মুদ্রার যাদু

মাথা খাটাতে কে না পছন্দ করে! আর গল্পোচ্ছলে মজার বুদ্ধির ব্যায়াম হলে তো কথাই নেই। এরকমই একটি বই ‘অঙ্কের খেলা’। এটি রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলমানের নামকরা বই ‘ফিগারস ফর ফান: স্টোরিজ, পাজলস অ্যান্ড কোনান্ড্রামস’-এর বাংলা অনুবাদ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিমলেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে। সম্পাদক ছিলেন নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা।

অঙ্কের মজার সব হেঁয়ালি, বুদ্ধির খেলাসহ মাথা খাটানোর মতো দারুণ সব ধাঁধা নিয়ে বইটি। মগজে শান দিতে যা অতুলনীয়। এ বই পড়ে দেশের অনেকে এককালে গণিতে আগ্রহী হয়েছে, সমস্যা সমাধান শিখেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে গণিতের। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

আমার মনে পড়ছে, ছেলেবেলায় আমার দাদা আমাকে মুদ্রা দিয়ে একটা মজার খেলা দেখিয়েছিল। প্রথমে সে তিনটে প্লেট সারবন্দী করে সাজাল। তারপর বিভিন্ন মূল্যের পাঁচটা মুদ্রা বড় থেকে ছোট হিসেবে একটার ওপর আরেকটা রাখল (১ রুবল, ৫০ কোপেক, ২০ কোপেক, ১৫ কোপেক আর ১০ কোপেক* মুদ্রা)।

কাজটা হচ্ছে নীচের তিনটে নিয়ম মেনে মুদ্রাগুলোকে তৃতীয় প্লেটে চালান করা:

(১) একবারে মাত্র একটা মুদ্রা চালান করা যাবে; (২) ছোট মুদ্রার ওপর বড় মুদ্রা বসানো চলবে না আর (৩) প্রথম দুটো নিয়মমাফিক মাঝের প্লেটটাকে সাময়িকভাবে ব্যবহার করা চলবে। কিন্তু সবশেষে মুদ্রাগুলোকে আগের মতো করে তৃতীয় প্লেটেই সাজাতে হবে।

দাদা বলল, ‘বুঝলে, নিয়মটা খুবই সহজ। এবার শুরু কর।’

আমি ১০ কোপেক মুদ্রাটা নিয়ে তৃতীয় প্লেটে রাখলাম। তারপর ১৫ কোপেকটা নিয়ে রাখলাম মাঝের প্লেটে, তারপরই আটকে গেলাম। ২০ কোপেক মুদ্রাটা কোথায় রাখব? এটা তো দুটো থেকেই বড়।

দাদা আমাকে দেখিয়ে দিতে এগিয়ে এল, ‘আচ্ছা, ১০ কোপেকের মুদ্রাটা ১৫ কোপেক মুদ্রার উপরে বসাও। তাহলেই ২০ কোপেক মুদ্রাটার জন্য তৃতীয় প্লেটটা খালি পাবে।’

আমি তাই করলাম। কিন্তু আমার অসুবিধে এতেই শেষ হলো না। ৫০ কোপেক মুদ্রাটা কোথায় রাখব? অল্পসময়ের ভেতরই উপায়টা পেয়ে গেলাম। ১০ কোপেক মুদ্রাটাকে রাখলাম প্রথম প্লেটে, ১৫ কোপেকটা রাখলাম তৃতীয়টাতে, তারপর ১০ কোপেককে চালান করলাম সেখানে। এবারে ৫০ কোপেক মুদ্রাকে দ্বিতীয় প্লেটে রাখা সম্ভব হলো। তারপর অসংখ্য চাল দেওয়ার পর রুবলের মুদ্রাটাকে প্রথম প্লেট থেকে সরাতে পারলাম। তারপরেই সবকটা এসে গেল তৃতীয় প্লেটে।

আরও পড়ুন
ঠিক, এবার এর সঙ্গে আর একটা মুদ্রা যোগ করা যাক। ২০ কোপেকের মুদ্রা যোগ করার পর দেখা যাক মুদ্রার থাকটা চালান করতে কয়টা চাল লাগবে আমাদের। আমরা জানি এটা করতে লাগবে তিনটে চাল।

দাদা আমার এই সমাধানের কায়দাটাকে তারিফ করে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, মোট কতগুলো চাল দিলে তুমি?’

‘জানি না, গুনিনি তো আমি।’

‘আচ্ছা বেশ। হিসাব করা যাক। কীভাবে সবচেয়ে কম চাল দিয়ে এটা করা যায় তা জানতে খুব মজা লাগবে। ধরা যাক, আমাদের পাঁচটা না থেকে মাত্র দুটো মুদ্রাই ছিল: ১৫ আর ১০ কোপেক। তাহলে মোট কত চাল লাগবে তোমার?’

‘তিনটে। ১০ কোপেক মুদ্রাটা যাবে মাঝের প্লেটে, ১৫ কোপেক মুদ্রা যাবে তৃতীয়টাতে, তারপর ১০ কোপেক মুদ্রাটা যাবে এর ওপরে।’

‘ঠিক, এবার এর সঙ্গে আর একটা মুদ্রা যোগ করা যাক। ২০ কোপেকের মুদ্রা যোগ করার পর দেখা যাক মুদ্রার থাকটা চালান করতে কয়টা চাল লাগবে আমাদের। আমরা জানি এটা করতে লাগবে তিনটে চাল। তারপর ২০ কোপেকের মুদ্রাটি আমরা চালান করলাম তৃতীয় প্লেটে। এই আর একটা দান। তারপর দ্বিতীয় প্লেটটা থেকে মুদ্রা দুটোকে চালান দেওয়া হলো তৃতীয়টাতে। এই হলো আরও তিনটে চাল। তাহলেই আমাদের দিতে হবে: ৩ + ১ + ৩ = ৭টা চাল।’

‘চারটে মুদ্রার জন্য কটা চাল লাগবে তা হিসেব করে দেখা যাক,’ আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম।

‘প্রথমে ছোট তিনটে মুদ্রা চালান করলাম মাঝের প্লেটে। এতে হল সাতটা দান। তারপর ৫০ কোপেকের মুদ্রাটাকে সরিয়ে দিলাম তৃতীয় প্লেটে। এই হলো আরও একটা চাল। সবশেষে ছোট মুদ্রা তিনটিকে তৃতীয় প্লেটে চালান হলো। এই হলো আরও সাতটা চাল। সব মিলিয়ে হবে: ৭ + ১ + ৭ = ১৫টা চাল।’

আরও পড়ুন

‘চমৎকার। পাঁচটা মুদ্রায় কি হবে তাহলে?’

‘এ তো সোজা: ১৫ + ১ + ১৫ = ৩১। আমি চটপট উত্তর করলাম।’

‘বাঃ, ব্যাপারটা বেশ ধরে ফেলেছ তো! আমি তোমাকে এটা করার আরও একটা সোজা উপায় দেখাচ্ছি। ৩, ৭, ১৫ আর ৩১, যে যে সংখ্যা আমরা পেয়েছি সেগুলো ধরা যাক। এদের সবকটার অর্থ হল ২-কে ২ দিয়েই একবার বা বারবার গুণ করে তা থেকে ১ বিয়োগ দিলে যা হয়। এই দেখ না!’

তারপর আমার দাদা এই ছকটা লিখল:

৩ = ২ × ২ - ১

৭ = ২ × ২ × ২ - ১

১৫ = ২ × ২ × ২ × ২ - ১

৩১ = ২ × ২ × ২ × ২ × ২ - ১

দাদা আমাকে একটা মজার খেলা দেখিয়েছিল

‘এবার বুঝতে পেরেছি আমি, যতটা মুদ্রা আমাকে চালান করতে হবে ২-কে ততবার ২ দিয়েই গুণ করলাম। তারপর তা থেকে বিয়োগ করলাম ১। এবার তাহলে মুদ্রার থাক সরাতে কতবার চাল দিতে হবে তা হিসাব করা শিখলাম। ধরা যাক, আমাদের আছে সাতটা মুদ্রা। ব্যাপারটা এইরকম হবে তাহলে:

২ × ২ × ২ × ২ × ২ × ২ × ২ – ১ = ১২৮ – ১ = ১২৭।

আমার দাদা বলে চলল, ‘তুমি তাহলে এই পুরনো খেলাটা শিখলে। আর একটা মাত্র নিয়ম মনে রাখতে হবে তোমাকে: যদি মুদ্রার সংখ্যাটা বিজোড় হয় তাহলে প্রথম মুদ্রাটাকে রাখবে তৃতীয় প্লেটে, আর যদি জোড় হয় তাহলে প্রথম রাখবে দ্বিতীয় প্লেটে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘খেলাটা কি সত্যিই পুরনো? আমি তো ভেবেছিলাম এটা তোমার নিজের।’

আরও পড়ুন
‘নিশ্চয়ই, খুব বেশি সময় লাগবে না। যদি প্রত্যেকবার চালান করতে এক সেকেন্ড করে লাগে, তার মানে এক ঘণ্টায় একজন লোক ৩ হাজার ৬০০ বার ওগুলো সরাতে পারবে।’

‘না, আমি এটাকে মুদ্রা দিয়ে একটু আধুনিক করেছি মাত্র। খেলাটা খুবই পুরনো। সম্ভবত এটা ভারতবর্ষ থেকে এসেছে। এর সঙ্গে একটা মজার গল্প জড়িয়ে আছে। বারাণসীতে একটা মন্দির আছে। শোনা যায় ব্রহ্মা যখন পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, তখন সেখানে রেখেছিলেন তিনটে হীরের কাঠি। তারই একটাতে পরালেন ৬৪টা সোনার আংটা। তার সবচেয়ে বড়টা ছিল একেবারে নীচে, আর ছোটটা সবার ওপরে। পুরোহিতদের সারা দিনরাত ওই আংটাগুলোকে একটা কাঠি থেকে আর একটা কাঠিতে চালান করার কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। তৃতীয় কাঠিটা এই কাজে সাহায্য করত, নিয়ম-কানুন ছিল ঠিক আমাদের মুদ্রার খেলার মতো। একবারে একটা আংটাই সরানো যেত, আর কোন ছোট আংটার ওপর বড় আংটা বসানো চলত না। গল্পে আছে, যে দিন সব আংটা চালান করা শেষ হবে, সে দিনই পৃথিবীর শেষ।’

‘এ গল্পটা বিশ্বাস করলে তো পৃথিবী বহু আগেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।’

‘তুমি ভাবছ এভাবে ৬৪টা আংটা চালান করতে খুব বেশি দেরি হবে না, তাই না?’

‘নিশ্চয়ই, খুব বেশি সময় লাগবে না। যদি প্রত্যেকবার চালান করতে এক সেকেন্ড করে লাগে, তার মানে এক ঘণ্টায় একজন লোক ৩ হাজার ৬০০ বার ওগুলো সরাতে পারবে।’

‘বেশ তো!’

‘তাহলে একদিনে হবে প্রায় ১ লাখ বার আর দশদিনে হবে প্রায় ১০ লাখ বার। ১০ লাখ চাল দিয়ে তুমি ১০০০টা আংটা চালান করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।’

‘ভুল বললে তুমি। এই ৬৪টা আংটাকে চালান করতে তোমার লাগবে ৫০ হাজার কোটি বছর, এর একটুও কম বা বেশি নয়!’

‘কিন্তু তা হবে কেন? মোট চালের সংখ্যা হবে ২-কে ৬৪ বার ২ দিয়ে গুণ করে তা থেকে ১ বিয়োগ দিলে... তার মানে হলো... আচ্ছা একটু দাঁড়াও... এক সেকেন্ডের ভেতর উত্তরটা বলছি তোমাকে।’

‘বেশ, তুমি যতক্ষণে এই গুণটা করবে আমি অন্য কাজকর্ম করার প্রচুর সময় পাব ততক্ষণ।’

দাদা চলে গেলে আমি বসে গেলাম হিসেবটা করতে। প্রথমে ২-এর ফলটা বের করে ফেললাম, তা হলো ৬৫ হাজার ৫৩৬। এবার ওই সংখ্যাকে ওই সংখ্যা দিয়েই গুণ করলাম। যে ফল পেলাম তাকে আবার সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করলাম। পরে তা থেকে বিয়োগ করলাম ১। এতে যে সংখ্যাটা পাওয়া গেল, তা হলো:

১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১,৬১৫*

দাদা তাহলে ঠিকই বলেছিল।

এরই সঙ্গে আরও একটা জিনিস এসে পড়ছে। আমাদের পৃথিবীর বয়স কত তা হয়তো জানার ইচ্ছে হতে পারে তোমাদের। বৈজ্ঞানিকরা সেটা বের করেছেন। অবশ্য এটা একটা মোটামুটি হিসেব:

সূর্যের বয়স…………………৫,০০,০০০ কোটি বছর

পৃথিবীর বয়স…………………৩০০ কোটি বছর

পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব……১০০ কোটি বছর

মানুষের বয়স……………৩ লক্ষ বছরের কম নয়

* বিভিন্ন মাপের যেকোনো পাঁচটা মুদ্রা দিয়ে খেলা চলতে পারে।

* সংখ্যাটা আমাদের চেনা: দাবাখেলা আবিষ্কারের জন্য সেসা এই পুরস্কারই চেয়েছিলেন