গভীরতায় যাওয়ার চেষ্টা করায় যাক। এজন্য কয়েকটি উদাহরণ আলোচনা করতে পারি। প্রতিটি গাছেরই কিছু নিয়ম আছে। জন্মের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে ফল ধরতে, বছরের নির্দিষ্ট সময়েই ফল ধরে—ইত্যাদি। এর বাইরেও গাছের মাঝে আরো অনেক নিয়ম আছে। যেমন গাছের কিছু অংশ বাকল, কিছু হল শক্ত কাঠ, কিছু পাতা, ফল, ফুল-পাতা, ফুল-ফল এদের ভেতরও অনেক ধরণের ভাগযোগ আছে। অথচ গাছের ভেতর কিন্তু সবই কোষ, একেকটা একেক ধরনের কোষ। কে কখন কোন ধরনের কোষ হবে, এই নিয়মটা গাছের ভেতর কোথাও না কোথাও লেখা আছে। সেটাই ডিএনএ। ঠিক একইভাবে মানুষের শরীরেও শুধু নিয়ম আর নিয়ম। মানুষের জন্মের শুরু থেকেই কখন কোন কোষ কীভাবে তৈরি হবে, এদের কে কোন ধরনের কাজ করবে—শুধু কি তাই, এদের ব্যবহার কখন কেমন হবে—মোট কথা মানুষের শরীরেও শুধু নিয়ম আর নিয়ম।

এখন সোজা চলে আসি পরমাণুর ক্ষেত্রে। প্রতিটি পরমাণুতেই ইলেকট্রন, প্রোটন, আর নিউট্রন আছে। প্রোটন আর নিউট্রন একত্রে পরমাণুর ছোট্ট একটি জায়গায় থাকে, যাকে নিউক্লিয়াস বলে (হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে শুধু প্রোটন থাকে)। আর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াস থেকে অনেক দূরে থাকে। নিউক্লিয়াসের সঙ্গে এক ধরণের নিয়মে ইলেকট্রন বাঁধা আছে। আবার নিউক্লিয়াসের ভেতরে ভিন্ন নিয়মে প্রোটন আর নিউট্রন বাঁধা পড়ে আছে। এখন প্রশ্ন হল, কোন নিয়মের কারণে সবগুলো পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণু নয়! পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে প্রায় ১১৮ ধরনের পরমাণুর জন্মের কথা শোনা যায়। আবার প্রতিটি পরমাণুরই বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে (বিশেষ পরমাণু সিরিজের কথা ভিন্ন)। কোন একটি বিশেষ নিয়মে যেমন ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর জন্ম হচ্ছে, তেমনি কোন একটি বিশেষ নিয়মে একেকটি পরমাণুর একেক রকম ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এই পরমাণুগুলো যখন অণু তৈরি করে, তখন আবার অন্য নিয়ম। যেমন আমাদের চারদিকে তাকালে দেখি, সব কিছুই দেখতে একইরকম না। মাটির দিকে তাকালে দেখি সব মাটি একরকম না। ভিন্ন ভিন্ন মাটি আছে, এর মাঝে ছোট বড় পাথর আছে। আমাদের চারিদিকে বাতাস আছে, পানি আছে—কেন এই ভিন্নতা, এর পেছনেও নিয়ম আছে। এর ওপর আছে প্রাণ, সেখানে আরো জটিল এবং অদ্ভুত সব নিয়ম। পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে হাজার কোটি নিয়মের মধ্যে কয়েকটি নিয়ম বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে, এই নিয়মটিই কোথাও না কোথাও লেখা আছে।

মহাবিশ্বের দিকে তাকালেও সেই নিয়মের আধিপত্য। একটি বিশেষ নিয়মে উপগ্রহ ঘুরছে গ্রহের চারদিকে, গ্রহ ঘুরছে নক্ষত্রের চারদিকে, আর নক্ষত্র ঘুরছে নীহারিকার চারদিকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোন নিয়মে এই গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকার জন্ম হল! গ্রহ নক্ষত্র না হয়ে, সমস্ত পদার্থ এবং শক্তি সুষমভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকলে কি সমস্যা হত! এর চেয়েও মজার প্রশ্ন হল, কখন কোন নিয়ম কাজ করবে, এরও একটি নিয়ম আছে! একটি সহজ এবং সুন্দর ভাবনা হল এই নিয়মগুলো বিশ্বজগতে কীভাবে আছে!

এখন চলে যাই প্রাণের কাছে। আমরা মানুষ এবং আমাদের প্রাণ আছে। আমরা হাঁটতে চলতে পারি। উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। জড়ের কি প্রাণ নেই? জড় জগতে যদি প্রাণ না থাকে, তাহলে ওরা কীভাবে পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসে। পরমাণুগুলো কীভাবে একটি আরেকটির কাছে এসে অণু নামক পরিবার গড়ে তুলে। আর পরমাণু, ওর নিজের কি প্রাণ নেই! ও তো সারাক্ষণই চলছে-ফিরছে, নয়ত বসে বসে নড়াচড়া করছে, ওর ভেতরের ইলেকট্রন ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর প্রাণ নেই এ কথা কীভাবে বলি! প্রতিটি পরমাণুই বিশেষ ধরনের ফোটন খেতে পারে, এবং ফোটন খেয়ে ওর কলেবরও বৃদ্ধি পায়, হয়ত খুশি হলে একটি ফোটন ছেড়েও দেয়। শুধু কি তাই, পরমাণুর সঙ্গে অন্য পরমাণুর সম্পর্কের ভিন্নতা আছে, নিজেদের সঙ্গে একরকম আচরণ করে আবার অন্যদের সঙ্গে অন্যরকম আচরণ করতে পারে। পরমাণুর এই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই প্রতিটি পরমাণু হয়ত বিশ্বজগতের সঙ্গে জড়িত। যদি বিশ্ব জগতের সঙ্গে যোগ রাখাকেই প্রাণ বলতে পারি, তাহলে অবশ্যই পরমাণুর প্রাণ আছে। তেমনি আছে অণুর প্রাণ। এই সংজ্ঞাতে জড় জগত বলে যাকে জানি, তারও প্রাণ আছে। উদ্ভিদ আর প্রাণের জগতের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।

জীবিত আর মৃতের চিন্তা থেকে বলতে উদ্ভিদ আর প্রাণীর প্রাণ আছে। পরমাণুর জীবন-মৃত্যু একটু কঠিন হয়ে যায়, অবশ্যই একটি পরমাণুকে কোন না কোন ভাবে, যতই জটিল হোক না কেন, অন্য পরমাণুতে রূপান্তর করা যায়, পুরো পরমাণুকে শক্তিতেও রূপান্তর করা যেতে পারে। সেখানে জীবন মৃত্যু একটু অন্যরকম বটে। উদ্ভিদ আর প্রাণের প্রাণ আছে, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে প্রাণের লক্ষ্মণগুলো চলে যায়, যাঁকে আমরা মৃত্যু বলে জানি। একটি প্রাণী বা উদ্ভিদে কীভাবে প্রাণের উদ্ভব হয়, নিশ্চয়ই এরও একটি নিয়ম আছে। যে নিয়মটি খুবই সূক্ষ্ম ভাবে একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীর ভেতরে রাখা হয়েছে।

বিজ্ঞানের কাজ হল গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃতি জগতের নিয়মগুলো ধরে ফেলা, এবং এই নিয়মগুলো মানব বা প্রকৃতির কল্যাণে ব্যবহার করা। ইতিমধ্যেই প্রকৃতি জগতের অনেক ধরনের নিয়ম পুরোপুরি জানা হয়ে গেছে। যেমন নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র এবং অভিকর্ষজ বলের সুত্র জানা হয়েছে বলেই মানুষ পৃথিবীর চারিদিকে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাতে পারছে, সঙ্গে অবশ্যই আরো কিছু নিয়মের প্রয়োগ করা হয়েছে। অনেক নিয়ম জানা হয়ে থাকলেও এখনও অজানার মাঝে আরো অনেক অনেক কিছুই রয়ে গেছে।

যেদিন মানুষ উদ্ভিদের ভেতরের সমস্ত নিয়ম কানুন বুঝে ফেলবে এবং উদ্ভিদের বোঝার মতো করে লিখে ফেলতে পারবে, তখন আমাদের সামাজিক জীবনে উদ্ভিদ অন্য রকম হয়ে যাবে। হয়ত একটি গাছেই সব ধরনের ফল পরিমিত পরিমাণে ধরবে। গাছের ভেতর নতুন নিয়মের কারণে ফল গাছের কাণ্ড কিছুই বাড়বে না, শুধু পরিমিত পরিমাণ ফল, আর সেই ফলের পুষ্টি যোগাতে পরিমিত পরিমাণ শিকড় আর পাতা। এরকম একটি গাছ সবার আঙিনায় বা বারান্দায় থাকবে এবং একটি পরিবারকে বছরব্যাপী ফল জুগিয়ে যাবে। আবার কাঠের জন্য গাছে অন্য রকমের নিয়ম নতুন করে লেখা থাকবে, সেখানে কাঠের কোষ অন্য কোষের চেয়ে অনেক বেশি হারে তৈরি হবে। ফুল গাছের জন্যে অন্য রকম নিয়ম লিখতে হবে, পছন্দের উপর নির্ভর করে একজন মানুষ একটি ফুল গাছেই অনেক রকম ফুল পেতে পারবে। হয়ত অচিরেই এই নিয়ম আবিষ্কার এবং সূক্ষ্মভাবে এই নিয়মের প্রয়োগ হয়ে উঠবে এক চমৎকার বিজ্ঞানের যুগ, ঠিক কম্পিউটার কোডিংয়ের মতো! প্রতিটি গাছের কোড বুঝে নেয়ার পর, ওর কোডটা একজন মানুষের পছন্দ মতো বদলে দেয়া।

ঠিক একইভাবে প্রাণের কোড বুঝে ফেললে প্রাণের অনেক ধারণাই ইচ্ছে মতো বদলে দেয়া যাবে। হয়ত বাঘ ঠিকই মাংসাশী আছে, কিন্তু কোডের মাধ্যমে ওকে মানুষের একান্ত বাধ্যগত একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। দেখা যাবে, বিপন্ন প্রাণীগুলো মানুষের বন্ধু হিসেবে ঘরে বাইরে ঘুরে বেরাচ্ছে। তবে প্রাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোডিং ভয়ানকও হতে পারে। কোডিং এর মাধ্যমে একটি নিরীহ বা হিংস্র প্রাণীকে আরো বেশি হিংস্র করে তোলার আশঙ্কাও রয়েছে।

মানুষের ক্ষেত্রে নিয়মটা বুঝে ফেললে, কোডিংয়েরে মাধ্যমে অনেক কিছুই করা যাবে। এই কোডিংয়ের মাধ্যমে নিজেকে সুন্দর আর সুঠাম গড়নের অধিকারী হতে পারবে। প্রয়োজনে আবার বদলেও ফেলতে পারবে। চিকিৎসার জন্যে আর ওষুধ খেতে হবে না। শরীরের ভেতরের কোডিং দিয়েই সব রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব, নিয়ম ঠিক করে দেবে অসুখের সময় কোন কোষ কী রকম আচরণ করবে, এই করেই যে কারণে অসুখ, সেটা দূর করে দেবে। শুধু কি তাই, মানুষ কোন পরিস্থিতিতে কেমন ব্যবহার করবে, তাও আগে থেকেই বলে দেয়া যাবে। বিজ্ঞানের এসব অগ্রগতি যেমন আশা জাগায় তেমনি ভয়ও চলে আসে। নিয়ন্ত্রণহীন এসব কোডিংয়ের কারণে মানুষসহ পৃথিবীর পুরো প্রকৃতি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে পারে নিমেষে।

তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিয়ম নিয়ে এই কোডিং জানা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ একবারেই কল্প কাহিনির আওতায় পড়ে। এর বাস্তব প্রয়োগের জন্যে শত শত বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে, এবং এর জন্যে দরকার বিজ্ঞানের জগতে চরম উৎকর্ষতা!

উল্লেখিত কোডিং কি খুব বেশি কাল্পনিক লাগছে! ইতিমধ্যেই উদ্ভিদে এই কোডিং—এর প্রয়োগ চলছে। উচ্চ ফলনশীল ফসল, যেগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, বীজহীন ফল—ইত্যাদি তো কোডিং প্রয়োগেরই সফলতা। এখন আসি সমুদ্রের ঘূর্ণিঝড়ের কথায়। একটি ঘূর্ণিঝড়ের জন্মের পর থেকেই এর গতিপথ টিভিতে দেখানো হয়ে থাকে। যা কয়েকদিন পর মোটামুটি বাস্তবের সঙ্গে মিলেও যায়। এর পেছনে আছে কোডিং। কোডিংয়ের ভেতর প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়। এতে করেই দিনে দিনে ঘূর্ণিঝড়ের পথ অনেকটাই নির্দিষ্ট ভাবে বলে দেয়া যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের জন্মের নিয়মটা জানতে পারলে একদিন হয়ত আগে ভাগেই বলে দেয়া যাবে কবে কোথায় ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম হবে। এমনকি ইচ্ছে মতো হয়ত ঘূর্ণিঝড়ের জন্মও দেয়া যাবে। হয়ত কাঁচের বোতলে ধরে রাখা অল্প বাতাসেই থাকবে সেই নিয়ম। উপযুক্ত পরিবেশে বোতলটা খুলে ধরলেই ভেতরের বাতাস ধাই ধাই করে বেড়ে হয়ে যাবে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। অন্যদিকে ভালো একটি পরিবেশ না পেলে, অল্পতেই মরে যাবে সেই ঘূর্ণিঝড়। কোডিং এর মাধ্যমে অবশ্য আগেই হয়ত জানা হয়ে যাবে কোন পরিবেশ এই ঘূর্ণিঝড়ের জন্য উপযুক্ত।

এখন আসি সুন্দর একটি নিয়মে। বিজ্ঞানে বহুল প্রচলিত একটি চিন্তা এবং বাস্তবতা হল কার্যকারণ। পদ্মা নদীতে পানি বেশি দেখলে আমরা বুঝতে পারি ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়া হয়েছে। শরীরে জ্বর হলে বুঝি কোন একটা রোগের সঙ্গে শরীর যুদ্ধ করছে। এ দুটো উদাহরণই কার্যকারণের উদাহরণ! এর বাইরেও মহাবিশ্বে অন্য একটি যোগাযোগ থাকার কথা, পুরো মহাবিশ্বই কোন না কোন ভাবে একত্রে জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর একটি পরমাণুর সঙ্গে মহাবিশ্বের দূর নক্ষত্রেরও একটি যোগ থাকতে পারে, এই পৃথিবীর পরমাণুর কোন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই দূর নক্ষত্রেও একটি পরিবর্তন ঘটবে, যা আলোর বেগের মাধ্যমে ব্যাখা করা যাবে না, অর্থাৎ এই যোগাযোগ কার্যকারণের বাইরে। এই নিয়মটা যদি বিজ্ঞান কখনো পুরোপুরি ধরতে পারে, তাহলে মহাবিশ্বের খবরাখবর জানার জন্যে আর টেলিস্কোপ বসাতে হবে না। পৃথিবীর অবস্থা ভালো করে বুঝতে পারলেই মহাবিশ্বের সমস্ত খবরাখবর জানা হয়ে যাবে। মহাবিশ্বকে একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করলে এই কথার অর্থ দাঁড়ায় এরকম, শরীরের যে কোন একটি কোষের অবস্থা বুঝেই বলে দেয়া যাবে পুরো শরীরের কোথায় কী অবস্থা বিরাজ করছে। এর আরও একটি উদাহরণ হতে পারে সূর্যের একটি বিশেষ ফোটনের সঙ্গে আমাদের পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট গাছের একটি নির্দিষ্ট পাতার যোগ। পাতায় নির্দিষ্ট ফোটনের দরকার আছে বলেই যেন সূর্যে সেই ফোটনের জন্ম, কার্যকারণের আগেই পাতা এবং ফোটন একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত।

প্রকৃতির একটির সঙ্গে অন্যটির ওতপ্রোতভাবে এই জড়িয়ে থাকার নিয়মটিই হয়ত সবচেয়ে কঠিন এবং দুর্বোধ্য! এই নিয়মটি বুঝতে পারলে আমরা হয়ত শুধু বর্তমান মহাবিশ্বের অবস্থা জানতে পারব তাই নয়, বরং আমরা হয়ত মহাবিশ্বের পুরো ইতিহাসও জানতে পারব। মানুষের শরীর দিয়ে উদাহরণ টানলে, একই কোষ বুঝেই বলে দেয়া যাবে জন্মের পর থেকে একটি মানুষের পুরো ইতিহাস, কি জৈবিক, কি মানবিক, কি সামাজিক—সমস্ত কিছু।

কার্যকারণ এবং মহাবিশ্বের একটির সঙ্গে অন্যটির ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার নিয়ম দুটো ভালোভাবে বুঝে প্রয়োগ করতে পারলে সময়কে আর গতিশীল মনে হবে না। বর্তমানে বসে অতীত যেমন হাতে থাকবে, তেমনি ভবিষ্যতও হাতে চলে আসবে। অর্থাৎ, বর্তমানে বসেই দেখতে পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে কী হবে, না হবে। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে এই কথাটা বুঝতে একটু সহজ হবে, ঘূর্ণিঝড়ের মডেল পুরোপুরি সঠিক হলে ওটা কম্পিউটারে সিমুলেশন করে ওর গতিপথ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুই আগে থেকে জানা যাবে। যার অর্থ দাঁড়ায় বর্তমানে বসে ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ করা। এখন যেমন বর্তমানে বসে আমরা অতীত পর্যবেক্ষণ করে থাকি, দূর নক্ষত্রের আলো থেকে নক্ষত্র সম্পর্কে যে তথ্য পাই, তা সুদূর অতীতের, কতটা অতীত তা নির্ভর করে পৃথিবী থেকে নক্ষত্রের দূরত্বের উপর।

একইভাবে নতুন বিশ্বজগতও তৈরি করা সম্ভব, এর জন্যে আর কিছুই না, বিশ্বজগত তৈরি করার নিয়মটা বুঝে সেভাবে কোডিং করলেই হবে। এই নিয়মের মাঝেই থাকবে আরো হাজার হাজার অন্য নিয়ম, সেই বিশ্বজগৎ কীভাবে চলবে, কি থাকবে, কি থাকবে না, শক্তি কতটুকু, পদার্থ কতটুকু—এসব নিয়মের জন্মও হবে শুরুর নিয়ম থেকে। এসব নিয়মকানুন পুরোপুরি জানা হয়ে গেলে, এবং ঠিকভাবে কোডিং করতে পারলে একদিন হয়ত প্রতিটি মানুষেরই একটি নিজস্ব মহাবিশ্ব থাকবে, যেখানে থাকবে মানুষের নিজের পছন্দ মতো প্রাণ এবং পরিবেশ, দুঃখ বেদনার নিয়মটা পালটে ফেলে সে থাকবে চিরসুখী, আর চিন্তায় বিশুদ্ধতা টেনে আনার নিয়মটা ঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে অমরত্বটাও আর অসহনীয় থাকবে না। তবে এখন আমাদের বিশ্বজগত একটা হলেও, প্রতিটি মানুষের চিন্তা জগত কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা, হাতের আঙ্গুলের ছাপের চেয়েও অনেক বেশি স্বতন্ত্র মানুষের এই চিন্তা জগত। কম্পিউটার টেকনোলজির নতুন মাত্রায় পৌঁছে যাওয়ার পর দূর ভবিষ্যতে কোন একদিন নিয়ম বুঝে মানুষ হয়তে শুরু করবে নিয়ম ভাঙা গড়ার খেলা। হয়ত এতে করেই মানবজাতির সঙ্গে পুরো বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে, অথবা নতুন বিশ্ব জগতের জন্মের সঙ্গে মানুষ পেয়ে যাবে আনন্দময় অমরত্বের সন্ধান!

কিন্তু এর আগে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, আর তা হলে প্রকৃতি কি মানুষকে এতদূর যেতে দেবে। কারণ মানুষ হল প্রকৃতির খুব সামান্য একটি অংশ। কোন বিশেষ কারণে প্রকৃতিই হয়ত মানুষের কাছে একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে দেবে না, সেক্ষেত্রে প্রকৃতি ধ্বংসের একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে। প্রাণের জন্মের নিয়ম, অমরত্ব, আর বিশ্বজগৎ তৈরির নিয়মটা হয়ত প্রকৃতির নিজের সুরক্ষার জন্যেই মানুষ থেকে সব সময় গোপন রাখবে, অথবা মানুষের জানার আগেই মানুষকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে।

সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়