প্রতিসাম্য, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান

অসলো, মে ২০০৮ সাল। সে বছর নরওয়ের রাজা হ্যারল্ড গণিতবিদ জন থম্পসন ও জ্যাকুস টিটসকে গণিতের রাজ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানীয় অ্যাবেল পুরস্কার দেন। ওই পুরস্কারের মধ্যে একধরনের মজার প্রতিসাম্য ছিল। যে প্রজেক্টের জন্য তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, সেটি শুরু করেছিলেন উনিশ শতকের নরওয়েজিয়ান গণিতবিদ নিলস অ্যাবেল। তাঁর নামানুসারেই এই অ্যাবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আর সেই প্রজেক্ট শেষ করার জন্য এই দুজনকে এবারের পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে গণিতবিদেরা মূলত প্রতিসাম্যের সংজ্ঞা জানতে চেয়েছিলেন।

প্রতিসাম্য বিষয়টি আসলে কী? অনেকেই আয়নায় মানুষের মুখের ডান-বাঁমে প্রতিসাম্যের কথা বলবেন। মানুষের মুখের চেয়ে তুষারকণার প্রতিসাম্য কিন্তু আরও বেশি। ভাবছেন, প্রতিসাম্য আবার বেশি-কম হয় নাকি? মানুষের মুখের বাঁ দিক আর ডান দিক একই রকম, ফলে আয়নায় দেখার সময় বাঁ দিক আর ডান দিক গেলেও দেখতে একই রকম লাগে। কিন্তু মানুষের মুখকে যদি আমরা উল্টে দিই, তাহলে কিন্তু দেখতে আর আগের মতো লাগবে না। তবে একটি তুষারকণাকে আপনি উল্টে দিলেও সেটি দেখতে আগের মতোই লাগবে। এ শুধু তাই প্রতিবার ৬০ ডিগ্রি ঘোরানোর পর তুষারকণাটি দেখতে আবার আগের মতোই লাগবে। অর্থাৎ মানুষের মুখের চেয়ে তুষারকণার প্রতিসাম্য আরও বেশি। তুষারকণা বা কোনো বস্তুর চেয়ে সাধারণ কোনো জ্যামিতিক আকৃতির মধ্যে আরও বেশি প্রতিসাম্য থাকা সম্ভব। একটি বৃত্তকে আমরা যে কোণেই ঘোরাই না কেন, দেখতে আগের মতোই লাগবে। তাই বলা যায়, প্রতিসাম্য হলো এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যেখানে কোনো পরিবর্তন করা হলেও পরিবর্তনের পর কোনোভাবে সেটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আরও অনেক ধরনের প্রতিসাম্য থাকা সম্ভব?

আমাদের কাছে প্রতিসাম্যের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা আছে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের থম্পসন এবং কলেজ ডি ফ্রান্সের টিটস আমাদের এমন একটি চূড়ান্ত ধারণা দিয়েছেন। একে আমরা প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণি বলতে পারি। প্রতিসাম্যের ক্ষেত্রে এই ধারণা রসায়নের পর্যায় সারণির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে বস্তুর জটিল গাণিতিক প্রতিসাম্য বোঝার একটি উপায় বের হয়েছে।

একটি বস্তুর বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা ওই বস্তুর আকৃতির প্রতিসাম্য থেকে বলা যায়। একটি স্ফটিক কত রকম হতে পারে, তা জানার জন্য রসায়নবিদের মূল চাবিকাঠি হলো প্রতিসাম্য। এর থেকে রসায়নবিদেরা কোনো স্ফটিকের অজানা গঠন সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। জীববিজ্ঞানীদের কাছেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি ভাইরাসের কাজ করার পদ্ধতি কেমন হবে, তা ভাইরাসটির প্রতিসাম্য থেকেই বোঝা সম্ভব। এমনকি বড় বড় পার্টিক্যাল কলাইডারে পদার্থবিজ্ঞানীরা যেসব কণিকা আবিষ্কার করেছেন, প্রতিসাম্যতা না জানলে তাদের চরিত্র বোঝা কঠিন।

প্রতিসাম্যের ধারণা সেই প্রাচীন সভ্যতাগুলোকেও সম্মোহিত করে রেখেছিল। কিন্তু উনিশ শতক পর্যন্ত আমরা এর গাণিতিক রূপ বোঝার মতো ভাষা তৈরি করতে পারিনি। এই ভাষা আমাদের প্রতিসাম্যকে আলাদা করে শিখতে এবং এর গাঠনিক উপাদানগুলো আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে।

পদার্থের অণুকে যেমন পরমাণুর মতো ছোট কণিকায় ভেঙে ফেলা যায়, আবার ৩, ৫, ৭-এর মতো কিছু অবিভাজ্য মৌলিক সংখ্যা দিয়ে যেমন যেকোনো সংখ্যা তৈরি করা যায়, তেমনি অ্যাবেলের সময়কার গণিতবিদেরা আবিষ্কার করেন, কোনো প্রতিসম বস্তুকেও কিছু অবিভাজ্য প্রতিসম আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায়। তাঁরা এর নাম দেন ‘সাধারণ গ্রুপ’। এগুলো হলো প্রতিসাম্যের পরমাণু। অ্যাবেলের সমসাময়িক গণিতবিদেরা আবিষ্কার করেন, কিছু সাধারণ গ্রুপের পেছেনে কাজ করছে কিছু মৌলিক সংখ্যা। বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা একটি ১৫ বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ নিচ্ছি। এর ভেতরে থাকা একটি পঞ্চভুজ ও একটি ত্রিভুজের প্রতিসাম্য থেকেই আমরা এর প্রতিসাম্যতা তৈরি করতে পারব। এটি কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য চিন্তা করুন, আমরা এই বহুভুজটিকে পূর্ণ ঘূর্ণনের ১৫ ভাগের ১ ভাগ ঘোরাব। এতে বহুভুজটি আগের আকৃতি ফিরে পাবে। এই কাজটি এবার আমরা একটু ভিন্নভাবে করব। এর জন্য আমাদের প্রথমে বহুভুজটিকে পূর্ণ ঘূর্ণনের ৫ ভাগের ২ ভাগ ঘোরাতে হবে এবং তারপর এর উল্টো দিকে ৩ ভাগের ১ ভাগ ঘোরাতে হবে। দুবারই কিন্তু একই ফল পাওয়া যাবে, কারণ ১/১৫ = ২/৫ - ১/৩। এই বহুভুজটির ভেতর লুকিয়ে থাকা একটি ত্রিভুজ ও পঞ্চভুজের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে।

আসলে দ্বিমাত্রিক ও নিয়মিত আকৃতির যেকোনো বহুভুজের প্রতিসাম্যকে কতগুলো মৌলিক বাহুবিশিষ্ট আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায়। যেহেতু ১০৫ = ৫×৩×৭, তাই ১০৫ বাহুবিশিষ্ট কোনো বহুভুজের প্রতিসমতা একটি ত্রিভুজ, পঞ্চভুজ ও সপ্তভুজ দিয়ে তৈরি করা যাবে। থম্পসন প্রয়াত গণিতবিদ ওয়াল্টার ফেইটের সঙ্গে প্রমাণ করেন, যে আরও অসংখ্য বস্তুর প্রতিসাম্যকে মৌলিক সংখ্যার বাহুবিশিষ্ট আকৃতি থেকে তৈরি করা যায়। এই প্রমাণটি সাধারণ দ্বিমাত্রিক বহুভুজ ছাড়াও বহু ধরনের আকৃতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। গঠন যতই জটিল হোক না কেন, শুধু প্রতিসাম্যের সংখ্যাটি জানতে পারলেই একে হিসাব করা যাবে। তত্ত্বটি একটি প্রতিসাম্যের জগেক বোঝার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি এটি দেখতেও ছিল বিশাল। এটি লিখতে লেগেছিল ২৫৫ পাতা। এটি ছিল সেই সময় পর্যন্ত প্রকাশিত সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই বিশাল উপপাদ্যটি বেজোড় ক্রমতত্ত্ব বলে পরিচিত।

এই মৌলিক সংখ্যার বাহুবিশিষ্ট বহুভুজগুলো হলো গণিতবিদদের প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণির প্রথম উপাদান। কঠিন একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে উনিশ শতকের গণিতবিদেরা সম্পূর্ণ অজানা গঠনের কিছু জ্যামিতিক আকৃতির কথা জানতে পারেন। কোনো সমীকরণের মধ্যে x2, x3, x4 জাতীয় রাশি থাকলে তা সমাধান করার সূত্রগুলো ওই সময়ের গণিতবিদেরা জানতেন। কিন্তু x5 + 6x + 3 = 0 -এর মতো সমীকরণ, অর্থাৎ x-এর ঘাত যদি ৫ হয়, তবে সেটা সমাধান করার কোনো উপায় তাঁরা জানতেন না।

ওই সময় অ্যাবেল এ সমস্যাটি নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন। আর তিনি আবিষ্কার করলেন, এই ফর্মুলার সমাধান আসলে কোনো সমাধানই নেই! কেন এমনটি ঘটে, সেটা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন ফরাসি তরুণ গণিতবিদ এভারিস্তে গ্যালইস। তিনি ধারণা দিলেন, প্রতিটি সমীকরণের পেছনে একটি প্রতিসম বস্তু কাজ করছে! সমীকরণের পেছনে যে প্রতিসাম্য কাজ করছে, তার প্রথম ধারণা পাওয়া যায় x2 = 4-এর মতো দ্বিঘাত সমীকরণগুলো থেকে। আমরা সবাই জানি, এই সমীকরণের দুটি সমাধান, x = 2 ও x = -2। এই সমাধান দুটি একে অন্যের দর্পণ প্রতিবিম্ব। একটি ত্রিঘাতী সমীকরণের তিনটি সমাধান—একটি ধনাত্মক, একটি ঋণাত্মক আর অন্যটি কাল্পনিক সংখ্যা। এই সমীকরণগুলো একটি ত্রিভুজের প্রতিসাম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। চতুর্ঘাতী সমীকরণের সমাধান হয় মোট চারটি, আর এগুলো একটি টেট্রাহ্যাড্রোন বা চতুস্তলকের প্রতিসাম্যের সঙ্গে যুক্ত। চারটি সমবাহু ত্রিভুজকে জুড়ে দিলে আমরা যে ত্রিমাত্রিক কাঠামোটি পাব, সেটাই টেট্রাহ্যাড্রোন।

গ্যালইস দেখতে পেলেন, কোনো সমীকরণের পেছনে ঠিক যে জ্যামিতিক বস্তুর প্রতিসাম্য কাজ করছে, সেই বস্তুটিকে যদি মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট কতগুলো আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে সেই সমীকরণের সমাধান থাকবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে বুঝতে হবে যে এর কোনো প্রতিসাম্য নেই। সমীকরণের সমাধানের সঙ্গে প্রতিসাম্যের এই অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ থেকেই প্রথম বোঝা গিয়েছিল যে প্রতিসাম্য এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, যার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে প্রতিসাম্যের কোনো মিলই নেই!

পঞ্চঘাতী সমীকরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গ্যালইস দেখলেন, এর সমাধানের মূলে রয়েছে একটি ডোডেকাহ্যাড্রোন বা দ্বাদশতলকের প্রতিসাম্য। ১২টি পঞ্চভুজকে জুড়ে দিলে যে ত্রিমাত্রিক কাঠামো পাওয়া যায়, সেটাকে দ্বাদশতলক বলা হয়। একটি দ্বাদশতলককে যেহেতু কয়েকটি মৌলিক বাহুবিশিষ্ট আকৃতিতে ভেঙে ফেলা যায় না, তাই পঞ্চঘাতী সমীকরণের কোনো সমাধানও নেই। একটি দ্বাদশ তলককে মোট ৬০ ভাবে ঘোরানো সম্ভব; এসব ক্ষেত্রে ঘোরানোর পরও একে ঠিক আগের মতো দেখা যাবে। অর্থাৎ দ্বাদশতলকের ৬০টি ঘূর্ণন প্রতিসাম্য আছে। ৬০ সংখ্যাটিকে অনেকভাবে ভাগ করা যায়, কিন্তু ১০৫-কে যেমন ৩, ৫ ও ৭-এর মতো তিনটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল হিসেবে দেখাতে পেরেছিলাম, ৬০-কে সেভাবে ভাঙা যায় না।

দ্বাদশতলকের সঙ্গে ত্রিভুজ ও সপ্তভুজের মতো মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট আকৃতির মিল পাওয়ার পর গণিতবিদেরা এমন আর কী কী পাওয়া যায়, সেটা খুঁজে বের করতে শুরু করলেন। কিন্তু এবার তাঁরা একটু ভিন্ন পথে চেষ্টা করলেন। দেখা গেল, বস্তুর ঘূর্ণন বা প্রতিফলনের সঙ্গে তাস শাফল করার একটা অদ্ভুত মিল আছে। একটি চতুস্তলকের সাহায্যেই আমরা ব্যাপারটা ভালোমতো বুঝতে পারব। চতুস্তলকে যদি এর ত্রিভুজ তলের ওপর রাখা হয়, তবে এটাকে ১২ ভাবে ঘোরানো সম্ভব। এবং প্রতিবার চতুস্তলকটি ঘোরানো হলেও একে আবার আগের মতো দেখা যাবে। অর্থাৎ এর ১২টি ঘূর্ণন প্রতিসাম্য রয়েছে। পাশাপাশি এর ১২টি প্রতিফলন প্রতিসাম্য রয়েছে।

এবার আমরা যদি চতুস্তলকের প্রতিটি তলের ওপর একটি করে ইস্কাপনের টেক্কা, রাজা, রানি ও গোলাম সেঁটে দিই এবং তারপর এটাকে ঘোরাই, তাহলে এই ঘোরানো আর চারটি কার্ড শাফল করা দেখতে একই মনে হবে। এভাবে চার কার্ডের শাফল করলে এটি ২৪ সমাবেশের যেকোনো একটি রূপ নিতে পারে। আর চতুস্তলকের মোট প্রতিসাম্য আছে ১২+১২=২৪। ফলে দুটোর ফল একই রকম হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি একটা দ্বাদশতলক ৬০টি প্রতিসাম্য ও ৫টি কার্ডের শাফল করার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

এই শাফল পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, ত্রিমাত্রিক কাঠামোর সংখ্যা সীমিত হলেও আমরা কার্ডের সংখ্যা বাড়িয়ে আরও অনেক অজানা গঠনের প্রতিসাম্য বানাতে পারি। গণিতবিদেরা কার্ড শাফল করার পদ্ধতি জানার পর দেখা গেল, ডোডেকাহ্যাড্রোনই একমাত্র আলাদা বৈশিষ্ট্যের বস্তু নয়, বরং এর মতো আরও অসংখ্য বস্তু রয়েছে। মৌলিকসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট গ্রুপগুলোর মতো প্রতিসাম্যের পর্যায় সারণিতে এরাও নতুন ধরনের গ্রুপ হিসেবে যোগ হলো। এদের আমরা শাফল গ্রুপ বলেও ডাকতে পারি।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ওষুধবিজ্ঞান বিভাগ, গণবিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত