আজ থেকে হাজার বছর আগেই আমরা গুনতে শিখেছি। সম্ভবত আমাদের আদি পূর্বপুরুষেরা যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন, গণনা ছিল তার মধ্যে অন্যতম। সময়ের হিসেব রাখার জন্য তাঁদের গণনা শিখতে হয়েছিল।
গণনার সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে। দক্ষিণ আফ্রিকা আর সোয়াজিল্যান্ডের মাঝামাঝি লেবম্বো পর্বত নামে একটা জায়গা আছে। সেখানকার একটা গুহার নাম বর্ডার কেভ। সেই গুহায় খোঁড়াখুঁড়ির সময় বেবুনের (বানরের প্রজাতি) একটা হাড়ের টুকরো পাওয়া যায়। ওটা ছিল বেবুনের ফিবুলার হাড়। তাতে ২৯টা স্পষ্ট দাগ কাটা ছিল। হাড়টা আনুমানিক ৩৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের! সম্ভবত এরকম হাড় দিয়ে এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত দিনের হিসেব রাখা হতো। ওটাই ছিল আদিম মানুষদের চন্দ্র-ক্যালেন্ডার!
এর চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় গণনার প্রমাণ পাওয়া যায় কঙ্গো ও উগান্ডার সীমান্তে। এই অঞ্চলেও একটা হাড় পাওয়া গেছে। হাড়টি এখন রাখা আছে বেলজিয়ামের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল সায়েন্সে। এর নাম রাখা হয়েছে ইশাঙ্গো বোন বা ইশাঙ্গো হাড়। আনুমানিক ২০ হাজার খ্রিস্টাপূর্বাব্দে হাড়টি পাওয়া গেছে। এতে চারটি সারিতে দাগ কাটা আছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তখনকার মানুষ এই হাড়ে দাগ কেটে কিছু গণনা করেছে। চারটা সারিতে যথাক্রমে ১১টি, ১৩টি, ১৭টি ও ১৯টি দাগ আছে। এগুলো কি সম্পূর্ণ কাকতালীয়? নাকি ১০ থেকে ২০-এর মধ্যকার সব মৌলিক সংখ্যা (যে সংখ্যাকে ১ এবং ওই সংখ্যা ছাড়া আর কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় না) লিখে রেখেছিল? প্রশ্ন ওঠে, মানুষ কি তখনো মৌলিক সংখ্যা নিয়ে আগ্রহী ছিল?
আদিম মানুষদের মৌলিক সংখ্যা নিয়ে আগ্রহ থাক বা না থাক, এটা স্পষ্ট যে তারা হাড়ের ওপর দাগ কেটে সংখ্যা গুণত। শুধু হাড়েই নয়, সংখ্যা গণনার জন্য তারা ছবিও ব্যবহার করত। ফ্রান্সের লাসকো গুহায় প্রায় ১৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এমন কিছু ছবি পাওয়া গেছে। আশ্চর্য সেসব ছবি। একটা ছবিতে কিছু প্রাণী দৌড়াচ্ছে। সেই ছবির পাশেই অদ্ভুত বিন্যাসে কিছু বিন্দুও আঁকা আছে। সম্ভবত চাঁদের দশার হিসেব রাখতে এমন বিন্দু এঁকেছিল আদিম মানুষেরা।
এরকম আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি ১৩টি ডট চিহ্ন আঁকা। তার ঠিক পাশেই আঁকা একটা বিশাল পুরুষ হরিণের ছবি। প্রতিটি ডট চিহ্ন যদি চাঁদের এক মাসের চার ভাগের এক ভাগ হয়, তাহলে ১৩টি ডট মানে এক বছরের এক-চতুর্থাংশ। মানে একটা ঋতু বা ৩ মাস। ছবিটি সম্ভবত শিকারীদের প্রশিক্ষণের জন্য আঁকা হয়েছিল। বছরের কোন সময় পুরুষ হরিণের শিং বড় থাকে এবং শিকার করা সহজ, তা এই ছবির সাহায্যে বোঝা যেত।
