ভেক্টর ও ভেক্টরের যোগ–বিয়োগ

ধরে নিই, আমি একটি সমতল মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার থেকে ঠিক পাঁচ মিটার দূরে মাঠের উত্তর-পূর্ব (একবারে কোনাকুনি না) দিকে একটি তালগাছ আছে। এখন আমি যদি কম কষ্টে তালগাছের কাছে যেতে চাই, তাহলে একটি সরলরেখা বরাবর পাঁচ মিটার যেতে হবে, ঠিক তালগাছের দিকে। আমি একটি সরলরেখা বরাবর যাব এই জন্য, সমতলে দুটো বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে কম হলো সরলরেখা বরাবর। যেকোনো দিকে পাঁচ মিটার গেলেই আমি তালগাছ পাব না। এই যে আমার থেকে পাঁচ মিটার একটি নির্দিষ্ট দিকে (তালগাছের দিকে) গেলাম, একে সরণ বলে। আমার সরণের মান হলো পাঁচ মিটার, আর দিক হলো তালগাছের দিকে। যেসব রাশিকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে গেলে মান এবং দিক উভয়েরই দরকার পড়ে, সেসব রাশিকে ভেক্টর রাশি বলে। সাধারণত একটি ভেক্টরকে একটি সরলরেখার অংশ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেখান থেকে ভেক্টর শুরু, তাকে ভেক্টরের আদি বিন্দু বলে। আর যেখানে ভেক্টর শেষ হয়, তাকে ভেক্টরের শেষ বিন্দু বলে। এবং ভেক্টরের দিক হলো আদি বিন্দু থেকে শেষ বিন্দুর দিকে। এ জন্যই সরলরেখার শেষ বিন্দুতে একটি তির চিহ্ন দেওয়া হয়। আর যদি কোনো একটি ভেক্টরের নির্দিষ্ট মান না থাকে কিন্তু একটি নির্দিষ্ট দিক থাকে, তখন সেই ভেক্টরকে বোঝাতে একটি সরলরেখার মাঝখানে তির চিহ্ন দেওয়া হয়। যেমন পৃথিবী থেকে কোনো একটি তারা বরাবর একটি ভেক্টর, এই ভেক্টরের জন্য দিকটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার মান অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সরণ ভেক্টর হলেও দূরত্ব কিন্তু একটি স্কেলার রাশি। পাঁচ মিটার দূরত্ব বলতে তালগাছ আর আমার মধ্যে দূরত্ব বোঝায়। এর জন্য দিকের প্রয়োজন নেই। যেসব রাশিকে বোঝাতে দিকের কোনো প্রয়োজন নেই, সেসব রাশিকে স্কেলার রাশি বলে। এই লেখায় আমি চেষ্টা করব একটি জিনিস বোঝাতে যে ভেক্টর কোনো জটিল বা শুধু পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নয়। ভেক্টরের দিক থাকলেও ভেক্টর একটি অতি সাধারণ বিষয়। আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি সময় ভেক্টর রাশি ব্যবহার করি, এমনকি আমাদের যে হাঁটাচলা, তা–ও ভেক্টরের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ, বলতে গেলে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপই একেকটি ভেক্টর রাশি।

সাধারণত একটি ভেক্টরকে একটি অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়ে থাকে, স্কেলার রাশি থেকে ভেক্টরকে আলাদা করার জন্য অক্ষরের ওপরে বা নিচে একটি ছোট তির চিহ্ন দেওয়া হয়, বইয়ের ক্ষেত্রে বোল্ড অক্ষর দিয়েও ভেক্টর বোঝানো হয়ে থাকে (, , অথবা )।

এখন দেখব, কীভাবে দুটো ভেক্টর যোগ করতে হয়। প্রথমে একটি ব্যাপার বুঝতে হবে, তা হলো দুটো ভেক্টরকে আমরা সমান বলব, যদি ভেক্টর দুটোর মান সমান এবং দিক একই দিক হয়। তার মানে, যদিও তালগাছের কাছে যেতে হলে আমাকে মাঠের মাঝখান থেকে উত্তর–পূর্ব দিকে পাঁচ মিটার যেতে হবে, অন্য যেকোনো একটি ভেক্টর, যার মান পাঁচ মিটার এবং যার দিক উত্তর–পূর্ব দিক, সেই ভেক্টর আগের ভেক্টরের সমান। এখন দুটো ভেক্টর দেওয়া থাকলে সে দুটোকে সহজেই আমরা যোগ করতে পারি। প্রথমে একটি ভেক্টর আঁকব, এরপর এর মাথা থেকে দ্বিতীয় ভেক্টর আঁকব। সবশেষে প্রথম ভেক্টরের আদি বিন্দু থেকে দ্বিতীয় ভেক্টরের শেষ বিন্দু বরাবর একটি লাইন যোগ করে দেব। এই লাইনই হলো দুটো ভেক্টরের যোগফল। এর দিক হলো প্রথম ভেক্টরের আদি বিন্দু থেকে দ্বিতীয় ভেক্টরের শেষ বিন্দু বরাবর। ঠিক একইভাবে অনেক ভেক্টর দেওয়া থাকলে প্রথম ভেক্টর এঁকে এর শেষ বিন্দুতে দ্বিতীয় ভেক্টর, দ্বিতীয় ভেক্টরের শেষ বিন্দুতে তৃতীয় ভেক্টর...এমন করে একটির মাথায় আরেকটি ভেক্টর আঁকব। সবার শেষে প্রথম ভেক্টরের আদি বিন্দু থেকে শেষ ভেক্টরের শেষ বিন্দু পর্যন্ত একটি রেখা টানলেই সব কটি ভেক্টরের যোগফল পাওয়া যাবে। আগের মতোই যে ভেক্টরের দিক হবে প্রথম ভেক্টরের আদি বিন্দু থেকে শেষ ভেক্টরের শেষ বিন্দু বরাবর। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিটি ভেক্টর আঁকার ক্ষেত্রে এদের দিক এবং মান ঠিক রাখতে হবে।

এখন আবার ফিরে যাই সেই তালগাছের দিকে। তালগাছের দিকে সোজা গিয়ে দেখা গেল, মাঝখানে কাদা আর পানি। কিন্তু সোজা পুব দিকে পানি নেই, তারপর সোজা উত্তর দিকেও পানি নেই। ধরে নিই, আমি সোজা পুব দিক বরাবর চার মিটার গেলে, তারপর আবার সোজা উত্তর দিকে তিন মিটার গেলেই আমি তালগাছ পাব। তার মানে, আগের যে পাঁচ মিটার লম্বা ভেক্টর, যার দিক ছিল উত্তর–পূর্ব দিকে, এখন সেই ভেক্টর পাচ্ছি দুটো ভেক্টরের যোগফল হিসেবে—একটি চার মিটার লম্বা ভেক্টর পুব দিকে, এর মাথায় তিন মিটার লম্বা ভেক্টর উত্তর দিকে। দুটো ভেক্টরের যোগফল এদের অর্ডারের ওপর নির্ভর করে না। যেমন প্রথমে উত্তর দিকে তিন মিটার এবং এরপর পুব দিকে চার মিটার গেলেও একই ভেক্টর পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আরও অসংখ্যভাবে মাঠের মাঝখান থেকে তালগাছে পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কিন্তু যেকোনোভাবেই তালগাছের দিকে যাই না কেন (আমার চলার পথ যত আঁকাবাঁকাই হোক না কেন), এটা একটি ভেক্টরই নির্দেশ করে, মাঠের মাঝখান থাকে তালগাছ বরাবর, যা কিনা একটি সরলরেখা। এখন একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, আমার প্রতিটি পদক্ষেপই একেকটি ভেক্টর, একটির শেষে আরেকটি দিয়েই মাঠের মাঝখান থেকে তালগাছে যেতে পেরেছি।

যদি একটি ভেক্টরের মাথায় অন্য একটি ভেক্টর বসিয়ে দিয়ে দুটো ভেক্টর যোগ করা যায়, তাহলে একটি ভেক্টর থেকে অন্য একটি ভেক্টর কীভাবে বিয়োগ করা যায়! একটি ভেক্টর থেকে অন্য একটি ভেক্টর বিয়োগও আসলে দুটো ভেক্টরের যোগ করার মতোই। এর জন্য আমাদের অন্য একটি জিনিস বুঝতে হবে। সেটা হলো একটি ভেক্টর দেওয়া থাকলে এর ঋণাত্মক একটি ভেক্টর কীভাবে পাওয়া যায়। নিয়মটি খুব সহজ, একটি ভেক্টর দেওয়া থাকলে এর ঋণাত্মক ভেক্টর হলো একটি ভেক্টর, যার মান আগের ভেক্টরের সমান কিন্তু দিক আগের ভেক্টরের দিকের উল্টো দিকে। তার মানে, শুধু দিক উল্টো করেই আমরা একটি ভেক্টরের ঋণাত্মক ভেক্টর পাচ্ছি। এখন প্রথম ভেক্টরের শেষ বিন্দুতে দ্বিতীয় ভেক্টরের ঋণাত্মক ভেক্টর বসিয়ে দিয়ে যোগের নিয়মেই একটি ভেক্টর পাচ্ছি। ঠিক একইভাবে দ্বিতীয় ভেক্টর থেকে প্রথম ভেক্টর বিয়োগ করতে চাইলে, প্রথমে দ্বিতীয় ভেক্টর আঁকতে হবে। এর মাথায় প্রথম ভেক্টরের ঋণাত্মক ভেক্টর বসিয়ে একটি লাইন যোগ করতে হবে, দ্বিতীয় ভেক্টরের আদি বিন্দু থেকে প্রথম ভেক্টরের ঋণাত্মক ভেক্টরের শেষ বিন্দু পর্যন্ত। অর্থাৎ একটি ভেক্টর থেকে অন্য একটি ভেক্টর বিয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা যা করছি তা হলো এই: দুটো ভেক্টর যোগের বেলায় কোন ভেক্টর আগে আর কোন ভেক্টর পরে এই অর্ডারের ওপর ভেক্টরের যোগফল নির্ভর করে না। কিন্তু একটি ভেক্টর থেকে আরেকটি ভেক্টর বিয়োগ করার বেলায় ভেক্টরের অর্ডার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

এখন আমরা অনায়াসেই বলতে পারি, এক পা এগোনো মানে সামনের দিকে এক পা সমান একটি ভেক্টর। ঠিক একইভাবে বলতেই পারি, এক পা পেছানো মানে পেছনের দিকে এক পা সমান একটি ভেক্টর, যা আসলে সামনের দিকের ভেক্টরের ঋণাত্মক ভেক্টর। এই ভেক্টর দুটোকে যোগ করার মানে হলো আমি এক পা এগিয়ে গিয়ে আবার এক পা পিছিয়ে এলাম। তার মানে, আমি আগের অবস্থানে ফিরে এসেছি। তাহলে দুটো ভেক্টর যোগ করার ফলে (অথবা কোনো একটি ভেক্টর থেকে সেই ভেক্টরকে বিয়োগ করলে) আমি একটি ভেক্টর পেয়েছি, যার মান শূন্য এবং দিক হলো ইচ্ছামতো, এই ভেক্টরকে বলে শূন্য ভেক্টর বা Null Vector, অর্থাৎ, এখানে শূন্য ভেক্টরের প্রয়োজন এই জন্য যে সমান চিহ্নের আগের রাশি দুটো ভেক্টর রাশি, তাহলে সমান চিহ্নের পরের রাশিটিকেও একটি ভেক্টর রাশি হতে হবে। তার মানে, দুই বা ততোধিক ভেক্টর যোগ বা বিয়োগ করে আমরা সব সময়ই আরেকটি ভেক্টর পাব।

দুটো ভেক্টরের যোগ বা বিয়োগ করা চিত্রের মাধ্যমে খুবই সহজে বোঝা যায়, একটির মাথায় আরেকটি এঁকে এঁকে। কিন্তু একটি ভেক্টর দেওয়া থাকলে অনুরূপ আরেকটি ভেক্টর, যার মান এবং দিক আগের ভেক্টরের সমান, আঁকা খুবই কষ্টের। কিন্তু যদি স্থানাঙ্কের মাধ্যমে একটি ভেক্টরকে প্রকাশ করা যায়, তখন অনুরূপ ভেক্টর আঁকা একেবারেই সহজ। এর জন্য দরকার একটি কো-অর্ডিনেট সিস্টেম। যেমন উত্তর বরাবর একটি ভেক্টর যোগ পূর্ব দিক বরাবর আরেকটি ভেক্টর দিয়েই উত্তর–পূর্ব দিকের যেকোনো ভেক্টরকে একটি মাত্র উপায়েই প্রকাশ করা যায়। এভাবে প্রথমে একটি কো-অর্ডিনেট সিস্টেম ঠিক করে প্রতিটি ভেক্টরকে একটি মাত্র স্থানাঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করতে হবে, এগুলোকে ভেক্টরের উপাংশ বলে। একটি সমতলের প্রতিটি বিন্দুকে (যা আসলে মূল বিন্দু থেকে সেই বিন্দু পর্যন্ত একটি ভেক্টর) দুটো উপাংশ দিয়ে প্রকাশ করা যায় (ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে তিনটি উপাংশ দিয়ে প্রকাশ করা যায়), এরপর যতগুলো ভেক্টর যোগ করতে হবে, নির্দিষ্ট দিকের উপাংশগুলো আলাদা আলাদা করে যোগ করলেই হবে। সব শেষে দুটো দিকের মোট উপাংশ দিয়েই ভেক্টরগুলোর যোগফল প্রকাশ করা যাবে। আগের উপায়ে যোগ (একটি ভেক্টরের মাথায় আরেকটি ভেক্টর এঁকে এঁকে) আর এই উপায়ে উপাংশ যোগ করে একই ভেক্টর পাওয়া যাবে। শুধু একটি ভেক্টরের মাথায় অন্য ভেক্টর আঁকার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে এই বিন্দু এখন দ্বিতীয় ভেক্টরের জন্য মূল বিন্দু। দুটো ভেক্টরের বিয়োগের বেলায়ও একই নিয়ম, শুধু ঋণাত্মক ভেক্টর পেতে গেলে আগের ভেক্টরের উপাংশগুলোকে একটি বিয়োগ চিহ্ন দিয়ে গুণ করে নিতে হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়