মৌলিক সংখ্যার খোঁজে নতুন গাণিতিক সমীকরণ

গণিতের জগতে মৌলিক সংখ্যা নিয়ে গবেষণার ইতিহাস বহু শতাব্দীর পুরোনো। গণিতবিদেরা আজও এই রহস্যময় সংখ্যাগুলোর নতুন নিয়ম-কানুন খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মৌলিক সংখ্যা মানে এমন সব পূর্ণ সংখ্যা যেগুলো ১-এর চেয়ে বড় এবং শুধু সেই সংখ্যা ছাড়া আর কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় না। যেমন ২, ৩ ও ৫ হলো সবচেয়ে ছোট তিনটি মৌলিক সংখ্যা।

ছোট সংখ্যার ক্ষেত্রে মৌলিক কিনা তা বের করা খুবই সহজ। কিন্তু যখন সংখ্যাগুলো বড় হতে থাকে, তখন এই কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। ১০ বা ১০০০-এর মতো সংখ্যার জন্য এই পদ্ধতি চলতে পারে। কিন্তু লাখ বা কোটির অঙ্কের সংখ্যার জন্য এটি প্রায় অসম্ভব। কল্পনা করুন, এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় মৌলিক সংখ্যাটি প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ অঙ্কের! প্রথমে মনে হতে পারে এটি অসম্ভব রকমের বড়, কিন্তু যেহেতু অসংখ্য পূর্ণ সংখ্যা রয়েছে, তাই এটিও আসলে তুলনামূলকভাবে ছোট।

শুধু একেকটি করে সংখ্যা পরীক্ষা করে মৌলিক সংখ্যা খোঁজা গণিতবিদদের আসল লক্ষ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ কেন ওনো বলেন, ‘আমরা মৌলিক সংখ্যা নিয়ে আগ্রহী কারণ এগুলো অসংখ্য রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।’ 

গণিতবিদ কেন ওনো
উইকিপিডিয়া

সম্প্রতি ওনো এবং তাঁর দুই সহকর্মী মৌলিক সংখ্যা খোঁজার জন্য একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। সহকর্মীদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল একাডেমির গণিতবিদ উইলিয়াম ক্রেইগ এবং জার্মানির কলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ জান-উইলেম ভ্যান ইটারসাম। তাঁরা আগের মতো সংখ্যাগুলো খোঁজার জন্য শুধু গুণনীয়ক দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেননি, বরং গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে মৌলিক সংখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়ছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে। বিজ্ঞান গবেষণার মৌলিক কাজের জন্য এই আবিষ্কার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।

আরও পড়ুন

তাঁদের এই আবিষ্কার মৌলিক সংখ্যার অসংখ্য নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে। এই পদ্ধতির মূল ধারণা দাঁড়িয়ে আছে ‘ইন্টিজার পার্টিশন’ বা পূর্ণ সংখ্যার বিভাজন নামে একটি ধারণার ওপর। এই তত্ত্ব অবশ্য অনেক পুরানো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুইস গণিতবিদ লিওনার্ড অয়লারের হাত ধরে এর সূচনা হয়েছিল। প্রথম দেখায় এই তত্ত্ব খুব সহজ মনে হয়। একটা সংখ্যাকে কতভাবে যোগ করে অন্য সংখ্যা বানানো যায়, সেটাই পার্টিশন তত্ত্ব। যেমন, ৫ সংখ্যাটিকে মোট সাত ভাবে ভাগ করা যায়—৫, ৪+১, ৩+২, ৩+১+১, ২+২+১, ২+১+১+১ এবং ১+১+১+১+১। আর এই সহজ ধারণাটিই মৌলিক সংখ্যা খোঁজার নতুন পথ খুলে দিয়েছে। জার্মানির কলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ ক্যাথরিন ব্রিংম্যান বলেন, ‘এটি সত্যিই অসাধারণ যে এমন একটি চিরাচরিত কম্বিনেটোরিয়াল বস্তু—পার্টিশন ফাংশন—নতুন উপায়ে মৌলিক সংখ্যা শনাক্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।’ 

ওনো, ক্রেইগ এবং ভ্যান ইটারসাম প্রমাণ করেছেন, মৌলিক সংখ্যাগুলো হলো পার্টিশন তত্ত্বের একটি নির্দিষ্ট ধরনের বহুপদী সমীকরণের অসংখ্য সমাধান। এই সমীকরণগুলোকে বলা হয় ডায়োফ্যান্টাইন সমীকরণ। তৃতীয় শতাব্দীর গণিতবিদ আলেকজান্দ্রিয়ার ডায়োফ্যান্টাসের নামে এই নামকরণ করা হয়েছে। সহজ ভাষায়, তাদের আবিষ্কার দেখিয়েছে, পূর্ণ সংখ্যার পার্টিশন প্রাকৃতিকভাবে অসংখ্য উপায়ে মৌলিক সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গণিতবিদ জর্জ অ্যান্ড্রুজ এই আবিষ্কারকে বর্ণনা করেছেন ‘একেবারে নতুন কিছু’ এবং ‘অপ্রত্যাশিত’ হিসেবে। তিনি বলেন, ‘এই আবিষ্কার আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।’

এই পদ্ধতিতে ২ বা তার চেয়ে বড় যেকোনো পূর্ণ সংখ্যাকে নির্দিষ্ট সমীকরণে বসিয়ে দেখা যাবে, সংখ্যাটি আসলে মৌলিক কিনা। এমন একটি সমীকরণের উদাহরণ হলো, (3n3 − 13n2 + 18n − 8) M1(n) + (12n2 − 120n + 212) M2(n) − 960M3(n) = 0, যেখানে M1(n), M2(n) এবং M3(n) হলো সুপরিচিত পার্টিশন ফাংশন।

এই আবিষ্কার আরও অনেক নতুন গবেষণার দরজা খুলে দিতে পারে। গণিতবিদেরা এই গবেষণার ভিত্তিতে আরও কাজ করতে পারেন। যেমন, তাঁরা খুঁজে দেখতে পারেন, পার্টিশন ফাংশন ব্যবহার করে আর কী ধরনের গাণিতিক কাঠামো খুঁজে পাওয়া যায়! পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করে মূল ফলাফলকে আরও সম্প্রসারিত করার উপায় খুঁজতে পারেন।

আরও পড়ুন

মৌলিক সংখ্যা নিয়ে এখনো অগণিত অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। সেসবের মধ্যে অনেকগুলোই আবার দীর্ঘদিনের পুরানো। এমন দুটি উদাহরণ হলো, টুইন প্রাইম কনজেকচার ও গোল্ডবাখ কনজেকচার। টুইন প্রাইম কনজেকচার বলে, সংখ্যার জগতে অসংখ্য টুইন প্রাইম রয়েছে। টুইন প্রাইম মানে দুটি মৌলিক সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য যদি দুই হয়, তাহলে সেই মৌলিক সংখ্যা দুটি টুইন প্রাইম। যেমন ৫ ও ৭, অথবা ১১ ও ১৩। আর গোল্ডবাখের কনজেকচার বলে, ‘২-এর চেয়ে বড় প্রতিটি জোড় সংখ্যা অন্তত একভাবে দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল।’ কিন্তু এই অনুমানগুলো এখনো প্রমাণিত হয়নি।

এ ধরনের সমস্যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গণিতবিদ এবং সংখ্যাতত্ত্ববিদদের বিভ্রান্ত করেছে। যদিও ওনোর দলের সাম্প্রতিক আবিষ্কার এই সমস্যাগুলোর সমাধান করে না। তবে এই আবিষ্কারটি দেখায়, কীভাবে গণিতবিদেরা এখনো মৌলিক সংখ্যার রহস্য উদঘাটনের নতুন নতুন পথ খুঁজে চলেছেন।

সূত্র: সায়েন্টেফিক আমেরিকান

আরও পড়ুন