কিন্তু হাড়ে দাগ কাটা আর ছবিতে বিন্দু দিয়ে যে আসলেই আদিম মানুষেরা সংখ্যা বুঝিয়েছিল কি না, তা এখন আর জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। তবে বিজ্ঞানীদের এই অনুমানকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। অবশ্য এমন দাগ আর বিন্দু দিয়ে বড় সংখ্যা গণনা করা খুব মুশকিল। একটা হাড়ে কতগুলো দাগ কাটা আছে বা দেয়ালে কয়টি বিন্দু আঁকা, তা চট করে বোঝা যায় না। বিশেষ করে পাঁচের বেশি বিন্দু হলে মানুষ সবমসয় নির্ভুলভাবে গণনা করতে পারে না। এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে পৃথিবীর নানা সংস্কৃতি আরও উন্নত গণনা পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে।
যেমন প্রাচীন মিশরীয়দের কথা বলা যায়। ১০, ১০০ বা তারচেয়ে বড় সংখ্যা গণনার জন্য মিশরীয়রা মজার কিছু চিহ্ন বানিয়েছিল। ১০ বোঝাতে গোড়ালির হাড়ের ছবি আঁকত, ১ লাখ বোঝাতে আঁকত ব্যাঙের ছবি। কিন্তু এই পদ্ধতি দিয়ে অসীম পর্যন্ত গোনা সম্ভব ছিল না। কারণ, সংখ্যা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন চিহ্ন বানাতে হতো।
এই সমস্যার সমাধান করতে অন্য প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কার করল স্থানীয় মান। এর সাহায্যে অল্প কিছু চিহ্ন ব্যবহার করে অসীম পর্যন্ত গোনা যেত। এ ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকায়। প্রায় ২ হাজার বছর আগে মায়া সভ্যতার মানুষেরা প্রাচীন মানুষদের মতো দাগ কেটে সংখ্যা গণনা করত। তবে তাদের গণনা পদ্ধতি ছিল একটু ভিন্ন। প্রাচীন গুহাবাসীরা পাঁচ বোঝাতে ৫টি বিন্দু আঁকত। কিন্তু মায়ানরা জেলের বন্দীদের মুক্তির দিন গণনার মতো করে গুনত। অর্থাৎ পাঁচ বোঝাতে ৪টি ডট চিহ্নের ওপর একটা দাগ টেনে দিত। এখন যে আমরা টালি চিহ্ন ব্যবহার করি, তা অনেকটা মায়ানদের সেই পদ্ধতির আধুনিক রুপ। মায়ানরা যখন গুনতে গুনতে ২০ পর্যন্ত পৌঁছাত, তখন আর ডট চিহ্ন ব্যবহার না করে স্থানীয় মান ব্যবহার করত। মানে কতবার ২০ গোনা হয়েছে, শুধু সেই হিসেব রাখত।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ওপরের ছবিটা খেয়াল করুন। ওপরের বিন্দু দিয়ে বোঝানো হয়েছে ২০। আর নিচের লাইন মানে ৫। চারটি ডটের ওপর একটা লাইন টানলে এমন সরলরেখার মতোই একটা দাগ হবে। অর্থাৎ, এই বক্স বা ঘর মানে হলো ২৫। ওপরের বিন্দুতে ২০ আর নিচের লাইনে ৫। সুতরাং এটাই ছিল মায়ানদের ২৫ লেখার পদ্ধতি। সংখ্যা গণনার এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করে তারা অসীম পর্যন্ত গুণতে পারত। ২০-এর চেয়ে বড় সংখ্যা বোঝাতে একটা ঘরের পাশে আরও ঘর বসাত। অনেকটা আমাদের বর্তমান সংখ্যা পদ্ধতির মতো। আমরা যেমন ১০-এর পরে একটা শূন্য বসালে ১০ গুণ বেড়ে ১০০ হয় বা দুটি শূন্য বসালে একশ গুণ বেড়ে ১০০০ হয়, তেমনি ৪০০ লিখতে মায়ানরা দুটি ২০-এর ঘর ব্যবহার করত। অর্থাৎ ২০-এর ২০ গুণ—মানে ৪০০।
এই ডট আর লাইনের পদ্ধতি ব্যবহার করে মায়ানরা অনেক জটিল আর বড় সংখ্যা হিসাব করতে পারত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও এই পদ্ধতিতে অনেক লম্বা সময়ের হিসাব রাখতে পারতেন।
তবে এই স্থানীয় মান পদ্ধতি কিন্তু আরও আগেই একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। ধারণা করা হয়, প্রথম যারা গণিত নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, ব্যাবিলন তাদের মধ্যে অন্যতম। তারা ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করত। ১-৫৯ পর্যন্ত সংখ্যা গণনার জন্য আলাদা চিহ্ন বানিয়েছিল ব্যাবিলনীয়রা। যখন ৬০ পর্যন্ত যেত, তখন তারা আবার একটা নতুন ঘর দিয়ে বোঝাত যে ৬০ পর্যন্ত গোনা হয়েছে। এখনকার ঘড়িগুলো দেখলেই বিষয়টা আরও ভালো বুঝতে পারবেন। ৫৯ সেকেন্ড হওয়ার পরে ৬০ না হয়ে এক মিনিট বেড়ে যায়। বাঁ পাশে ওই এক মিনিট বেড়ে যাওয়া মানেই ৬০ সেকেন্ড হয়ে যাওয়া।
এখন আপনি ভাবতে পারেন, আমরা কেন ১০-ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি বেছে নিলাম? প্রাচীন সংস্কৃতিতে তো ২০ বা ৬০ ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি ছিল। আসলে আমাদের এভাবে (দশ ভিত্তিক) গোনার আলাদা কোনো বিশেষত্ত্ব বা কারণ নেই। এর একমাত্র কারণ হলো, আমরা হাতের আঙুলের সাহায্যে গুনতাম। দুই হাতের মোট ১০টি আঙুল, তাই দশ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। অন্তত এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের ধারণা, মায়ানরা সম্ভবত হাত ও পায়ের আঙুল মিলিয়ে ২০ ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করত।
আরেকটা প্রশ্ন হয়তো মাথায় ঘুরছে। তাহলে ব্যাবিলনীয়রা কেন ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে গুনত? একটা কারণ হতে পারে, ৬০-কে অনেকগুলো সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায়। মানে ৬০-এর উৎপাদক অনেক বেশি। যেমন ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ১০, ১২, ১৫ ও ৩০ দিয়ে ৬০-কে ভাগ করা যায়। পাশাপাশি আরও একটা কারণ থাকতে পারে। ৬০ সংখ্যাটা আমাদের শারীরিক গঠনের সঙ্গে জড়িত। আপনি চাইলে হাতের আঙুলের হাড় ব্যবহার করে ৬০ পর্যন্ত গুনতে পারবেন।
আমাদের হাতের প্রতিটি আঙ্গুলে ৩টি করে হাড় আছে। সাধারণত যেভাবে আমরা ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে সংখ্যা গুনি, সেভাবে হাড় বা আঙুলের রেখাগুলো, অর্থাৎ কর গুনুন। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রতিটি হাতের আঙুলে তিনটি করে কর আছে। আর হাত মুষ্টি করলে আঙুলের হাড়গুলো দেখতে পাবেন। এরকম একটা আঙুলে ৩টা হাড় থাকলে হাতের চারটা আঙুলে মোট ১২টা হাড় থাকবে। পঞ্চম বা বুড়ো আঙুলের সাহায্যে তো গুনবেন, তাই এটা গোনায় ধরা হয়নি। এবার ডান হাতের ১২টা হাড় একবার গোনার পর বাঁ হাতের একটা আঙুল বন্ধ করে রাখুন। আবার ডান হাতের ১২টা হাড় গুণে বাঁ হাতের দ্বিতীয় আঙুলটা বন্ধ করুন। তাহলে একইভাবে বাঁ হাতের ৫টা আঙুল যখন বন্ধ করবেন, তখন মোট ৬০টা হাড় গোনা হবে। এই পদ্ধতিতেও ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবহার করতে পারে ব্যাবিলনীয়রা, এমনটাই ধারণা বিজ্ঞানীদের।
যদিও এখন আমরা ১০ ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করি, কিন্তু তবু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাবিলনীয়দের ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন আছে। যেমন এক মিনিটে ৬০ সেকেন্ড এবং এক ঘণ্টায় ৬০ মিনিট।