মাতৃভাষা কীভাবে বুদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি বাড়ায়

বাংলাদেশের অর্থনীতি অভাবনীয় সাফল্য লাভ করছে। গড় প্রবৃদ্ধির হার কম–বেশি ৭ শতাংশ। আশা করছি এটা আগামী বছর ৮ হবে। বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদ বলছেন, ‘ম্যাজিক অর্থনীতি’। কারণ ২০০৭–০৮ সাল থেকে কয়েক বছর যখন আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে মন্দা চলছিল, তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছিল। আজও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

এর অনেক কারণ আছে। তবে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনও যে একটি কারণ, সেটা হয়তো আমরা অনেকে জানি না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো দেশে শুধু মাতৃভাষা সুন্দরভাবে পড়তে পারে এমন শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ে।

যেমন দ্বিতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী যদি মিনিটে অন্তত ৪০টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেই শিশু পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ইংরেজি ভাষা পাঠে এই মানদণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে অনুসরণ করা হয়। বাংলার ক্ষেত্রে যদিও সে রকম কোনো গৃহীত মানদণ্ড নেই, আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আপাতত ব্যবহার করতে পারি। মিনিটে ৪০টি শব্দ মানে দেড় সেকেন্ডে একটি শব্দ। এটা খুবই সম্ভব।

আর পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী অর্থ বুঝে মিনিটে ৬০-৬৫ শব্দ পড়তে পারলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সে প্রাথমিক পর্যায়ে পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। মাতৃভাষায় একজন শিশু না থেমে, পদে পদে আটকে না গিয়ে, অর্থ বুঝে যদি একটানা মিনিটে ৪০টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে সে পঠন-দক্ষতায় উত্তীর্ণ। আর এ রকম পড়তে পারা শিশুর সংখ্যা যদি মাত্র ১০ শতাংশ বাড়ে, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যতটা বাড়বে, তা সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে সামান্য নয়।

আমরা বলতে পারি, দেশের সব শিশু, অর্থাৎ ১০ শতাংশের ১০ গুণ, ১০০ শতাংশ শিশু মাতৃভাষা বাংলায় অর্থ বুঝে মিনিটে ৪০টি শব্দ পড়তে পারলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে ৩ শতাংশ। তাহলে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আমাদের জন্য অসাধ্য হবে না।

আমরা যে মাতৃভাষা বাংলার জন্য রাজপথে জীবন দিলাম, এরপর থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস পালন করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যে এখন সারা বিশ্ব পালন করে, তার পেছনে এটাও একটি কারণ।

সরকার গত কয়েক বছরে একাদিক্রমে প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ বৃত্তি ও অন্যান্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে মাতৃভাষার চর্চা বিপুলভাবে বেড়েছে। আজ আমরা যে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে চলেছি, তার পেছনে অন্য অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলায় দক্ষতা অর্জনও একটি কারণ।

মাতৃভাষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি আমরা জেনেছি গত বছরের ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে। ইউএসএআইডি ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় আমরা মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে বিভিন্ন আলোচকের কথায় বোঝা গেল, শুধু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করে মধ্য আয় তো বটেই, উচ্চ-মধ্য আয়, এমনকি উদীয়মান অর্থনীতির (ইমার্জিং ইকোনমিক) দেশে উত্তরণও কঠিন কিছু নয়।

ইউএসএআইডির শিক্ষাবিষয়ক টিম লিডার কেট মেলনি সেদিন বলেন, পড়তে পারা শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়ে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ– এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি হিসাব। তিনি এটাও বললেন, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চলেছে। তাই তার মানবসম্পদ উন্নয়ন দরকার। এ ক্ষেত্রে পঠন-দক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পঠন–দক্ষতা বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে জানিয়েছেন, আমাদের শিশুদের মাতৃভাষা বাংলায় পঠন-দক্ষতা যাচাইয়ের এক সরকারি জরিপের ফল অনুযায়ী, দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের মাত্র ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী ঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে।

এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই দক্ষতা ১০০ ভাগ করা যায়।

এ বিষয়ে সেদিন প্রথম আলোয় আমি একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম।

মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতার গুরুত্ব এত বেশি কেন? কারণ মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কে গুণগত উন্নয়ন সাধিত হয়, সে সহজেই ইংরেজি বা অন্য এক বা দুটি বিদেশি ভাষা শিখে নিতে পারে। তখন তার সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শীর্ষে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এটাই তো আমরা চাই।

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা