দ্য ম্যান হু কাউন্টেড

মেধার মিলন

আমার নাম হানাক তাদে মাইয়া। এতদিন টাইগ্রিস নদীর তীরের সামারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন বাগদাদের রাস্তা ধরে উটের পিঠে চেপে হেলেদুলে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ভদ্র পোশাকের একজন মুসাফির একটি পাথরের ওপর বসা। ভ্রমণের ক্লান্তির ছাপ চোখে-মুখে।

স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাকে সালাম দিতে যাচ্ছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, চৌদ্দ লক্ষ তেইশ হাজার সাত শ পয়তাল্লিশ।

এরপর দ্রুত করে বসে পড়ে নিরব হয়ে গেলেন। দুই হাতের ওপর মাথা রেখে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন। থেমে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল যেন অতীতের রূপকথার গল্প থেকে উঠে ঐতিহাসিক কোনো ব্যক্তির ভাস্কর্য।

একটু পর আবার দাঁড়ালেন। পরিষ্কার কণ্ঠে সযত্নে আরেকটি বিশাল সংখ্যা আওড়ালেন, তেইশ লক্ষ একুশ হাজার আট শ ছেষট্টি।

আরও কয়েকবার দাঁড়িয়ে লোকটা এমন কিছু সংখ্যা উচ্চারণ করলেন। আবারও রাস্তার পাশের রুক্ষ পথরটার উপর বসলেন তিনি। কৌতূহল দমন করতে না পেরে আমি তার কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে সংখ্যাগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।

হে আগন্তুক, গণনাকারী বললেন, আমার চিন্তা-ভাবনা ও হিসাবের অসুবিধা হলেও আপানার কৌতূহলকটা মেটাব। আপনি আমার সাথে সৌজন্য ও ভদ্রতার সাথে কথা বলেছেন। আপনার ইচ্ছা পূরণ করছি। তবে আগে আপনাকে আমার নিজের কাহিনি বলতে হয়।

এরপর তিনি আমাকে নিজের কাহিনি শোনালেন। মজার গল্পটা আমি তাঁর কণ্ঠেই শোনাচ্ছি আপনাদের।

আস্থাভাজন মানুষ

গণনাকারী তাঁর জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন। জানলাম তাঁর হিসাব করার বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা। জানতে পারবেন কীভাবে আমরা একে অপরের সফরসঙ্গী হলাম।

আমার নাম বেরেমিজ সামির। পারস্যের খোই গ্রামে আমার জন্ম। পিরামিডের মতো দেখতে সুউচ্চ আরারাত পর্বতের ছায়ায় গ্রামটির অবস্থান। খুব ছোট থাকতেই আমি রাখালের কাজ শুরু করি। আমার মনিব ছিলেন খামাত অঞ্চলের একজন বিত্তশালী মানুষ।

প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটলেই আমি বিশাল এক ভেড়ার পাল নিয়ে তৃণভূমিতে চলে যেতাম। আলো ফুরাবার আগেই আমাকে ফিরে আসতে হত। কোনো ভেড়া হারিয়ে গেলে ছিল কঠোর শাস্তির ভয়। এ ভয়ে আমি প্রতিদিন কয়েকবার সেগুলো গুণতাম।

গণনায় আমি খুব দক্ষ হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে তো এক নজর দেখেই পুরো পাল গুণে ফেলতে পারতাম। গণনার চর্চার জন্যে আমি আকাশে ওড়া পাখির ঝাঁক গুণতাম। ক্রমেই এই শিল্পে আমি কুশলী হয়ে উঠতে থাকলাম। আমি পিঁপড়া ও অন্যান্য পোকামাকড় গুণতে থাকলাম। কয়েক মাস পরে দারুণ এক অর্জন হয়ে গেল আমার। একটি মৌচাকের সব মৌমাছি গুণে ফেললাম আমি। এই কৃতিত্ব অবশ্য আমার পরের অর্জনগুলোর তুলনায় কিছুই নয়।

কিছুটা দূরের অঞ্চলে আমার সহৃদয় মনিবের কিছু মরুদ্যান ছিল। যেখানে ছিল সুবিশাল খেজুর গাছের সারি। আমার গাণিতিক প্রতিভার কথা মনিব শুনেছিলেন। এবার তিনি আমাকে খেজুর বিক্রির দায়িত্ব দিলেন। সেগুলোকে গুচ্ছে গুচ্ছে একটি একটি করে গুণতাম আমি। এভাবে খেজুর গাছের তলায় আমার দশ বছর কাটল। মনিবের প্রচুর লাভ হলো। খুশি হয়ে তিনি আমাকে চার মাসের অবকাশ দিলেন। এখন আমি বাগদাদ যাচ্ছি। সেখান আমার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করব। আর দেখব সেখানকার সুন্দর সুন্দর মসজিদ ও জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদগুলো।

সময় নষ্টের হাত থেকে বাঁচতে আমি ভ্রমণ করতে করতে এই অঞ্চলের খেজুর গাছগুলো গুণেছি। গুণেছি সেই ফুলগুলো, যেগুলোর ঘ্রাণে এই পথ বিমোহিত হয়ে আছে। সে পাখিগুলো যেগুলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পাখা মেলে উড়ছে।

কাছের একটি ডুমুর গাছ দেখিয়ে তিনি বললেন, এই যেমন এই গাছটির কথাই ধরুন। এতে দুই শ চুরাশিটি ডাল আছে। প্রতি ডালে গড়ে তিন শ সাতচল্লিশটি পাতা থাকলে সহজেই হিসাব করা যায়, এতে মোট আটানব্বই হাজার পাঁচ শ আটচল্লিশটি পাতা আছে। তাই না, বন্ধু?

অসাধারণ! আমার কণ্ঠে বিস্ময়। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য, একজন মানুষ একটি গাছের দিকে এক নজর তাকিয়ে সবগুলো ডালের সংখ্যা বলতে পারে। বাগানের সব ফুলের সংখ্যা বলতে পারে। এই প্রতিভা কাজে লাগিয়ে যে কেউই অনেক টাকার মালিক হতে পারে!

আপনার কি তাই মনে হয়? বেরেমিজ বললেন। 'আমার কখনও মনে হয়নি, লক্ষ পাতা ও মৌমাছি গুণে অর্থ পাওয়া যেতে পারে। একটি গাছে কয়টি ডাল আছে তা কার কী কাজে লাগবে? আকাশের একটি পাখির ঝাঁকে কয়টি খেচর উড়ছে তাই বা কে টাকা দিয়ে জানতে চাইবে?

আপনার বিস্ময়কর প্রতিভা, আমি ব্যাখ্যা করলাম, কুড়িটা আলাদা উপায়ে কাজে লাগানো সম্ভব। কনস্টান্টিনোপাল বা এমনকি বাগদাদের মতো বিশাল রাজধানীতে আপনি সরকারকে অপরিসীম সহায়তা করতে পারেন। আপনি মানুষ, সেনাবাহিনি ও পশুর পাল গুণতে পারবেন। দেশের সম্পদের হিসাব করা আপনার জন্যে সহজ। দেশের উৎপাদন, কর, পণ্য ও দেশের সব অর্থের হিসাব-নিকাশ আপনি করে ফেলতে পারবেন। আমার বাড়ি বাগদাদে। সে সুবাদে আমি আমার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে আমাদের শাসক ও মনিব খলিফা আল-মুতাসিমের দরবারে আপনার জন্যে কোনো পদের ব্যবস্থা করে ফেলার আস্থা দিতে পারি। আপনি কোষাধ্যক্ষ হতে পারেন। অথবা মুসলমানদের পারিবারিক বিষয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

ঠিক আছে, আমি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। বললেন গণনাকারী। আমি বাগদাদেই যাচ্ছি।

আর কথা না বাড়িয়ে তিনি আমার পেছনে উটে উঠে বসলেন। একমাত্র উটের পিটে চেপে আমরা অপূর্ব সুন্দর বাগদাদ শহরের দিকে এগিয়ে চলছি। গাঁয়ের পথে হঠাৎ সাক্ষাৎ ঘটা সেই লোক সেই থেকে হয়ে গেলেন আমার বন্ধু ও সর্বক্ষণের সঙ্গী।

বেরেমিজ খুব হাসিখুশি মানুষ। কথা বলেন খুব। বয়সটা বেশি নয় (তখনও ছাব্বিশ পূর্ণ হয়নি)। তিনি ছিলেন প্রানোচ্ছ্বল বুদ্ধিমত্তার আশির্বাদপুষ্ট। ছিল সংখ্যার বৈশিষ্ট্য জানার দুর্বার নেশা। খুব সাদামাটা ঘটনা থেকেও তিনি অন্যদের জন্যে অসম্ভব তুলনা বের করে আনেন। গাণিতিক বিচক্ষণতা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। তিনি গল্প ও কাহিনি বলতেও পারদর্শী। সেজন্যে তাঁর কথাবার্তা শুনতে অদ্ভুত হলেও আকর্ষণীয়।

কখনও কখনও তিনি কয়েক ঘণ্টা চুপ হয়ে বসে থাকতেন। একটুও শব্দ করতেন না। মনে মনে কিন্তু চলছে কড়া হিসাব-নিকাশ। এ সময়গুলোতে আমার কষ্ট হলেও তাকে বিরক্ত করতাম না। শান্তিতে থাকতে দিতাম। হয়ত ঐ সময়েই এই মেধাবী মনন থেকে বেরিয়ে আসবে গণিতের প্রাচীন কোনো রহস্যের অপূর্ব আবিষ্কার। বিজ্ঞানের যে শাখাটিকে আরবরা উন্নত করেছে। যোগ করেছে নতুন অবদান।

বোঝাবাহী পশু

৩৫টি উট বন্টনের কাহিনি, যেগুলোকে তিন আরব ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। যেভাবে গণনাকারী বেরেমিজ সামির আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব সেই ভাগটি করলেন, যার ফলে তর্করত তিন ভাই সন্তুষ্ট হয়ে গেল। যেভাবে এর ফলে আমাদেরও লাভ হলো।

একটানা কয়েক ঘণ্টা চললাম আমরা। হঠাৎ করে বলার মতো একটা ঘটনা ঘটল। আমার সহযাত্রী বেরেমিজ এবার দক্ষ বীজগাণিতিকের মতো তাঁর মেধার প্রতিফলন দেখালেন।

একটি পুরনো ও অর্ধ-পরিত্যক্ত সরাইখানার কাছে তিনজন মানুষকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করতে দেখলাম। পাশেই কতগুলো উট দাঁড়িয়ে আছে। রাগে তিনজনের মুখ লাল হয়ে আছে। শোনা গেল তাদের কথা: না, তা হতে পারে না।

-এ তো ডাকাতি!

-কিন্তু আমি তো তাতে রাজি নই!

বুদ্ধিমান বেরেমিজ তাদেরকে তর্কের কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

আমরা তিনজন সহোদর। বড়জন বলল। উত্তরাধিকার সূত্র ৩৫টি উট পেয়েছি আমরা। বাবার ইচ্ছা অনুসারে এগুলোর অর্ধেক পাব আমি। তিন ভাগের এক ভাগ পাবে আমার ভাই হামিদ। আর নয় ভাগের এক ভাগ পাবে ছোট ভাই হারিম। কিন্তু আমরা ভাগটা করতে পারছি না। কেউ কিছু বললেই বাকি দুজন প্রতিবাদ করে। এ পর্যন্ত যত সমধান এসেছে তার কোনোটাই গ্রহণযোগ্য হয়নি। ৩৫-এর অর্ধেক ১৭.৫। তিন ভাগ বা নয় ভাগের একভাগও তো ভাল কোনো সংখ্যা নয়। তাহলে কীভাবে ভাগ হবে?

খুব সোজা, বললেন গণনাকারী। 'আমি সঠিকভাবে ভাগ করে দিচ্ছি। তোমাদের ৩৫টি উটের সাথে আমার সুদর্শন উটটিও যোগ করলাম।

কিন্তু আমি বাধ সাধলাম, এমন পাগলামি আমি মানি না। উট ছাড়া আমরা সফর করব কীভাবে?

চিন্তা করো না, বাগদাদের বন্ধু, বেরেমিজ কানে কানে বলল, আমি যা করছি জেনে-বুঝেই করছি। তোমার উটটা দাও। দেখোই না কী করি।

তাঁর কথার আত্মবিশ্বাসের স্ফুরণ দেখে আমি আর দ্বিধা না করে আমার সুন্দর উটটি তাঁকে দিয়ে দিলাম। এবার একে তিন ভাইয়ের উটের সাথে যোগ করা হলো।

বন্ধুগণ, তিনি বললেন, আমি একটি ন্যায় বণ্টন ও সঠিক বিভাজন করব। এখন আমাদের কাছে উট আছে ৩৬টি।

বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনার উট পাওয়ার কথা ৩৫-এর অর্ধেকসংখ্যক। মানে ১৭.৫। আমি আপনাকে দেব ১৮টি। এতে আপনার আপত্তি করার কিছুই নেই, কারণ আপনি প্রাপ্যের চেয়ে বেশিই পাচ্ছেন।

দ্বিতীয় ভাইকে তিনি বললেন, হামিদ, আপনার পাওয়ার কথা ৩৫-এর তিন ভাগের এক ভাগ। মানে ১১টির ভগাংশ পরিমাণ বেশি। এখন আপনি পাবেন ১২টি। আপনার কিছু বলার কথা নয়, কারণ আপনি বেশিই পেয়েছেন।

এবার তিনি ছোটভাইয়ের দিকে ঘুরলেন, হারিম নামির, আপনার বাবার ইচ্ছা অনুসারে আপনি পাচ্ছেন ৩৫-এর নয় ভাগের এক ভাগ, যাতে ৩টা ও আরেকটার কিছু অংশ হয়। কিন্তু আমি পুরো ৪টি উট দিলাম। আপনিও প্রাপ্যের চেয়ে বেশিই পেয়েছেন বলে আমাকে ধন্যবাদ দিতে পারেন।

এবার তিনি বলে গেলেন, আমার বণ্টনে সবাই লাভবান হয়েছেন। বড় ভাই পেছেন ১৮টি উট, পরের ভাই পেয়েছেন ১২টি, আর ছোটভাই ৪টি। ১৮ + ১২ + ৪ = ৩৪টি উট বণ্টন হয়েছে। ২টি উট বাকি থাকল। এর একটি আমাদের বাগদাদী বন্ধুর উট। আমি সমস্যাটি সমাধান করে দিয়েছি বলে আরেকটি উট আমাকে দিতে পারেন চাইলে।

হে আগন্তুক, আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ। বড় ভাইয়ের কণ্ঠে প্রশংসা। 'আমরা বিশ্বাস করি, সঠিক ও ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনই হয়েছে। আমরা আপনার সমাধান গ্রহণ করলাম।

বুদ্ধিমান গণনাকারী বেরেমিজ পাল থেকে ভাল একটা উট নিলেন। আমার উটের লাগাম তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন, বন্ধু, চলো, আরাম ও তৃপ্তির সাথে যাত্রা শুরু করি। এখন আমার কাছেও উট আছে।

আমরা বাগদাদের উদ্দেশ্যে চলতে লাগলাম।

লেখক পরিচিতি:

মালবা তাহান ব্রাজিলীয় গণিত লেখক হুলিও সিজার দা মেইয়ো এ সৌজার (১৮৯৫-১৯৭৪) ছদ্মনাম। গণিতের রহস্য ও আনন্দ মানুষের কাছে প্রকাশের জন্যে লেখক নামটি বেছে নিয়েছেন। মালবা তাহান ছদ্মনামে একশোর বেশি বই লিখেছেন। ছদ্মনাম সবাই জেনে ফেলার পরেও এই নামেই লিখেছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লেখালেখি করে গেছেন তিনি।

অসাধারণ বইগুলোর জন্য তিনি ব্রাজিলিয়ান লিটারেরি একাডেমীর মর্যাদাজনন পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৪ সালে তাঁর ছদ্মনাম দিয়ে তৈরি করা হয় দ্য মালবা তাহান ইনস্টিটিউট। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে রিও ডি জেনোরিও সংসদ ঠিক করে তাঁর মৃত্যদিন ৬ মে দেশে গণিত দিবস হিসেবে পালিত হবে। দ্য ম্যান হু কাউন্টেড তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই। ২০০১ সালেই বইটির ৫৪তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।