বিষ থেকে আশীর্বাদ

উনিশ শতকের ইউরোপে এক আতঙ্কের নাম আর্সেনিক। হোক দরজি কিংবা রাজ্যের সেনাপতি, আর্সেনিক বিষ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কেউ। ফরাসিদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে মারা হলো আর্সেনিক বিষ দিয়ে। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে একের পর এক মানুষ মারা হলো আর্সেনিক দিয়ে। ম্যারি আন কটন নামের ব্রিটিশ মহিলা আর্সেনিক বিষ দিয়ে হত্যা করলেন ২০ জন মানুষ। একপর্যায়ে ম্যারি আন অভিযুক্ত হলে ১৮৭৩ সালে তাঁর ফাঁসি হয়। সারা ইউরোপের সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল তার সেই দণ্ডের খবর। ওই ঘটনার পর আর্সেনিক বিষ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ইউরোপ।

পল আলিখ
সংগৃহীত

আর্সেনিক যখন ইউরোপে এক রূপকথার রাক্ষস, তখন জার্মানির বিজ্ঞানী পল আলিখ (Paul Ehrlich) সে বিষে খুঁজতে থাকেন আশীর্বাদ। পল আলিখ বিজ্ঞানে নায়ক হতেই এসেছেন। তাঁর লক্ষ্য সিফিলিস রোগের ওষুধ উদ্ভাবন। সিফিলিস তখন ইউরোপ-আমেরিকায় লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সিফিলিস নিয়ে প্রচার হচ্ছে খবরের কাগজে। পোস্টারে পোস্টারে সে রোগের বিষয়ে সচেতনতা। চিত্রশিল্পীরা আঁকলেন সিফিলিসের বীভত্সতা। শিল্পীরা গাইলেন সচেতনতার গান। আলিখ বুঝলেন, ওঠেপড়ে লাগলেন সিফিলিসের ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে।

জার্মান রসায়নবিদেরা ইতিমধ্যে আর্সেনিকের প্রচুর যৌগ তৈরি করেছেন। আলিখ তাঁর ল্যাবরেটরিতে সেসব যৌগ সংগ্রহ করলেন। আর্সেনিকের সব যৌগ মানুষের জন্য সমান বিষাক্ত নয়। আলিখ এমন আর্সেনিক যৌগ তৈরির কথা ভাবলেন, যেটি মানুষের জন্য সিফিলিস রোগের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করবে! তাঁর ল্যাবে সে সময় সুদূর জাপানি মেধাবী ছাত্র গবেষণা করতেন। সাহাচিরো হাতা (Sahachiro Hata)। তিনি জার্মান ভাষা জানতেন না। আলিখের সঙ্গে তাঁর কথা হতো কম। যোগাযোগ ইশারায়। সেই মেধাবী সাহাচিরো দিনরাত খাটতে লাগলেন। কয়েক শ আর্সেনিক যৌগ দেওয়া হলো সাহাচিরোকে। বলা হলো, খুবই ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিটি যৌগ টেস্ট করতে হবে। পরীক্ষা করা হবে খরগোশের ওপর। খরগোশদের সিফিলিস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত করা হতো। একটি একটি যৌগ, প্রতিটি খরগোশের ওপর প্রয়োগের পর পর্যবেক্ষণ করে নোট করা হতো। সাহাচিরো কয়েক শ যৌগ পরীক্ষা করলেন। তাঁর নোটবুক শেষ হয়ে যায়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত যৌগ আর পাওয়া যায় না। সেই যৌগ খুঁজে বের করতে হবে, যেটি দিয়ে খরগোশ মরবে না, তবে সিফিলিসের ব্যাকটেরিয়া নাশ হয়ে যাবে। সাহাচিরোর জগতে হতাশার মেঘ। তবু মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ, ক্লান্তির নাম বিনাশ! কিছু খরগোশ মারা গেল। কিছু খরগোশ শরীরে সিফিলিস ব্যাকটেরিয়া নিয়েই বেঁচে রইল। একদিন পাওয়া গেল সেই কাঙ্ক্ষিত খরগোশ। সেটি বেঁচে রইল কিন্তু এর শরীরের সিফিলিস ব্যাকটেরিয়াও নেই হয়ে গেছে। সে খরগোশের শরীরে যে যৌগটি প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেটি দিয়ে আরও কয়েকটা খরগোশের ওপর পরীক্ষা চালানো হলো। একই ফল পাওয়া গেল সব কটি পরীক্ষায়। পল আলিখের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো সে ফলাফল। আর্সেনিকের যে যৌগটি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করল, কিন্তু খরগোশকে বাঁচিয়ে রাখল, সেটি ছিল তাঁর তৈরি করা ৬০৬ নম্বর যৌগ। সে যৌগের নাম দেওয়া হলো স্যালভারসেন-৬০৬। ১৯০৯ সালের শরত্কাল তখন।

আলিখের জগৎ অসম্ভব রোমাঞ্চকর! মাত্র এক বছরের মাথায় যৌগটি মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হলো। স্যালভারসেন দিয়ে নিরাময় করা গেল সিফিলিস। সিফিলিস রোগ সেরে যাচ্ছে, মানুষ তাতে বিস্মিত! দুনিয়ার খবরের কাগজগুলো মেতে উঠল আলিখের সেই আবিষ্কারের খবরে। স্যালভারসেন আবিষ্কারের আগেই আলিখ চিকিত্সাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন। কিন্তু সে নোবেল মুকুট তাঁকে যতটা না পরিচিত করেছিল, তার চেয়ে বহুগুণ পরিচিত করল স্যালভারসেন ওষুধ। সভ্যতা দেখল, মূর্খরা যখন বিষ দিয়ে মানুষ মারে, জ্ঞানী তখন সেটি দিয়ে প্রাণ বাঁচায়। অন্যদিকে সাহাচিরো তিনবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাননি। সারা দুনিয়া তাঁকে ভুলে গেলেও জাপান ভোলেনি। সে দেশের ছেলেমেয়েরা আজও সাহাচিরোর কথা পড়ে পাঠ্যবইয়ে।

রসায়নিক গঠন

স্যালভারসেন যৌগের রাসায়নিক নাম আর্সফেনামিন (অত্ংঢ়যবহধসরহব)। রসায়নে এসব যৌগকে বলা হয় ধাতব-জৈব যৌগ। এই যৌগ যদিও রোগ নিরাময়ে বহু বছর ধরে ব্যবহূত হয়েছে, তবে এর সঠিক রাসায়নিক গঠন জানা ছিল না। পল আলিখ সে সময়ে যে গঠন প্রস্তাব করেছেন, প্রায় শতবর্ষ পর এসে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, স্যালভারসেন হলো ট্রাইমার ও পেন্টামারের সমন্বিত যৌগ।

লেখক : গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: Angew. Chem. Int. Ed.2005, 44, 941~944)