বিজ্ঞানে গণিতের ভূমিকা

২ হাজার ৬০০ বছর আগের কথা। জ্যামিতি জন্ম দিয়েছিল বিশুদ্ধ চিন্তার। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই বিশুদ্ধ চিন্তার ফলে বিজ্ঞানের সুবর্ণ অগ্রযাত্রাকে সে থামিয়ে দিয়েছিল। তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল অধিতবিদ্যার হাতিয়ার হিসেবে। হাজার হাজার বছরের জ্ঞানের সংগ্রামের ইতিহাসে জ্যামিতি হলো ‘মানুষের চিন্তার দ্বিতীয় পর্যায়’। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষে এসে জ্যামিতি গণিতের প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে প্রথম যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউক্লিডের সমতল জ্যামিতির পঞ্চম স্বীকার্য বা সমান্তরাল সরলরেখা নামের ধাঁধার রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়। একটানা ২ হাজার ৩০০ বছর ধরে চেষ্টার পর বোঝা সম্ভব হয়, ইউক্লিড আসলে ঠিকই ছিলেন। সেই থেকে গণিতের প্রকৃত ভূমিকা অনুধাবন সম্ভব হয় যে গণিতের কাজ কোনো কিছুর সত্যাসত্য নির্ণয় করা নয়, বরং অভ্যন্তরীণ অসংগতি ছাড়া যৌক্তিক কাঠামো গড়ে তোলা। তা বাস্তবের সঙ্গে মিলে যেতে পারে না–ও পারে, কিন্তু গণিতের কাজ নয় বাস্তবকে বর্ণনা করা। কোন গণিতটি প্রাকৃতিক নিয়মাবলিকে বর্ণনার ক্ষেত্রে কাজে আসবে, সে কাজটি বিজ্ঞানীদের (বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানী)। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে এতটা আচ্ছন্ন, এতটা আলোড়িত আর এতটা চেষ্টা হয়নি—যতটা হয়েছে ইউক্লিডের পঞ্চম বা সমান্তরাল স্বীকার্যের প্রমাণ নিয়ে। সমান্তরাল সরলরেখার এই ইতিহাসটা হলো ব্যর্থতা, অবমাননা, লাঞ্ছনা ও ভয়ের। আবার অইউক্লিডীয় জ্যামিতি উদ্ভব ও গণিতের প্রকৃত ভূমিকা বোঝার মতো অসাধারণ অর্জনের ইতিহাস বটে।

সমান্তরাল বা পঞ্চম স্বীকার্য হলো একটি সরল রেখা অপর দুটি সরল রেখাকে ছেদ করলে এর একপার্শ্বে উত্পন্ন অন্তস্থ কোণের যোগফল দুই সমকোণের চেয়ে ক্ষুদ্রতর হবে, সে পার্শ্বে সরল রেখা দুটিকে বর্ধিত করলে সরল রেখাদ্বয় একটি বিন্দুতে মিলিত হবে।

জ্যামিতিতে প্রমাণের মানে হচ্ছে, সরল ও স্পষ্ট ধারণার ভিত্তিতে অপেক্ষাকৃত জটিল সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করা বা ভুল দেখিয়ে দেওয়া, এটার শুরু তাঁর হাত দিয়ে। চিন্তার পদ্ধতি হিসেবে একে বলা হয়, অবরোহী পদ্ধতি। অবশ্য থেলিস পিরামিডের উচ্চতা নির্ণয়ে যা করেছিলেন, তা বিশুদ্ধ অবরোহী পদ্ধতি নয়, বরং একধরনের আরোহী, অবরোহীর মিশ্রণ। এই ধরনের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে অবরোহী পদ্ধতির উদ্ভব এবং বিকাশ শুরু। এরপর পিথাগোরীয়রা এলেন। তাঁরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তাঁদের গাণিতিক কর্মকাণ্ডের ফলাফলগুলো ভালোভাবে ভৌত বা প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গণিতের এই নিশ্চিত ফলাফল তাঁদের উদ্বুদ্ধ করল। তাঁরা নিশ্চিত হলেন, বিশুদ্ধ চিন্তা একমাত্র নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে। তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আর প্রয়োজন বোধ করল না। বরং নিষিদ্ধ করে দিলেন এবং বললেন, এই প্রমাণ মনের মধ্যে হলেই চলবে। ফলে জন্ম হয়েছিল জ্যামিতি তথা বিশুদ্ধ গণিতের। যদিও তাঁরা তা অনুধাবন করতে পারেননি। তাঁরা গাণিতিক সত্যতা ও প্রাকৃতিক জগতের ঘটনাবলিকে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। বাইরের জগৎকে পর্যবেক্ষণ অথবা ইন্দ্রিয়ের সহায়তা ছাড়া যদি কোনো বিশেষ ব্যক্তি ভেতরের বিশুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে পারে, তাহলে স্বপ্ন ধ্যান অলৌকিক উপায়ে জ্ঞান লাভ কেন সম্ভব নয়? ফলে পিথাগোরাসের আমল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত একে অলৌকিক কর্মকাণ্ডে সহায়ক অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানো শুরু হয়েছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ার ইউক্লিড ১৩ খণ্ডে সম্পূর্ণ এলিমেন্টস রচনা করেন। আর্কিমিডিসের সময় থেকে তা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই গ্রন্থে বিভিন্ন সংজ্ঞা ও স্বীকার্যের ভিত্তিতে ইউক্লিড ৪৬৫টি প্রতিজ্ঞার প্রমাণ দেখান। তাঁর প্রথম গ্রন্থ শুরু হয়েছে ২৩টি সংজ্ঞা, পাঁচটি স্বীকার্য (Postulate) এবং পাঁচটি সাধারণ সত্য (Common notion) দিয়ে। এই পাঁচটি স্বীকার্যের পঞ্চমটি হলো ‘একটি সরলরেখা অপর দুটি সরলরেখাকে ছেদ করলে এর একপার্শ্বে উত্পন্ন অন্তঃস্থ কোণের যোগফল দুই সমকোণের চেয়ে ছোট হবে, সে পার্শ্বে সরলরেখা দুটিকে বর্ধিত করলে সরলরেখাদ্বয় একটি বিন্দুতে মিলিত হবে।’ এটাই পঞ্চম স্বীকার্য বা সমান্তরাল সরলরেখা স্বীকার্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

গণিতবিদেরা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছেন, এটা একটা প্রতিজ্ঞা। সুতরাং প্রতিজ্ঞাকে ইউক্লিডের অন্যান্য স্বীকার্য ও কিছু সংজ্ঞা সাপেক্ষে প্রমাণ করা যাবে (স্বীকার্য ও সংজ্ঞা হলো সবচেয়ে মৌলিক ধারণা, একে প্রমাণ করা যায় না। একে শুধু ধরে নেওয়া যায়। এর ভিত্তিতে প্রতিজ্ঞাকে প্রমাণ করতে হয়)। সে কারণে একে প্রমাণ করার সীমাহীন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন গণিতজ্ঞরা। কিন্তু দুই হাজার বছর ধরে এই চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়ে ইউক্লিডের অনুমানকে সমর্থন করেছে। এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল প্রথম সহস্রাব্দ শুরু হওয়ার আগে পসিডোনাসের হাতে। এ ছাড়া প্রথম সহস্রাব্দে টলেমি, প্রোক্লাস, দ্বিতীয় সহস্রাব্দে লেভি বেন গার্সন, নাসিরউদ্দিন-আল-তুসি, পি এ ক্যাটাল্ডি, জি এ বোরেল্লি, জি ভিটালে, জন ওয়ালিস, নিউটন, জিরোলামো সাখেরি, হ্যানরিক ল্যাম্বার্ট, এ এম লিজেঁদর, ফারাকাস বোলাইয়ের নাম উল্লেখযোগ্য।

বাম থেকে নিকোলাস লোভেচেভস্কি, জেনাস বোলাই এবং জিরোলামো সাখেরি

একে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়ে কয়েকজন গণিতবিদ বুঝেছিলেন, এটা আসলে স্বীকার্য হিসেবে থাকবে। কিন্তু এই স্বীকার্যের গড়নটা জটিল ও দুর্বোধ্য মনে হওয়ায় এর বদলে বিকল্প কিছু নেওয়া যেতে পারে। সেই চিন্তা করে তাঁরা সফল হয়েছিলেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন প্রোক্লাস, লিজেঁদর, বোলাই ও জন প্লেফেয়ার। কিন্তু এসব বিকল্পের একটিকে গ্রহণ করলে জ্যামিতি শিক্ষার জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এগুলোর কোনোটির ব্যবহার খুব কৃত্রিম মনে হয়। ইউক্লিডের প্রতিভার কাছে আমরা ঋণী, কারণ তিনি ২ হাজার ৩০০ বছর আগে এই স্বীকার্যের অপরিহার্যতা টের পেয়েছিলেন। একে বুঝতে হলে ইউক্লিডীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।

কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়ে জ্যামিতিবিদেরা প্রথম বুঝতে পারলেন, পঞ্চম স্বীকার্য বাদ দিয়ে জ্যামিতি গড়ে তোলা যায়, যাকে পরম জ্যামিতি বলে। তবে সেখানে ত্রিভুজ–সংক্রান্ত কোণের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়—ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের বড় হতে পারে, ছোট বা সমানও হতে পারে। সমান হওয়ার জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে পঞ্চম স্বীকার্যের। পঞ্চম স্বীকার্য বাদ দিয়ে অইউক্লিডীয় জ্যামিতি গড়ে তোলা যৌক্তিকভাবে সম্ভব, এই সিদ্ধান্তে প্রথম এসেছিলেন সুইস পাদ্রি জিরোলামো সাখেরি। সেটা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কিন্তু তিনি নিজের কাজকে নিজে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জ্যামিতিশাস্ত্রের প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে পারেন কার্ল ফ্রেডারিক গাউস (১৮২০), রাশিয়ার নিকোলাই লোভেচেভস্কি (১৮২৬) ও হাঙ্গেরির জেনাস বোলাই (১৮৩২)। তাঁরা এটা নিয়ে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন। তাঁরা ইউক্লিডের শুধু পঞ্চম স্বীকার্যের বদলে অন্যান্য স্বীকার্য নিয়ে ঋণাত্মক বক্রতাবিশিষ্ট জ্যামিতি গড়ে তোলেন। আর বার্নার্ড রিম্যান দেখান এ রকম প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বীকার্য নিয়ে অসংখ্য জ্যামিতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। যেখানে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান, ছোট অথবা বড় হতে পারে। এগুলো বাস্তবিক সত্য হবে কি না বিবেচ্য বিষয় নয়, বিষয়টা হলো যৌক্তিক কোনো অসংগতি থাকতে পারবে না। আর আলবার্ট আইনস্টাইন ও আলেক্সান্দার ফ্রিডম্যান এই রিম্যানীয় জ্যামিতি ব্যবহার করে আধুনিক মহাবিশ্ব–তত্ত্বকে দাঁড় করান এবং সেটাই আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি।

এই রহস্য উন্মোচনের জন্য লোভেচেভস্কিকে মানুষের সামনে পাগল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সমসাময়িক খ্যাতিমানেরা। তাঁরা পত্রিকায় অমার্জিত ভাষায় তাঁকে বিদ্রূপ ও উপহাস করেছিলেন। বোলাইয়ের নাম চিরকালের জন্য মুছে ফেলার অভিপ্রায়ে গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, মাত্র তিনজন লোক উপস্থিত ছিল মৃতদেহের সত্কার করার জন্য এবং চার্চ রেজিস্টারে লেখা হয়েছিল তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল অর্থহীন কাজের মধ্য দিয়ে। আর গাউস এর ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেননি।

এ ধরনের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল সমান্তরাল সরলরেখার ব্যর্থতা ও বেদনাদায়ক উপাখ্যানের কাহিনি। এসব কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা গেল, জ্যামিতির (অইউক্লিডীয় জ্যামিতির) ফলাফলগুলো বাস্তবিকই সত্য হবে কি না বিবেচ্য বিষয় নয়, বিষয়টা হলো জ্যামিতিক ব্যবস্থাটির মধ্যে যৌক্তিক কোনো অসংগতি থাকতে পারবে না। গণিতের কাজ হলো ‘যদি ও তবে’র মাধ্যমে একটি যৌক্তিক শৃঙ্খলা গড়ে তোলা। এর মধ্যে যে স্বীকার্য ও সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো অথবা এর ফলাফলগুলো সত্য বা মিথ্যা কি না, তা দাবি করা বিবেচ্য বিষয় নয়, এটা ছেড়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞানীদের (বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানী) হাতে। এভাবে গণিতের প্রকৃত ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং গণিতের ‘বিশুদ্ধ চিন্তা’ জগৎ সম্পর্কে সব ধারণা দিতে পারে বা রহস্যবাদী উপায়ে জ্ঞানলাভ সম্ভব–সংক্রান্ত ধারণার অবসান ঘটে। মানবজাতি একক সত্যের ধারণা থেকে সরে আসে। নমনীয় ও বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মহাবিশ্বের দিকে তাকাতে সামর্থ্য হয়।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা