সিলাকান্থ: জীবন্ত জীবাস্মের খোঁজে

২৩ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সাল। ভারত মহাসাগর। দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে চালুমান নদীর মোহনায় (বর্তমান নাম টায়ালোনকা) ভিড় জমিয়েছে কিছু স্থানীয় মাছ শিকারী জাহাজ। এদের মধ্যে অনেকেই হাঙ্গর শিকার করে। হঠাৎ একটি জালে দেখা গেল এক নতুন ধরনের মাছ। দেখতে নীল রঙের মাছটি লম্বায় প্রায় ৫ ফুট। ওজন ৮০ কেজির কাছাকাছি। মাছের পাখনাগুলো সাধারণ মাছের মতো নয়। মনে হচ্ছে মাছটির পাখনার পরিবর্তে কিছু মাংস ঝুলে আছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন হ্যান্ড্রিক গুসেন মাছটিকে দেখে বেশ অবাকই হলেন। গুসেন অনেকদিন ধরে মাছ শিকার করেন। এ ধরনের মাছ তিনি কোনোদিন দেখেননি। মাছটিকে জাহাজে উঠিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলেন। এবার যেন তাঁরা আরো অবাক হওয়ার পালা। তাঁদের মনে হলো মাছটি মাঝেমাঝে জ্বলে উঠছে। গুসেন বেশি চিন্তা ভাবনা না করে খবর দিলেন স্থানীয় জাদুঘরের কিউরেটরকে। নাম মার্জোরি কোর্টনি ল্যাটিমার। এই ভদ্র মহিলা আগেই স্থানীয় জেলেদের বলে রেখেছেন, কোন অপরিচিত বা নতুন ধরনের মাছ দেখলেই যেন তাঁকে খবর দেয়। স্থানীয় বাজারের চেয়ে বেশি দামেই তিনি মাছ কিনে নেবেন।

মিসেস ল্যাটিমার এলেন, দেখলে নতুন মাছটিকে, আনকোরা প্রজাতির মাছই মনে হলো তাঁর কাছে। মাছটি কিনে জাদুঘরে নিয়ে গেলেন। ঘাটাঘাটি করলেন মৎসবিজ্ঞানে নানা বই। কিন্তু এই মাছের কোন পরিচয় বের করতে পারলেন না। এদিকে মাছটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ও রয়েছে। তখন তাঁদের জাদুঘরে কোনো রেফ্রিজারেটর ছিল না। কোনো উপায় না দেখে মিসেস ল্যাটিমার মর্গে গেলেন মাছটিকে রাখার জন্য। কিন্তু মর্গের লোকেরা মানুষের পরিবর্তে একটি মাছ রাখতে রাজী নন। বাধ্য হয়ে ফিরে এলেন একজন ট্যাক্সিডার্মিস্টকে নিয়ে। কোনো মৃত প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করে বিশেষ কৌশলে তার মধ্যে জীবন্ত রূপ ফুটিয়ে তোলাই হচ্ছে ট্যাক্সিডার্মি। যাহোক, নতুন মাছের খবর পেয়ে জাদুঘরের চেয়ারম্যান এলেন দেখতে। বললেন, এটাতো সাধারণ একটা কড মাছ। এটা এত খাটুনির করছেন? কিন্তু ল্যাটিমার কড মাছ ভালো করেই চেনেন। তিনি মাছটিকে ট্যাক্সিডার্মি করে রাখলেন এবং সংরক্ষণ করলেন আঁশগুলো। এবার অনেকটা নিশ্চিন্ত মিসেস ল্যাটিমার।

মাছটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ল্যাটিমার যোগাযোগ করলেন রোড বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎসবিজ্ঞানী জেমস স্মিথের সঙ্গে। পাঠালেন কাঁচা হাতে আঁকা মাছের একটি স্কেচ। সঙ্গে কয়েকটা মাছের আঁশও পাঠালেন। দূর্ভাগ্যবশত, স্মিথ তখন ছুটিতে ছিলেন। প্রায় এক মাস পরে ফিরে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখলেন ল্যাটিমারের পাঠানো মাছের স্কেচ ও আঁশ। মাছের স্কেচ দেখেই বিস্মিত হলেন তিনি। এই মাছ তো প্রায় সাড়ে ছয় কোটি (আসলে ৬ কোটি ৬০ লাখ) বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে এখন এর অস্তিত্বই থাকার কথা নয়। তিনি আঁশ পরীক্ষা করলেন। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছটির সাথে মিল আছে এই আঁশের। তাহলে কী কোনো ভাবে মাছটি এখনো পৃথিবীতে রয়ে গেছে? স্মিথ তড়িঘড়ি করে ল্যাটিমারকে চিঠি লিখলেন। তিনি জাদুঘরে গিয়ে সংরক্ষিত মাছটিকে নিজের চোখে দেখতে চান। যাওয়ার আগে কিছুদিন মাছ সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা করলেন। বিশেষ করে বিলুপ্ত মাছ নিয়ে।

১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯। জেমস স্মিথ পৌঁছালেন দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব লন্ডন জাদুঘরে। নিজের চোখে দেখলেন ল্যাটিমারের সংরক্ষণ করা মাছটিকে। এতটাই অবাক হলেন যেন শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়। আসলেই ওটা সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মাছটিই। এর নাম সিলাকান্থ। এক শ এক বছর আগে এই মাছটির জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী লুই আগাসিজ। তিনিই মাছটির নাম রাখেন সিলাকান্থ। সিলাকান্থ এখন জীবন্ত জীবাশ্ম নামে পরিচিত।

জীবন্ত জীবাশ্ম বুঝতে হলে আগে জানতে হবে জীবাশ্ম কী? অশ্ম শব্দের অর্থ পাথর। সুতরাং সহজ কথায়, জীবাশ্ম বলতে পাথরে রূপান্তরিত কোন দেহ বা দেহাংশকে বোঝায়। মনে হতে পারে, দেহ আবার পাথরে রূপান্তরিত হয় কীভাবে? হাজার বা কোটি বছর আগে যে প্রাণিগুলো ছিল, তাঁদের দেহ বা দেহাংশ বিভিন্ন কারণে মাটির তলায় চাপা পড়েছে। পানি বা বায়ুপ্রবাহের কারণে পলির ওপর পলির স্তর জমা হয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ চাপ ও তাপের কারণে সেগুলো এক সময় পাথরে পরিণত হয়েছে। কোটি বছর আগের কোনো প্রাণী হয়ত নদীর ধারে পানি খেতে এসেছিল। প্রাণিটির ছাপ রয়ে গেছে নরম মাটিতে। সেই পায়ের ছাপের ওপর পলি জমা হয়েছে। ফলে ছাপসহ পাথরে পরিণত হয়েছে। ছাপ নষ্ট হয়নি একটুও। একই ভাবে কোন প্রাণি বা উদ্ভিদের সম্পূর্ণ দেহ বা দেহের কোন অংশ পাথরে পরিণত হয়। এমনও হতে পারে যে, প্রাণিটির দেহ নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তার চারপাশের মাটি পাথরে পরিণত হওয়ায় প্রায়ের ছাপটি রয়ে গেছে। এই হলো জীবাশ্ম। কিন্তু জীবন্ত জীবাশ্ম আবার কী? তাহলে কি অতীতে পাথর হয়ে যাওয়া কোন প্রাণির মধ্যে এখনো প্রাণ রয়ে গেছে? না। সেটা আসলে সম্ভবও নয়। জীবন্ত জীবাশ্ম বলতে বুঝায়, সেই কোটি কোটি বছর আগে কোনো প্রাণি, যে ভাবে ছিল এখনো সেই ভাবেই আছে। নতুন কোনো বৈশিষ্ট যোগ হয়নি। অথবা প্রাণিটি একেবারে শেষও হয়ে যায়নি। সিলাকান্থের ব্যাপারটাও হয়তো তেমন।

জেমস স্মিথ মাছটিকে সিলাকান্থ বলে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু ল্যাটিমারের সংগ্রহে থাকা মাছটির তো শুধু চামড়া আর মাথাটি আসল। ভেতরের সবকিছু নকল। এতে মন ভরল না স্মিথের। তাই তিনি ঘোষণা দিলেন, কোনো জেলে এই মাছ ধরতে পারলে তাঁকে ১০০ পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হবে (১৯৪০ এর দশকে ১২ হাজার টাকা কিন্তু অনেক)। মাছের ছবিসহ পুরস্কারের কথা লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন। প্রায় চার মাস খাটাখাটনি করে সিলাকান্থ সম্পর্কে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করলেন স্মিথ। মিসেস ল্যাটিমারকে সম্মান দিতে ভুল করেননি তিনি। ল্যাটিমার ও চালুমনে নদীর নামের সাথে মিল রেখে সিলাকান্থের বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয় ল্যাটিমারিয়া চালুমানে (Latimeria chalumnae)।

১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাস। প্রায় ১১ বছর পর আফ্রিকার কমোর দ্বীপের এক মৎসজীবী ৩৭ কেজি ওজনের সিলাকান্থ ধরলেন। কিন্তু তিনি পুরষ্কারের ব্যাপারটা জানতেন না তিনি। মাছটির আঁশ ছাড়িয়ে ফেলেছেন। এমন সময় একজন শিক্ষক জেলেকে পুরস্কারের কথাটা জানালেন। জেলে স্মিথের সাথে যোগাযোগ করলেন অনেক কষ্টে। ফরমালিন ব্যবহার করে মাছটিকে স্মিথের কাছে পৌছে দেওয়া হলো। এখানেই শেষ নয়। এরপরেও ১৯৭৫ ও ১৯৮৪ সালে সিলাকান্থ ধরেছেন জেলেরা।

১৯৯৭ সাল। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ জীববিজ্ঞানী মার্ক আর্ডম্যান হানিমুনে গেছেন ইন্দোনেশিয়ার মেনাদো তুয়া দ্বীপে। একদিন সকালে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গেলেন স্থানীয় মাছের বাজারে। সেখানেই হঠাৎ একটি মাছ দেখে চমকে যান মার্ক। সিলাকান্থের মতো একটি মাছ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দোকানে। ব্যবসায়ীর কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি মাছের নাম বলতে পারলেন না। মার্ক মাছটির কয়েকটি ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। সেই ছবি কানাডার গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সিলাকান্থ গবেষকের নজরে পড়ল। তাঁরা অনেক গবেষণা মার্ককে জানালেন এটিও একটি সিলাকান্থ মাছ। তবে আগেরটি অর্থাৎ ল্যাটিমারিয়া প্রজাতির নয়। এটি নতুন প্রজাতির সিলাকান্থ। মেনাদো তুয়া দ্বীপের নাম অনুসারে নতুন সিলাকান্থের বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হলো ল্যাটিমারিয়া মেনাদোয়েনসিস (Latimeria menadoensis)।

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে এই দুই ধরনের সিলাকান্থ মাছ পাওয়া গেছে। এরা লম্বায় প্রায় ৬.৬ ফিট হয়ে থাকে। ৯০ কেজি ওজনের মাছগুলো ষাট বছরের বেশি বাঁচে। সিলাকান্থের আটটি পাখনা থাকে। এর মধ্যে দুটি বক্ষ পাখনা, দুটি শ্রেণি পাখনা, দুটি পৃষ্ঠ পাখনা, একটি পায়ু পাখনা ও একটি পুচ্ছ পাখনা। তবে পাখনাগুলো সাধারণ মাছের মতো নয়। এদের পাখনাগুলো দেখলে মনে হবে শরীরের ভেতর থেকে কিছু মাংস বেরিয়ে এসেছে। মাংসের চারপাশে আঙ্গুলের মতো পাখনা বেরিয়ে থাকে। বিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের মাংসযুক্ত পাখনাকে লবড ফিন বলে।

সিলাকান্থ খুব অলস প্রাণি। শিকারের জন্য এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকে। শিকার কাছাকাছি এলেই ধরে ফেলে। এছাড়া এদের মাংসল পাখনার কারণে সাগরের নিচে মাটির সাথে ভর দিয়ে চলতে পারে। ফলে শিকার ধরতে সুবিধা হয়। সিলাকান্থের মুখ ছোট হলেও চোখজোড়া বড় বড়। সাধারণত পরুষের চেয়ে স্ত্রী সিলাকান্থ বড় আকারের হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা এখনো পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ শটি সিলাকান্থ রয়েছে। ২০১৩ সালে সিলাকান্থের জিনোম সিকোয়েন্স করেছে ক্রিস অ্যামেমিয়া ও নীল সুবিনের দল। তাঁরা এই ব্যাপারে নেচার-এ একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত কেনিয়া, দক্ষিণ আফিকা, মাদাগাস্কার, ইন্দোনেশিয়া, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক ও আফ্রিকার কমোর দ্বীপে সিলাকান্থ পাওয়া গেছে।

সিলাকান্থের ব্যাপারে এখনো সবচেয়ে বড় রহস্য, এরা এত কোটি বছর নিজেদের কোনো পরিবর্তন না করে কীভাবে টিকে আছে? তাহলে কি সমুদ্রের কোথায় টিকে আছে সেই আদিম পরিবেশ? অথবা সিলাকান্থ কি উভচর ও জলজ প্রাণিদের মাঝামাঝি সময়ের কোনো মাছ? এই সব প্রশ্নের উত্তরের পেতে হলে সিলাকান্থকে নিয়ে আরো গবেষণা করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। ২০১১ সালে সিলাকান্থের গবেষণা ও আবাসস্থলের জন্য বাজেট করেছিল দশ মিলিয়ন ডলার। সিলাকান্থ গবেষণায় অন্যান্য দেশেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই রক্ষা করা যাবে এই জীবন্ত জীবাশ্মটিকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: নেচার ডট কম, আ ফিস কট ইন টাইম দ্য সার্চ ফর দ্য সিলাকান্থ- ওয়েনবার্গ, দ্য আপডেটেড স্টোরি অব সিলাকান্থ- মাইকেল বার্টন, প্রাণিজগতের বিষ্ময়- সুধাংশু পাত্র ও উইকিপিডিয়া।