সভ্যতার নীরব ঘাতক

ইংরেজ উদ্ভাবক আলেকজান্ডার পার্ক্স ১৮৫০ সালে প্রথম প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেন। তখন এর নাম ছিল পার্কজাইন। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৬৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক পরিণত হয়েছে আবর্জনায়। মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং বাকি প্রায় ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে রয়ে যায়। প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা, খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে জমা হচ্ছে। বলা হয়, এখন পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে এবং স্থলভাগে আছে, তার সব যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয়, তবে তা সর্বোচ্চ এভারেস্টের চেয়েও সুউচ্চ হবে!

ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন ২০১৪ সালে। তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সালে গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হতো, কিন্তু ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার টনে। এই গতি অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে এ দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার দাঁড়াবে গড়ে প্রতিদিন ৫০ হাজার টন। ছোট দেশ হিসেবে এটি কিন্তু চিন্তার বিষয়।

প্লাস্টিক দূষণের আরেকটি ভয়াবহ রূপ মাইক্রো প্লাস্টিক। মাইক্রো প্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রতম কণা। এর আকার ৫ মিলিমিটারের কম। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু খাবারে নয়, মানুষের মলেও পাওয়া গেছে মাইক্রো প্লাস্টিক। এর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে গবেষকেরা বলেছেন, এর থেকে থাইরয়েডজনিত সমস্যা, কিডনি বিকল, এমনকি ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগ বাসা বাঁধতে পারে শরীরে।

মাইক্রো প্লাস্টিকের উৎস আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিস। সকালের টুথপেস্ট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, স্ক্রাব, বডিওয়াশ, নেইলপলিশ ইত্যাদি প্রসাধনী, এমনকি ডিটারজেন্ট পাউডারেও রয়েছে মাইক্রো প্লাস্টিক। সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সহায়তায় ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয় এবং খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে চলে আসে মানবশরীরে।

শুধু মানবসভ্যতাই নয়, এই দূষণের পরিবেশগত ঝুঁকিও কম নয়। প্রায় ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রো প্লাস্টিক ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে। খাদ্যের সঙ্গে সেসব মাইক্রো প্লাস্টিক চলে যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণীদের শরীরে। সামুদ্রিক পাখিদেরও এর হাত থেকে নিস্তার নেই। কিন্তু এই প্লাস্টিক তাদের পাকস্থলীতে পরিপাক হয় না। কখনো গলায় আটকে যায়। তখন না খেতে পেরে মারা পড়ে ওই সব প্রাণী। স্পেনের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় ২০১৮ সালে একটি মৃত তিমি পাওয়া যায়, গবেষণায় পাওয়া যায়, এটি প্রায় ৩২ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক খেয়েছিল সারা জীবনে!

প্লাস্টিক উৎপাদন নিষিদ্ধ করা এই যুগে কঠিন, কারণ এটি আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পরিবেশগত উপকারিতাও কম নয়। একটি প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে খুবই কম পরিমাণ শক্তি আর কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গত হয়। আমাদের প্রয়োজন বিকল্প উদ্ভাবনের প্রতি নজর দেওয়া। সম্প্রতি পাটজাত প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ভাবিত হয়েছে, এটা পরিবেশবান্ধব। আমাদের উচিত এসব পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবনকে কাজে লাগানো এবং এর প্রসার নিশ্চিত করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশবিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়