দাবার ইতিহাস
চিসার কিংবদন্তি ও দাবার ঘরে বুদ্ধিতে বাজিমাত
চতুরঙ্গের খেলাঘরে ৬৪টি বর্গ। চিসা রাজার কাছে প্রথম বর্গের জন্য একটি শস্য চাইলেন। পরের প্রতিটি ঘরের জন্য চাইলের আগের ঘরের দ্বিগুণ। দাবার ইতিহাস, চিসার বুদ্ধিতে বাজিমাৎ ও চতুরঙ্গের পৃথিবী জয়ের কাহিনি...
অনেকদিন আগে এক দেশে বাস করতেন এক জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁর নাম চিসা। একদিন তিনি নতুন একটি খেলা আবিস্কার করলেন। খেলার নাম দিলেন চতুরঙ্গ।
সে দেশের রাজা শেহরামকে একদিন খেলাটি দেখালেন চিসা। রাজা মুগ্ধ হলেন। ভীষণ খুশি হয়ে তিনি পুরস্কার হিসেবে চিসাকে যা ইচ্ছে চাইতে বললেন।
জবাবে বুদ্ধিমান চিসা বললেন, ‘আমি খুব সাধারণ মানুষ। আভিজাত্য, অট্টালিকা কিংবা সোনাদানা বা টাকাপয়সায় লোভ আমার নেই। শুধু সারা জীবন তিন বেলা পেটপুরে খেতে চাই। তাই রাজামশাই, এই খেলনার ছকে যতটুকু শস্য আঁটে, সেটুকু দিলেই আমি খুশি।’
এ কথায় রাজা কিছুটা ক্ষুব্দ হয়ে বললেন, ‘মাত্র এটুকু! তুমি কি আমাকে অপমান করতে চাইছ?’
‘না, রাজামশাই। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। তার আগে বলুন, আপনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি আপনি পূরণ করবেন।’
জলদ গম্ভীর স্বরে রাজা বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই করব।’
‘তাহলে, চতুরঙ্গের প্রথম বর্গক্ষেত্রে মাত্র একটি শস্য দেবেন। তারপরের বর্গক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে দ্বিগুণ। তৃতীয় বর্গক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ... এভাবে পুরো ৬৪টি বর্গক্ষেত্র পূরণ করবেন দয়া করে। এটুকুই দিলেই চলবে।’
লোকটিকে বোকার হদ্দ ভেবে রাজা হো হো করে এক চোট হেসে নিলেন। ভাবলেন, এ আর এমন কী।
কিন্তু তার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ লোকটির চাহিদা তিনি পূরণ করতে পারলেন না। আর পারবেন কীভাবে, তার কাছে তো ওই পরিমাণ শস্য ছিলই না।
যারা এটুকু পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ওই রাজার মতোই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, এ আর এমন কী! কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শুনলে আপনার চোখ কপালেও উঠে যেতে পারে। সে কথায় একটু পরে আসছি। প্রায় কিংবদন্তির মতো এ ধরনের বেশ কয়েকটি কাহিনি প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি সংস্করণ বর্ণিত হয়েছে পারস্যের কবি ফেরদৌসীর বিখ্যাত শাহনামায়। তাই সোহরাব-রুস্তমের মতো এ গল্পটি সত্যি নাকি কিংবদন্তি, তা নিয়ে গবেষকরাও সন্দিহান। তবে গল্পটির উত্স যে ভারতে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত অনেকে। কারণ তথ্যপ্রমাণ বলে, চতুরঙ্গ বা দাবার জন্ম ভারত উপমহাদেশে। অনেকের অনুমান, খ্রিষ্টিয় ৭ শতকে, অর্থাৎ ১৪০০ বছর আগে ভারতে দাবা খেলা চালু হয়। সে সময় এর নাম ছিল চতুরঙ্গ (চতু মানে চার এবং অঙ্গ মানে অংশ)। তখন দাবায় হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক সৈন্য-এ চারটি অংশ ছিল। তাই এমন নাম।
চতুরঙ্গ থেকে আধুনিক দাবা হয়ে উঠতে অনেক সময় আর দেশ পাড়ি দিতে হয়েছে। শুরু থেকেই এটা বুদ্ধিমানের খেলা হিসেবে বেশি পরিচিত। ৬৪ ঘরের এ খেলায় যথেষ্ট বুদ্ধি আর কৌশলের প্রয়োজন। তাই বুদ্ধির পরীক্ষা দিতে সে যুগেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল চতুরঙ্গ। সে যুগে ভারতের সাথে আরব ও পারস্যের (বর্তমানে ইরান) বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। বণিকদের হাত ধরে চতুরঙ্গ একসময় পারস্যে চলে যায়। সেখানে এর নতুন নাম হয় শতরঞ্জ। প্রায় একই সময় ভারত থেকে খেলাটা চীনযাত্রা করে। চীনারা এর নামকরণ করে জিয়ানকুই।
১২ শতকে পারস্যের বাদশা সালাউদ্দিনের শাসনামলে ইউরোপের ক্রুসেডাররা জেরুজালেম রক্ষার নামে দলে দলে ভিড় জমায় আরব ও পারস্যে। দীর্ঘদিন সেখানে থাকাকালে সেখানকার অনেক কিছুই আমদানী করতে থাকে ইউরোপে। এভাবে শতরঞ্জও ইউরোপে চলে যায়। আবার স্পেনে মুসলিম মুর শাসনামলে শতরঞ্জ ইউরোপসহ রাশিয়ার ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা অনেকের। এখানেও সে নতুন নাম পায় ‘চেস’, যা পুরাতন ফরাসি ভাষা 'echec' (অর্থ চেক) থেকে উদ্ভুত। শুধু নামেই নয়, খেলাটার আরও অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়। এখানেই ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবে দাবায় বিশপ (ভারত ও বাংলাদেশে হাতি বা গজ নামেও পরিচিত) যুক্ত হয়। আরও পরে যোগ হয় রানি।
১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক গ্রান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারভ দাবা খেলেন ডিপ ব্লু নামের এক কম্পিউটারের সঙ্গে। সে বারই প্রথমবারের মতো মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথা যন্ত্র। সেবার ডিপ ব্লুর সঙ্গে দাবা খেলায় কাসপারভ জিতে যান। ঠিক পরের বছর তিনি হেরে যান ডিপ ব্লুর কাছে
পরে ইউরোপীয়দের মাধ্যমে একসময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দাবা। ১৯২৪ সালে দ্য ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডেস চেস (এফআইডিই) গঠিত হয়। তারা দাবা খেলার আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এ সংস্থা আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজক। দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে এফআইডিই খেলোয়ারদের ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ও গ্রান্ডমাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যেসব খেলোয়াড় প্রতিযোগিতায় সবার সেরা হয় তারাই গ্রান্ডমাস্টার।
অনেকেই হয়তো জানেন, বাংলাদেশ থেকে বেশ কজন এই খেলায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। নিয়াজ মোর্শেদ বাংলাদেশের প্রথম গ্রান্ডমাস্টার। গত শতাব্দিতে দাবা খেলায় কম্পিউটারের ব্যবহার একে আরও জনপ্রিয় ও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক গ্রান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারভ দাবা খেলেন ডিপ ব্লু নামের এক কম্পিউটারের সঙ্গে। সে বারই প্রথমবারের মতো মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথা যন্ত্র। সেবার ডিপ ব্লুর সঙ্গে দাবা খেলায় কাসপারভ জিতে যান। ঠিক পরের বছর তিনি হেরে যান ডিপ ব্লুর কাছে। যন্ত্রের কাছে হেরে যাওয়ার এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
এখন কিংবদন্তির রাজা শেহরাম আর বুদ্ধিমান চিসার কাছে ফেরা যাক। হিসেব করে দেখা যাক, চিসার শর্ত অনুযায়ী, ৬৪টি বর্গক্ষেত্রে ঠিক কী পরিমাণ শস্যকণা থাকতে পারে। হিসেব মতে, ৬৪তম বর্গক্ষেত্রে গম বা শস্যের পরিমাণ হবে ২৬৩টি (অর্থাৎ ২-এর ওপর পাওয়ার বা ঘাত ৬৩)। কারণ প্রথম ঘরটিতে ছিল একটি শস্য। দ্বিতীয়টিতে ২টি, তৃতীয়টিতে ৪টি বা ২২ (২-এর ঘাত বা পাওয়ার ২) চতুর্থটিতে ৮টি বা ২৩... এভাবে ৬৪তম বর্গক্ষেত্রে ২৬৩ (২-এর ঘাত ৬৩)।
অবশ্য তিনি দিতে পারলেও সেটি গুণে বুঝে নেয়াও চিসার জন্য অনেক বড় ঝক্কির কাজ হতো। হিসেব মতে, চিসা যদি সারা দিনরাত শুধু শস্যদানা গুণে যেতেন আর সেকেন্ডে যদি একটি দানা গুনতে পারতেন, তাহলে প্রথম দিনে তিনি মাত্র ৮৬ হাজার ৪০০টি দানা গুনতে পারতেন
তাহলে, পুরো দাবার বোর্ডে শস্যকণার পরিমাণ হবে ২৬৪-১ টি। অর্থাৎ ২-কে ৬৪ বার গুণ করে, তা থেকে ১ বিয়োগ করতে হবে। কারণ প্রথম ঘরে শস্যকণার পরিমাণ ১টি,
দ্বিতীয় ঘরে ১ + ২ = ৩ বা ২২ – ১ টি,
তৃতীয় ঘরে ১ + ২ + ৪ = ৭টি বা ২৩- ১ টি,
চতুর্থ ঘরে ১ + ২ + ৪ + ৮ = ১৫টি বা ২৪- ১ টি,
এভাবে ৬৪তম ঘরে ২৬৪- ১ টি।
কাগজে বা ক্যালকুলেটর হিসেব করলে পাওয়া যায়, ২৬৪- ১ = ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১,৬১৫। অর্থাৎ চিসাকে ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১,৬১৫টি শস্যকণা দিতে হবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ পরিমাণ শস্যকণা রাজা শেহরামের কাছে কেন, পুরো পৃথিবীতেই নেই। সে সময় রাজকর্মচারীরা কয়েকদিন হিসেব করে রাজা শেহরামকে বলেছিলেন, চিসাকে ওই পরিমাণ শস্য দিতে হলে, পুরো দুনিয়ার সব জমিকে ক্ষেত বানাতে হবে। তাই শেষ পর্যন্ত চিসাকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি রাজা। এ কাহিনীর আরেক সংস্করণে (শাহনামায় নয়) দেখা যায়, এ অক্ষমতার জ্বালা মেটাতে নাকি চিসাকে শেষপর্যন্ত হত্যা করেছিলেন রাজা।
অবশ্য তিনি দিতে পারলেও সেটি গুণে বুঝে নেয়াও চিসার জন্য অনেক বড় ঝক্কির কাজ হতো। হিসেব মতে, চিসা যদি সারা দিনরাত শুধু শস্যদানা গুণে যেতেন আর সেকেন্ডে যদি একটি দানা গুনতে পারতেন, তাহলে প্রথম দিনে তিনি মাত্র ৮৬ হাজার ৪০০টি দানা গুনতে পারতেন। এভাবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারা দিন শুধু শস্যদানা গুনে গেলে তাঁর লাগত ৫৮৪,৯৪২,৪১৭,৩৫৫ বছর।
আর এ পরিমাণ শস্যকণা রাখতে চাইলে, ৪০ কিলোমিটার লম্বা, ৪০ কিলোমিটার চওড়া আর ৩০০ মিটার উঁচু গোলাঘর বানাতে হবে। হিসেব করে দেখা যায়, এ শস্য যদি ধান হতো, তাহলে তার পরিমাণ হতো ৪৬১,১৬৮,৬০২,০০০ মেট্রিক টন। এ ধানের স্তুপ হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট থেকেও উঁচু হবে। এটি ২০১০ সালে সারা বিশ্বে উত্পাদিত ধানের চেয়েও এক হাজার গুণ বেশি। কারণ ২০১০ সালে বিশ্বে ধান উত্পাদন হয়েছে, ৪৬৪,০০০,০০০ মেট্রিক টন।
