আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—সফলতার সমীকরণ কী? জবাবটি দিতে সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণ প্রণয়নের মতো সুদীর্ঘ ১০ বছর লাগেনি তাঁর। একটু ভেবেই চটপট জবাব দিয়েছিলেন তিনি: A = x+y+z। এটিই সফলতার সমীকরণ। A যদি সফলতা হয় তাহলে x হচ্ছে কাজ, y হচ্ছে খেলাধুলা আর z হচ্ছে মুখ বন্ধ রাখা। আইনস্টাইনের এই সমীকরণটা তেমন পরিচিত না হলেও তাঁর ভর ও শক্তির সম্পর্কবিষয়ক সমীকরণ E = mc2 বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সমীকরণগুলোর অন্যতম। এমনকি যাঁরা বিজ্ঞান বোঝে না তাঁদের অনেকেই এই সমীকরণটির কথা জানেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সমীকরণ কী ও কেন?
সমীকরণ হচ্ছে গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রাণভোমরা। সমীকরণ ছাড়া আমাদের এই বিশ্বের অস্তিত্ব হয়তো বর্তমানের মতো থাকত না। অবশ্য ভয়ংকর হিসেবেও সমীকরণের বেশ সুনাম (নাকি বদনাম!) আছে। স্টিফেন হকিংকে তাঁর প্রকাশক একবার বলেছিলেন, একেকটি সমীকরণ A Brief History of Time (সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) বইটির বিক্রি অর্ধেক কমিয়ে দেবে। তারপরও সেটি উপেক্ষা করে ওই বইটিতে হকিংকে একটিমাত্র সমীকরণ E = mc2 ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁরা। ওই প্রকাশকের যুক্তি ছিল, সমীকরণটি ব্যবহার না করলে বইটি হয়তো আরও অন্তত ১০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হতে পারত। কিন্তু হকিং এই সমীকরণটি কিছুতেই বাদ দিতে পারেননি তাঁর বইটি থেকে। যতই জটিল বা কঠিন মনে হোক না কেন সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাদের আড়াল করা যায় না। তবে হকিংয়ের বইটির প্রকাশকদেরও যুক্তি ছিল: সমীকরণ রসকষহীন, দেখতেও বেশ জটিল মনে হয়। কামানের গোলার মতো পাঠকদের দিকে বারবার সমীকরণ ছুড়ে দেওয়া হলে যারা সমীকরণ পছন্দ করে তারাও একসময় বিরক্ত হতে বাধ্য।
আমাদের বর্তমানের পরিচিত এই বিশ্ব গড়ে তুলতে বিভিন্ন সমীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানচিত্র তৈরি থেকে কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ন্ত্রণ, সংগীত থেকে টেলিভিশন, আমেরিকা আবিষ্কার থেকে বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদগুলোতে অভিযান—সব ক্ষেত্রেই রয়েছে সমীকরণের অবদান। সৌভাগ্যক্রমে, একটি সুন্দর ও তাত্পর্যপূর্ণ সমীকরণের কাব্যময়তা ও সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট বা খুব মেধাবী হওয়ার দরকার নেই।
গণিতে দুই ধরনের সমীকরণ আছে। বাইরে থেকে এদের দেখতে প্রায় একই রকম বলেই মনে হয়। এদের মধ্যে একধরনের সমীকরণ বিভিন্ন গাণিতিক পরিমাণের মধ্যকার সম্পর্ক প্রকাশ করে: এর কাজ হচ্ছে সমীকরণটি যে সত্যি সেটি প্রমাণ করা। অন্য সমীকরণগুলো একটি অজানা পরিমাণ সম্পর্কে তথ্য জোগান দেয়। একে সমাধান করে অজানাকে জানাই গণিতবিদদের কাজ। তবে এই দুইয়ের বিভেদরেখাটি স্পষ্ট নয়। কারণ মাঝেমধ্যে একই সমীকরণ দুভাবেই ব্যবহার হতে পারে।
