দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি - ১

মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।

অধ্যায় এক

মন্দিরের স্নিগ্ধ ছায়ায়

১. দক্ষিণ গঙ্গা

সারা জীবন তিনি একটা শব্দ শুনেছেন—ধীর, মাপা একটা ছন্দ। থপ... থপ... থপ...!

কাবেরী নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা পাথরের ওপর ভেজা কাপড় আছাড় মারার সেই চিরাচরিত শব্দ। রামানুজনের জন্ম হয়েছিল এই নদীর খুব কাছেই। তাই বলা যায়, কোলের শিশু থাকা অবস্থা থেকেই এই শব্দ তার কানে বেজেছে।

ধীরে ধীরে তিনি বড় হলেন। কখনো কলসি কাঁখে নদী থেকে পানি আনতে গিয়ে, কখনো গোসল করতে নেমে, আবার কখনো স্কুল শেষে নদীর বালুকাময় তীরে খেলতে গিয়ে তিনি এই শব্দই শুনতেন। বহু বছর পর বিলেত থেকে যখন দেশে ফিরলেন, তখন তিনি আর সেই চঞ্চল যুবক নন। জ্বরে জর্জরিত, অসুস্থ, মৃত্যুর খুব কাছাকাছি। কিন্তু সেই অন্তিম সময়েও তিনি শুনতে পেতেন সেই পরিচিত ছন্দ—থপ... থপ... থপ...!

রামানুজনের জীবনে কাবেরী নদী ছিল এক ধ্রুবতারার মতো। পরিচিত এবং সবসময় উপস্থিত। এই নদীর যাত্রাপথটা বড় অদ্ভুত। কোথাও দেখা যায় ফলের ভারে নুয়ে পড়া পাম গাছগুলো নদীর দিকে হেলে আছে, যেন নদীকে কুর্নিশ করছে। আবার কোথাও বিশাল সব গাছের ডালপালা মিলে নদীর ওপরে তৈরি করেছে এক সবুজ চাঁদোয়া। সেই গাছের জট পাকানো শিকড়গুলো সাপের মতো ছড়িয়ে আছে নদীর পাড়জুড়ে।

শ্রীনিবাস রামানুজন
ছবি: উইকিপিডিয়া
আরও পড়ুন
রামানুজনের জন্মশহর কুম্বকোনম, মাদ্রাজ থেকে ১৬০ মাইল দক্ষিণে। গোঁড়া ও ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ ভারতের ঠিক হৃৎপিণ্ড বলা চলে এই শহরকে।

বর্ষাকালে এই শান্ত নদীই আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তখন পানি বেড়ে যায় দশ, পনেরো, এমনকি বিশ ফুট পর্যন্ত! নদীর পাড়ে আপনমনে ঘাস চিবুতে থাকা গবাদিপশুও মাঝেমধ্যে সেই রাক্ষুসে স্রোতে ভেসে যায়। আবার শুকনো মৌসুম এলে সেই প্রলয়ঙ্করী রূপের কথা মনেই থাকে না। তখন নদী হয়ে যায় ধু-ধু বালুকাময় এক তটরেখা। তার মাঝখান দিয়ে গভীর খাত ধরে বয়ে চলে কাবেরীর শীর্ণ এক জলধারা।

কিন্তু রূপ যা-ই হোক, কাবেরী সবসময় ছিল। পশ্চিমের কুর্গ পাহাড় থেকে যার জন্ম, সেখান থেকে পাঁচশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো উপদ্বীপে। কোথাও বাঁধ দিয়ে, আবার কোথাও সেই দেড় হাজার বছর আগের পুরোনো খাল দিয়ে তার গতিপথ ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। আর এই যাত্রাপথে কাবেরী তার দুপাশের প্রান্তরকে রাঙিয়ে দিয়েছে সবুজে। রামানুজনের জগৎটাকে তৈরি করেছে এই একটি মাত্র সত্য, কাবেরীর ওই সবুজ স্পর্শ।

রামানুজনের জন্মশহর কুম্বকোনম, মাদ্রাজ থেকে ১৬০ মাইল দক্ষিণে। গোঁড়া ও ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ ভারতের ঠিক হৃৎপিণ্ড বলা চলে এই শহরকে। এ শহর তখন পরিচিত ছিল তাঞ্জোর জেলা নামে। কাবেরী আর তার এক উপনদী দুই পাশ থেকে আগলে রেখেছে এই শহরকে। পুরো তাঞ্জোর জেলার আয়তন প্রায় তিন হাজার সাতশো বর্গমাইল। এই বিশাল এলাকার অর্ধেকটাই সরাসরি ভিজেছে কাবেরীর জলে। প্রতি মাইলে মাত্র তিন ফুট করে ঢালু হয়ে নদীটি খুব ধীরে ধীরে সাগরের দিকে এগিয়েছে। যাওয়ার পথে বদ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে উর্বর পলিমাটি।

কাবেরী নদী
ছবি: উইকিমিডিয়া

কাবেরী এই অঞ্চলের জন্য ছিল এক অকৃপণ আশীর্বাদ। ১৮৫৩ সালের ভয়াবহ বন্যার কথাই ধরুন। বন্যায় পুরো বদ্বীপ তলিয়ে গিয়েছিল, ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু খুব কম মানুষই প্রাণ হারিয়েছিল। উল্টো এই বিশাল নদী আশেপাশের জমিকে এতই উর্বর করে রাখত যে, মৌসুমি বৃষ্টি ঠিকমতো না হলেও ফসলের ক্ষতি হতো না। ভারতের অন্যান্য জায়গা যেখানে বৃষ্টির খামখেয়ালিপনার ওপর ঝুলে থাকত, সেখানে ব্যতিক্রম ছিল তাঞ্জোর।

১৮৭৭ সাল। পর পর দুই বছর বৃষ্টি না হওয়ায় দক্ষিণ ভারতে ভয়াবহ খরা দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যায়। কিন্তু কাবেরীর আশীর্বাদে পুষ্ট তাঞ্জোর জেলায় সেই খরার আঁচড়টুকুও লাগেনি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছিল। দুর্ভিক্ষের কারণে শস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই বদ্বীপ অঞ্চলের কৃষকেরা অভূতপূর্ব ধনী হয়ে উঠেছিল!

আরও পড়ুন
কাবেরী ছিল আত্মার শুদ্ধির জায়গা; ছিল ফসলের প্রাচুর্যের উৎস। প্রতিদিন সকালে এখান থেকেই মানুষ খাবার পানি নিত, গোসল করত।

তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, উত্তরের গঙ্গার মতোই দক্ষিণের কাবেরীও ভারতের পবিত্র নদীগুলোর একটি। পুরাণে আছে, কাবেরী মুনি নামে এক ঋষি ব্রহ্মার এক মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। বাবার প্রতি ভক্তি দেখিয়ে সেই মেয়ে নিজেকে নদীতে রূপান্তরিত করেন, যাতে তার জল ধুয়ে-মুছে দিতে পারে মানুষের সব পাপ। এমনকি এও বলা হয়, স্বয়ং মা গঙ্গা নাকি মাটির নিচের কোনো গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে মাঝেমধ্যে কাবেরীতে এসে মেশে। কেন জানেন? পাপী মানুষের পাপ ধুতে ধুতে গঙ্গা নিজেও যখন অপবিত্র হয়ে যায়, তখন নিজেকে শুদ্ধ করতে সে আসে এই কাবেরীর জলে।

দক্ষিণ গঙ্গা নামেই ডাকা হয় কাবেরীকে। আর এই নদীর কারণেই কাবেরী বদ্বীপ হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং ধনী এলাকা। এই অঞ্চলের পুরো জীবনটাই গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করে। এখানকার মানুষের অগাধ সম্পদ, আর সেই সম্পদের হাত ধরে আসা আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মূলেই ছিল কাবেরীর জল।

কাবেরী ছিল আত্মার শুদ্ধির জায়গা; ছিল ফসলের প্রাচুর্যের উৎস। প্রতিদিন সকালে এখান থেকেই মানুষ খাবার পানি নিত, গোসল করত। সাদা ধুতি আর পাগড়ি পরা পুরুষেরা তাদের গবাদিপশুকে পানি খাওয়াতে নিয়ে আসত এই নদীর অগভীর জলে।

আর সবসময় দেখা যেত সেই দৃশ্য। একদল নারী হাঁটুসমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের শাড়ির আঁচল বা সুতি কাপড়গুলো স্রোতের টানে রিবনের মতো সাপের ভঙ্গিতে পেছনে ছড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই তারা সেই ভেজা কাপড়গুলো জড়ো করে দলা পাকিয়ে নিচ্ছেন। তারপর সপাং করে আছাড় মারছেন নদীর বুকে জেগে থাকা পুরোনো পাথরের ওপর। ধীর, বিরামহীন সেই শব্দ... থপ... থপ... থপ...!

চলবে...