সুডোকু এল কেমন করে?

সুডোকু আসলে একটি লজিক্যাল পাজল বা ধাঁধা। গণিতের মাধ্যমে এর সমাধান করা হয়। না, গণিতের কথা শুনেই ভয় পাবেন না। গণিতের খুব সাধারণ বিষয়—সংখ্যা নিয়ে এর খেলা। তাও আবার ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা।

শুক্রবার। ছুটির সকাল। বসে আছেন আরাম করে। সঙ্গে আছে চা, বিস্কুট আর পত্রিকা। কিছুক্ষণ সংবাদপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে আর ভালো লাগছে না। একটু মোবাইলে ঢুঁ মারলেন। না, পড়ার বা করার মতো যুতসই কিছু পাচ্ছেন না। হঠাৎ আপনার চোখে পড়ল পত্রিকায় ছাপানো সুডোকু। ভাবলেন, দেখিই না একটু মিলিয়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। কলম বা পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লেন। মিনিটের পর মিনিট শেষ হয়ে যাচ্ছে, আপনি বুঁদ হয়ে আছেন সুডোকুতে। হ্যাঁ, সুডোকু এরকমই এক মজার পাজল। বর্তমানে দেশের বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় সুডোকু স্থান করে নিয়েছে। গুগলে সুডোকু লিখে সার্চ করলে প্রায় ২০ কোটি রেজাল্ট ভেসে উঠবে স্ক্রিনে। পুরো বিশ্বজুড়েই সুডোকুর জয়জয়কার। আন্তর্জাতিকভাবেও নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে সুডোকু প্রতিযোগিতা। সংবাদপত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে সুডোকু ছাপানো হয়। পাওয়া যায় সুডোকুর বইও। তবে বাংলায় সুডোকুর বই হাতেগোণা, নেই বললেই চলে। এ ছাড়া অনলাইনে, ওয়েবসাইটে বা অনেক অ্যাপের মাধ্যমে সুডোকু মেলানোর সুযোগ তো আছেই।

একবার সুডোকু মেলানোর মজা আপনাকে পেয়ে বসলে আর রক্ষা নেই। বারবার শুধু সুডোকুই মেলাতে ইচ্ছা করবে। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে অস্ট্রেলিয়ার একটা ঘটনা বলি। ২০০৮ সালের কথা। অস্ট্রেলিয়ার ৫ বিচারককে ১০ লাখ ডলার জরিমানা করেছিল সে দেশের সরকার। বিচারকদের অপরাধ কী? বাদী-বিবাদীর কথা না শুনে সুডোকু মেলাচ্ছিলেন ওই পাঁচ বিচারক। বুঝুন তাহলে! কিন্তু এই মজার সুডোকু এল কীভাবে। কোথায় উৎপত্তি সুডোকুর? চলুন, এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে সংক্ষেপে জেনে নিই, সুডোকু কী।

সুডোকু আসলে একটি লজিক্যাল পাজল বা ধাঁধা। গণিতের মাধ্যমে এর সমাধান করা হয়। না, গণিতের কথা শুনেই ভয় পাবেন না। গণিতের খুব সাধারণ বিষয়—সংখ্যা নিয়ে এর খেলা। তাও আবার ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা। সুডোকুতে মোট ৮১টি বর্গাকার ঘর থাকে। ঘরগুলোর মধ্যে আছে ৩×৩ আকারের ৯টি বর্গ। এর প্রত্যেকটি বর্গে আবার আছে ৯টি করে বর্গাকার ঘর। মানে একটি ৯×৯ বর্গের সুডোকুতে মোট ৮১টি বর্গাকার ঘর থাকে। এই ঘরগুলোর মধ্যে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো বসাতে হয়। প্রতি সারি, কলাম ও ৩×৩ বর্গে ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো মাত্র একবারই বসে।

সুডোকু সমাধানের নানা কৌশল নিয়ে পরের কোনো লেখায় বলব। এ লেখায় এর নিয়মগুলো একটু জেনে নিই।  

একটি ৯×৯ বর্গের সুডোকু

ওপরের ছবিটি ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝবেন, এখানে একটি ৯×৯ বর্গের সুডোকু আছে। প্রতিটি লাইন ও কলামে ৯টি ঘর আছে। এ ছাড়া প্রতি ৯টি ঘর নিয়ে আবার একেকটি ৩×৩ উপবর্গ তৈরি হয়েছে। এখানকার কোনো লাইন বা কলামে ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো একাধিকবার বসানো যাবে না। অর্থাৎ, এক লাইনে ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো একবারই বসবে। এই শর্ত প্রতিটি ৩×৩ উপবর্গের জন্যও প্রযোজ্য।

ওপরের চিত্রে দেখতে পাচ্ছেন, কিছু বর্গাকার ঘর সংখ্যা দিয়ে পূর্ণ, আর কিছু ফাঁকা। এই ফাঁকা ঘরেই ১-৯ পর্যন্ত বাকি সংখ্যাগুলো বসাতে হবে। একই সারি বা কলামে একই সংখ্যা যেমন দুইবার বসানো যাবে না, তেমনি ১-৯ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সংখ্যা অবশ্যই একবার বসাতে হবে। ৯×৯ বর্গের সুডোকু ছাড়াও ৩×৩, ১৬×১৬ বর্গসহ আরও নানা ধরনের সুডোকু হয়। তবে ৯×৯ বর্গের সুডোকুই বেশি জনপ্রিয়।

সুডোকুর ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৭৮৩ সালে ল্যাটিন স্কয়ার বা লাতিন বর্গ উদ্ভাবন করেন সুইডিশ গণিতবিদ লিওনার্ড অয়লার। এর নাম দিয়েছিলেন ‘একটি নতুন ধরনের জাদুর বর্গ’। ধারণা করা হয়, এই লাতিন বর্গ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে সুডোকুর। তবে অয়লারের এই ল্যাটিন স্কয়ার আলাদা ৯টি বর্গাকার ঘরে ভাগ করা ছিল না। শুধু সারি ও কলাম ছিল। ল্যাটিন স্কয়ারে সংখ্যার পরিবর্তে প্রতীকও ব্যবহার করা হতো। সুডোকুর মতোই কিছু ঘর সংখ্যা বা প্রতীক দিয়ে পূর্ণ থাকত, আর বাকি ঘরগুলো নিজেদের পূরণ করতে হতো। এর প্রায় দুই শতাব্দী পরে সুডোকুকে ৯টি বর্গে ভাগ করা হয়।

সুইডিশ গণিতবিদ লিওনার্ড অয়লার

১৯ শতকের শেষদিকে সংবাদপত্রে সংখ্যার ধাঁধা প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৮৯২ সালের ১৯ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসের লে সিকেল নামের একটি দৈনিক পত্রিকা ৯×৯ বর্গের একটি ম্যাজিক স্কয়ারের আংশিক পূরণ করে প্রকাশ করে। এতে ৩×৩ উপবর্গও ছিল। আসলে এটি সুডোকু ছিল না। কারণ, এতে দুই অঙ্কের সংখ্যা বা ডাবল ডিজিট ব্যবহার করা হয়েছিল। তা ছাড়া, এটা সমাধানের জন্য যুক্তির চেয়ে গণিতের প্রয়োগ ছিল বেশি। তবে প্রতিটি সারি, কলাম ও বর্গে একটি সংখ্যা একবারই ব্যবহার করা হয়েছিল।

১৮৯৫ সালের ৬ জুলাই লে সিকেল পত্রিকার প্রতিদ্বন্দী লা ফ্রান্স পত্রিকা ধাঁধাটিকে পরিমার্জন করে। তাদের সেই পরিমার্জিত নতুন সুডোকুর নাম দেওয়া হয় ‘ডায়াবোলিক ম্যাজিক স্কয়ার’। এটা প্রায় আধুনিক সুডোকুর মতোই। প্রতি সারি ও কলামে একটি সংখ্যা একবারই ব্যবহার করা হতো। সংখ্যাগুলোও ছিল ১-৯ পর্যন্ত। শুধু আধুনিক সুডোকুর মতো ৩×৩ উপবর্গ বা বর্গে ভাগ করা ছিল না। মানে ৯টি ব্লকে ভাগ করা ছাড়া বাকি সব আধুনিক সুডোকুর মতোই ছিল। এ ধরনের ধাঁধাগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত নিয়মিত ছাপা হতো পত্রিকায়। তবে বিশ্বযুদ্ধের কারণে এগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

আধুনিক সুডোকুর হাতেখড়ি হয় সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের কনার্সভিলে ৭৪ বছর বয়সী হাওয়ার্ড গার্নসের হাত ধরে। ১৯৭৯ সালে ছদ্মনামে ডেল ম্যাগাজিনে গার্নসের উদ্ভাবিত সুডোকু প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন একজন স্থপতি। ১৯৮৯ সালে হাওয়ার্ড গার্নস মারা যান। সুডোকু যে জনপ্রিয় হয়েছে, এটা তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু গার্নস কীভাবে এই সুডোকু উদ্ভাবন করেছিলেন, তা জানা যায়নি। আসলে ফ্রান্সের কোনো পত্রিকার সঙ্গে গার্নসের যোগাযোগ ছিল কি না, তা জানার কোনো উপায় ছিল না। অর্থাৎ গার্নস নিজেই এই সুডোকু উদ্বাবন করেছিলেন নাকি ফ্রান্সের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত ধাঁধা দেখে সেটার আধুনিকায়ন করেছেন, তা জানা সম্ভব হয়নি।

হাওয়ার্ড গার্নসের বিভিন্ন বয়সের ছবি
বিশ্বব্যাপী সুডোকুকে জনপ্রিয় করেছেন জাপানের মাকি কাজি

যাহোক, বিশ্বব্যাপী সুডোকুকে জনপ্রিয় করেছেন জাপানের মাকি কাজি। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে তিনি মাসিক নিকোলিস্ট পত্রিকায় সুডোকু প্রকাশ করতে শুরু করেন। মাকি কাজি ছিলেন নাকোলি পাজল কোম্পানির সভাপতি। আমরা যে সুডোকু শব্দটি ব্যবহার করছি, এটাও জাপানিজ শব্দ। ‘সুজি ওয়া দোকুশিন নি কাগিরু’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ সুডোকু। এর অর্থ, অঙ্কগুলো একবার করে বসবে। সুডোকুকে জনপ্রিয় করতে মাকি কাজি প্রায় ৬০টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সুডোকুর জয়জয়কার। সুডোকু বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করতে জাপান বড় ভূমিকা পালন করেছে। এ দেশটির ভূমিকা এবং জাপান থেকে কীভাবে সুডোকু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল, তা লিখব পরের পর্বে।  

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: উইকিপিডিয়া ও সুডোকু ডট কম