বিশুদ্ধ গণিতের সমীকরণগুলো সাধারণত প্রথম শ্রেণির হয়ে থাকে: তারা গভীর আর সুন্দর সব প্যাটার্ন আর প্রতিসাম্য প্রকাশ করে। এসব সমীকরণ সঠিক, কারণ এদের জন্য গণিতের যুক্তিপূর্ণ গঠন সম্পর্কে আমরা মৌলিক অনুমান করতে পারি। এর কোনো বিকল্প নেই। যেমন পিথাগোরাসের উপপাদ্য। এটি একটি সমীকরণ, যা জ্যামিতির ভাষায় প্রকাশিত। আপনি যদি ইউক্লিডের জ্যামিতির মৌলিক অনুমান স্বীকার করে নেন, তাহলে পিথাগোরাসের উপপাদ্য সত্যি।
ব্যবহারিক গণিত ও গাণিতিক পদার্থবিদ্যার সমীকরণগুলো সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণির। এসব সমীকরণে বাস্তব পৃথিবী সম্পর্কে কিছু তথ্য সংকেত দিয়ে প্রকাশ করা হয়। তারা মহাবিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম প্রকাশ করে, যা তাত্ত্বিকভাবে বেশ ভিন্ন হতে পারে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এ ক্ষেত্রে একটি ভালো উদাহরণ। এ সূত্রটি বলে, ভরের ওপর ভিত্তি করে দুটি বস্তুর পরস্পরের মধ্যে কীভাবে আকর্ষণ বল কাজ করে এবং বস্তু দুটি কত দূরে অবস্থিত। এ সমীকরণ সমাধান করে আমরা জানতে পারি, গ্রহগুলো কীভাবে সূর্যের চারপাশে পাক খাচ্ছে কিংবা একটি মহাকাশযানের বঙ্কিম পথ কীভাবে ডিজাইন করতে হবে। কিন্তু নিউটনের সূত্রটি কোনো গাণিতিক উপপাদ্য নয়, এটি প্রাকৃতিক কারণেই সত্যি। কারণ এটি পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ঠিক ঠিক মিলে যায়। তবুও মহাকর্ষ সূত্র হয়তো ভিন্ন রকম হতেও পারে। সত্যি বলতে কী, এটি আসলেই অন্য রকম। কারণ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব নিউটনের সূত্রের চেয়ে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অনেক ভালোভাবে খাপ খায়। তারপরও দৈনন্দিন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কাজে (যেমন: মহাকাশে রকেট পাঠাতে) নিউটনের সমীকরণগুলোই ব্যবহার করা হয়। কারণ এর সহজবোধ্যতা।
বিশ্ব ইতিহাসে একেক নেতা যেমন ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছেন, তেমনি একেকটি সমীকরণের কারণেও মানুষের ইতিহাসের গতিপথ বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। সমীকরণের মধ্যে গোপনীয় শক্তি আছে। তারা প্রকৃতির গভীর কোনো রহস্য উন্মোচন করতে পারে। প্রচলিত রীতিতে ইতিহাসবিদেরা যেভাবে কোনো সভ্যতার উত্থান-পতন নির্ণয় করেন, এটি সে রকম নয়। রাজা ও রানি এবং যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়েই ইতিহাসের বইগুলো ভরা থাকে। কিন্তু তাতে সমীকরণের কোনো স্থান নেই। এটি অনৈতিক। ভিক্টোরিয়া যুগে, বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে চুম্বক ও বিদ্যুতের মধ্যে সম্পর্ক দেখাতে লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটে দর্শকদের সামনে প্রমাণ হাজির করেছিলেন। কথিত আছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন প্রশ্ন করেছিলেন, এ থেকে ব্যবহারিক কোনো ফল পাওয়া যাবে কি না। এ কথার উত্তরে ফ্যারাডে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, স্যার। একদিন আপনিই এতে কর বসাবেন।’
তিনি যদি সত্যিই সে কথা বলে থাকেন, তাহলে মোটেও ভুল বলেননি। চুম্বক ও বিদ্যুতের বিভিন্ন পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পাওয়া সূত্রগুলোকে বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলবিষয়ক কয়েকটি সমীকরণে রূপান্তর করেছিলেন। তার ফল হিসেবেই রেডিও, রাডার ও টেলিভিশন উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে।
একটি সমীকরণ সাধারণ উত্স থেকে শক্তি পায়। এর বক্তব্য হচ্ছে, দুটি গণনা, যাদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে, তাদের উত্তর আসলে একই। এ ক্ষেত্রে সমান চিহ্ন (=) প্রধান সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ গাণিতিক সংকেতের উত্পত্তি এত আগে যে সেগুলোর উত্পত্তি এখনো রহস্যজনক। আর তাদের আবিষ্কারকের নামও অজানা। আর কিছু সমীকরণের উত্পত্তি এতই সাম্প্রতিক যে সেগুলোর উত্পত্তি নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সমান চিহ্ন একটু ব্যতিক্রম বলা যায়। কারণ এটির উত্পত্তি প্রায় ৪৫০ বছর আগে। এর উদ্ভাবক ছিলেন ব্রিটিশ গণিতবিদ রবার্ট রেকর্ড। ১৫৫৭ সালে The Whetstone of Witte বইটিতে তিনি এ চিহ্নটি ব্যবহার করেছিলেন। বিরক্তিকরভাবে বারবার সমান সমান শব্দটির পুনরাবৃত্তি এড়াতে তিনি দুটি সমান্তরাল রেখা ব্যবহার করেছিলেন (অবশ্য তিনি সেকেলে শব্দ মবসড়বি ব্যবহার করেছিলেন, যার অর্থ যমজ)। এটি বেছে নেওয়ার কারণ এর মাধ্যমে দুটি জিনিসকে অনেক ভালোভাবে এক সমান বোঝানো যায়। রবার্ট রেকর্ডের পছন্দ ভালোই বলতে হবে। কারণ তাঁর চিহ্ন সুদীর্ঘ ৪৫০ বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
সমীকরণের শক্তি লুক্কায়িত থাকে মানুষের মনের সমন্বিত সৃষ্টি অর্থাৎ গণিত ও বাহ্যিক বাস্তবতার মধ্যে দার্শনিক জটিল ঐক্যে। বাহ্যিক বিশ্বে গভীর নকশার প্রতিরূপ হচ্ছে সমীকরণ। সমীকরণের তাত্পর্য জেনে এবং তাদের ভেতরের গল্প পড়ে আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করতে পারি আমরা। অবশ্য নীতিগতভাবে, একই ফল পেতে আরও অনেক রকম পথও থাকতে পারে। অনেক মানুষই সংকেতের চেয়ে শব্দ বা ভাষা বেশি পছন্দ করে, যা আমাদের পারিপার্শ্বিকের ওপর কর্তৃত্বের শক্তি দেয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুক্তি অনুযায়ী, বাস্তবতার নিরিখে কোনো কিছুর গভীরে প্রবেশ করার জন্য শব্দ যথার্থ নয় এবং এদের সীমাবদ্ধতাও আছে। মানবিক পর্যায়ে অনুমানের ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি রঙিন। শুধু শব্দ একা প্রয়োজনীয় অন্তর্দৃষ্টির জোগান দিতে পারে না। কিন্তু সমীকরণ তা পারে। কয়েক হাজার বছর ধরেই সমীকরণ মানবসভ্যতার প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। ইতিহাসের আগাগোড়ায় সমীকরণ সমাজের বন্ধন হিসেবে কাজ করেছে। মূল দৃশ্যপটের আড়ালে থাকলেও সমীকরণের প্রভাব সব সময়ই ছিল এবং থাকবে। সেই প্রভাব কারও চোখে পড়ুক আর না-ই পড়ুক।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: ইন পারসুট অব আননোন: সেভেনটিন ইকুয়েশনস দ্যাট চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড/ ইয়ান স্টুয়ার্ট
*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত