শরীরের ভেতরের ছবি নিউক্লিয়ার ক্যামেরায়

ছাব: রয়টার্স

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং, সংক্ষেপে এমআরআই হলো মানুষের শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অংশের প্রয়োজন মতো ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত অত্যাধুনিক একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চৌম্বকক্ষেত্র ও বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে আমাদের শরীরের হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স বা চুম্বকীয় অনুরণন কাজে লাগানো হয়। এই প্রযুক্তির উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৩ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ এ পর্যন্ত চারবার নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে।

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিংয়ের আদিরূপ ছিল নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এনএমআরআই (NMRI)। মূল ভিত্তিটা নিউক্লিয়াসের ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স বা চুম্বকীয় অনুরণন। যে কোন বস্তুর ক্ষুদ্রতম অংশ হলো পরমাণু। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। আর নিউক্লিয়াসের ভেতর থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। নিউক্লিয়াস খুবই ছোট। তার চেয়েও ক্ষুদ্র হলো প্রোটন আর নিউট্রন।

নিউক্লিয়াস ও তার উপাদান নিয়ে গড়ে উঠেছে নিউক্লিয়ার জগৎ। নিউক্লিয়াসের জগতের বাসিন্দা প্রোটন ও নিউট্রনের রয়েছে নিজস্ব ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স—এরা চৌম্বকক্ষেত্রে নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে থাকে।

স্যার পিটার ম্যানসফিল্ড

প্রোটনের ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৪৬ সালে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্বিবদ্যালয়ের ফেলিক্স ব্লক আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড মিল্‌স পারসেল নিউক্লিয়াসের প্রোটনের ক্ষেত্রে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্সের ব্যাখ্যা দেন। এজন্য ১৯৫২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁদের। পরের দুই দশক জুড়ে চেষ্টা চলে কীভাবে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্সকে কাজে লাগানো যায়।

আমাদের শরীরের উপাদানের বেশির ভাগই চর্বি আর পানি। চর্বি আর পানি আবার অসংখ্য হাইড্রোজেন পরমাণুর সমষ্টি। আমাদের শরীরের উপাদানের শতকরা ৬৩ ভাগই হলো হাইড্রোজেন পরমাণু। হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কোনো নিউট্রন নেই। ফলে হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস হলো একটি প্রোটন। প্রোটন ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের অধিকারী। কোন ধরনের চুম্বকক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রোটন কাঁপতে শুরু করে এবং একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে ঘুরতে থাকে।

চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তির উপর নির্ভর করে প্রোটনের ঘূর্ণন বেগ। আবার অন্য কোন বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ কোনো কারণে যদি এই চুম্বকক্ষেত্রের কাছাকাছি চলে আসে তখন চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি স্থির থাকার পরও ঘূর্ণনের বেগ বেড়ে যেতে পারে অনেকগুণ।

যদি সমান কম্পাঙ্কের কোন বেতার তরঙ্গ বা রেডিও ওয়েভ এই প্রোটনের কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে প্রোটনের কম্পাঙ্ক আর বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক মিলে একটা রেজোনেন্স বা অনুরণন তৈরি হয়। বেতার তরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে দশ লক্ষ থেকে দশ কোটিবার পর্যন্ত কাঁপতে পারে। বেতার তরঙ্গ শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে এর চেয়ে উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গ—যেমন এক্স-রে, গামা রে ইত্যাদি শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

পল লটারবার

একটি চৌম্বকক্ষেত্রে শরীরের কোন নির্দিষ্ট অংশ ফোকাস করে প্রোটনের কম্পন মেপে দেখা হয়। তারপর এর সাথে মিল থাকে এরকম শক্তির বেতার তরঙ্গ সরবরাহ করে রেজোনেন্স সৃষ্টি করা হয়। এখন বেতার তরঙ্গ সরিয়ে নিলেই দেহের হাইড্রোজেন পরমাণু বা প্রোটন তার নিজস্ব কম্পাঙ্কে ফিরে যায়। রেজোনেন্স অবস্থা থেকে নন-রেজোনেন্স বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে যে সময় লাগে তাকে বলা হয় রিলাক্সেশান টাইম। ১৯৭১ সালে প্রফেসর রেমন্ড ডেমাডিয়ান শরীরের টিউমারের উপর গবেষণা করে দেখান যে স্বাভাবিক কোষ আর টিউমারের ক্ষেত্রে এই রিলাক্সেশান টাইমের পার্থক্য দেখা যায়। ধরতে গেলে তখন থেকেই রোগ নির্ণয়ে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিংয়ের সূচনা। শরীরের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের টিস্যুর রিলাক্সেশান টাইম ভিন্ন ভিন্ন। রিলাক্সেশান টাইমের পার্থক্যের তথ্য থেকে কম্পিউটার সফটওয়ার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি বা ইমেজ তৈরি করে। এমআরআই ইমেজের কন্ট্রাস্ট খুবই উচ্চ মাত্রার হয়। ফলে এতে কোষ কিংবা টিস্যুতে সামান্যতম অস্বাভাবিকতাও দেখা যায় এবং রোগ নির্ণয়ও সহজ হয়ে ওঠে।

১৯৭৩ সালে এক্স-রেভিত্তিক কম্পিউটেড টমোগ্রাফির (CT) সূচনা করেন প্রফেসর হাউনসফিল্ড। সেবছরই এমআরআই-এর সফল প্রয়োগ করে দেখান ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের রেডিওলজি ডিপার্টমেন্টের রসায়নের অধ্যাপক পল লটারবার। এমআরআইয়ের সাহায্যে কত সহজে কোষের ছবি তোলা যায় তার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন তিনি।

এদিকে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার ম্যানসফিল্ড এমআরআই থেকে পাওয়া সিগনালগুলিকে দ্রুত ছবি বা ইমেজে রূপান্তরিত করার একটি ব্যবহারিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। প্রফেসর লটারবার আর প্রফেসর ম্যানসফিল্ড তাঁদের গবেষণার জন্য ২০০৩ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। এর আগে ১৯৯১ সালে সুইজারল্যান্ডের রিচার্ড আর্নস্টকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স স্পেকট্রোস্কোপির জন্য। ২০০২ সালে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্সকে দ্বিমাত্রিক থেকে ত্রিমাত্রিক পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইজারল্যান্ডের কুট উইরিখ।

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিংয়ের আগে নিউক্লিয়ার শব্দটি আর ব্যবহার করা হচ্ছে না এখন। তার পেছনে নিউক্লিয়ার শব্দটির প্রতি আমাদের সামাজিক ভীতি ছাড়া আর কোন কারণ নেই। নিউক্লিয়ার বলতে যেরকম একটা ধ্বংসাত্মক চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক সুলভ রাজনৈতিক প্রচারনার ফল। কিন্তু নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির সুফল আজ সব উন্নত দেশের নাগরিকই ভোগ করছে। আজকের উন্নত বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় কোটি রোগীর চিকিৎসার কাজে এমআরআই ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে হাসপাতালগুলিতে এমআরআই ব্যবহার শুরু হয়। এখন বিশ্বজুড়ে ষাট হাজারেরও বেশি এমআরআই মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে।

শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুষ্ঠু চিকিৎসায় এমআরআই ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে ব্রেইন আর স্পাইনাল কর্ডের ত্রুটি খুঁজে বের করতে এমআরআই বিশেষ উপযোগী। যে কোন অপারেশানের আগে এমআরআইয়ের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখে শরীরের ভেতরের বিস্তারিত তথ্য জেনে নিয়ে অগ্রসর হওয়া যায়। এমআরআইয়ের সফল ব্যবহারের ফলে ব্রেইন অপারেশন এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।

চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত আধুনিক এমআরআই মেশিনগুলির চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য তিন টেসলা বা তার চেয়েও বেশি, যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রায় ষাট হাজার গুণ বেশি।

এমআরআই মেশিনে কোন ধরনের রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না বলে এটা এক্স-রে বা সিটি মেশিনের চেয়ে অনেক নিরাপদ। তবে এমআরআই করার সময় কোন ধরনের চৌম্বক পদার্থ শরীরে রাখা যায় না।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া