অঙ্ক কষে ধরে ফেলুন চামচ চোর!

দুপুরের খাবার খেতে গেছেন আপনার পছন্দের হোটেলে। প্রায়ই এখানে খেতে আসেন। খাবার অর্ডার করলেন। খাচ্ছেন দুটি চামচ দিয়ে। একটা সাধারণ চামচ, আরেকটা কাঁটা চামচ। সাধারণ চামচটায় একটু কালো দাগ আছে। মনে মনে ভাবলেন, এটা মনে হয় অপরিষ্কার। কিন্তু খেয়াল করে দেখলেন, চামচ পরিষ্কারই আছে। আসলে ওটা একটু পুরোনো বলে অমন দাগ দেখা যাচ্ছে।

গত সপ্তাহে খাওয়ার সময়ও এই চামচটা আপনাকে দিয়েছিল। ফেরত দিয়ে অন্য একটা চামচ নিয়েছিলেন। একই জায়গায় দাগ দেখেই আজ টের পেলেন, ওটা আসলে ময়লা না। কিন্তু, আপনার মনে হলো, আজও বোধ হয় ‘ব্যাটা’ ইচ্ছে করে আপনাকে এই চামচ দিয়েছে। তাই আজও ফেরত দিলেন। তারপর হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল, ওরা পুরাতন চামচগুলো বদলে নতুন চামচ নেয় না কেন? এই হোটেলে মোট কতগুলো চামচ লাগে?

এই যে প্রশ্নটা একটু আগে আপনার মাথায় উঁকি দিল, সেই প্রশ্নের উত্তর আপনি কীভাবে পাবেন? সম্ভবত হোটেলের ম্যানেজার বা ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেও এই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে না। কারণ, ওরাও চামচের সংখ্যা মুখস্ত করে রাখে না। তবে ওদের সাহায্য ছাড়াই, সাধারণ গণিত ব্যবহার করেই মোট চামচের সংখ্যা আপনি জানতে পারবেন। কী সেই গাণিতিক কৌশল? বলছি!

এই হোটেলে যদি আপনি টানা দুই দিন তিন বেলা খান, তাহলে অন্তত ১২টা চামচ ব্যবহার করতে পারবেন। আর একটু চালাকি করে চামচ বদলালে ব্যবহার করতে পারবেন ১৫-২০টা। যতগুলো চামচ আপনার হাতে আসবে, সেগুলোতে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে, যাতে এর ৭ দিন পর এসেও ওই চামচ চিনতে পারেন। তাহলে প্রথম দুই দিনে আপনি যতগুলো সম্ভব চামচে চিহ্ন দিয়ে রাখলেন। এরপর টানা ৭ দিন আর এই হোটেলে খেলেন না। এরপর এসে আবার টানা দুই দিনে ৩ বেলা করে মোট ৬ বার খেলেন। এই দুই দিনে আপনাকে খুঁজে দেখতে হবে, আগে চিহ্ন দেওয়া কয়টা চামচ আপনার হাতে আবার এসেছে। সেই হিসেবের ওপর ভিত্তি করে বলে দিতে পারবেন, এই হোটেলে মোট কয়টা চামচ আছে। 

একদম চোখ বুজে বলার উপায় নেই যে ওখানে ১০০টা গরুই আছে। কিন্তু গাণিতিক হিসাব মোটামুটি তা-ই বলে। এবং ভালো সম্ভাবনা আছে, একটু এদিক-ওদিক হলেও সংখ্যাটা ১০০-এর মতোই হবে।

আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, একটা মাঠে কিছু গরু আছে। সেখান থেকে প্রথমবার ৫০টা গরু ধরে সবগুলোর গায়ে চিহ্ন দিয়ে দিলেন। দ্বিতীয়বার আবার দৈবচয়ন ভিত্তিতে বা র‍্যান্ডমলি ৫০টি গরু ধরলেন। দেখা গেল, এখানকার ২৫টি গরুর গায়ে আপনার দেওয়া চিহ্ন আছে। তার মানে, অর্ধেকের গায়ে আগের চিহ্ন আছে। অর্থাৎ, ওখানে মোট ১০০টি গরু আছে।

না, একদম চোখ বুজে বলার উপায় নেই যে ওখানে ১০০টা গরুই আছে। কিন্তু গাণিতিক হিসাব মোটামুটি তা-ই বলে। এবং ভালো সম্ভাবনা আছে, একটু এদিক-ওদিক হলেও সংখ্যাটা ১০০-এর মতোই হবে। কারণ, নমুনার অর্ধেকে চিহ্ন থাকা মানে পুরো সংখ্যার অর্ধেকে চিহ্ন আছে। সেই হিসেবে মোট গরুর সংখ্যা হবে ১০০টা। এভাবে সবগুলো গরু আলাদাভাবে না গুনে মাত্র কিছু গরু গুনেও মোট গরুর সংখ্যা জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পরিসংখ্যানবিদেরা এভাবে জার্মানির ট্যাংক সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন। তবে সেখানে একটু পার্থক্য ছিল। গরু ধরে যেমন ছেড়ে দেওয়া যায়, ট্যাংক তো তেমন ছাড়া যায় না। কিন্তু ট্যাংকের যন্ত্রাংশে আবার ক্রমিক নম্বর দেওয়া থাকে। এই ক্রমিক নাম্বার থেকেই হিসাব বের করা গেল। মিত্রবাহিনী যেসব ট্যাংক আটক করেছে, সেগুলোর ক্রমিক নাম্বার লিখে রাখল। ধরে নিল, এই নাম্বারগুলো পর পর দেওয়া আর এলোমেলোভাবে ছড়ানো। এই তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রমিক নম্বর যদি হয় L আর ধরা পড়া ট্যাংকের সংখ্যা হয় n, তাহলে মোট ট্যাংকের হিসাব হবে = L + (L/n)।

ধরা যাক, মোট চারটি ট্যাংক আটক করা গেল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম্বার হলো ৮০। তাহলে জার্মানির কাছে মোট ট্যাংক থাকতে পারে ৮০ ÷ ৪ = ২০টা। অর্থাৎ ওদের মোট ট্যাংক ছিল ১০০টার কাছাকাছি। পরিসংখ্যানে এটাকে বলা হয় জার্মান ট্যাংক সমস্যা।

গবেষকেরা ২০ বছর আগে এরকমই একটা পরীক্ষা করেছিলেন। তাদের ল্যাব থেকে অনেক চামচ হারিয়ে যাচ্ছিল। গবেষকেরা নিজেদের এক সেট চামচে চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন। চামচগুলো ল্যাব থেকে কোথায় যায়, সেদিকে নজর রাখছিলেন তাঁরা। সেসব নিয়ে একটা গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছিলেন। সেই গবেষণাপত্র প্রকাশের পর বিল্ডিংয়ের যারা চামচ নিয়েছিল, তারা লজ্জা পেয়ে পাঁচটা চামচ ফেরত দিয়েছিল।

 

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট