গণিত কেন কাজ করে

গণিত বিজ্ঞানের ভাষা, মহাবিশ্বের ভাষা। গণিতবিদেরা এমন কিছু নিয়মকানুন আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পর্যন্ত সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়। মহাবিশ্বের শুরুটা কেমন হয়েছিল, তা বলে দেওয়া যায় প্রায় নিখুঁতভাবে। আন্দাজ করা যায় মহাবিশ্বের শেষটা কেমন হবে। এই গণিত ব্যবহার করেই মানুষ বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও সূত্র আবিষ্কার করেছেন। এর হাত ধরেই পৃথিবীতে বসে হিসাব কষে আমরা বলে দিতে পারি, সৌরজগতের গ্রহগুলো কীভাবে ঘুরছে বা ঘুরবে, এর হাত ধরেই মানুষের বানানো মহাকাশযান ভয়েজার–২ পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমানা। সুদূর কৃষ্ণগহ্বরের ছবি ধরা দিয়েছে আমাদের হাতে। এককথায়, আমাদের জ্ঞান–বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ভিত্তি হচ্ছে গণিত।

কখনো ভেবে দেখেছেন, গণিত এত অবিশ্বাস্য নিখুঁতভাবে কেমন করে মহাবিশ্বের গোপন রহস্য ব্যাখ্যা করছে সফলভাবে? কেন এর হাত ধরে, এর নিয়ম মেনে করা পরীক্ষা থেকে জানা যায় প্রকৃতির অদ্ভুত সব কাজের ব্যাখ্যা? আন্দাজ করা যায় ভবিষ্যতে ঠিক কী হবে? ব্যাপারটা একটু ভালোভাবে অনুভব করার জন্য উদাহরণ দিই।

১৮৬০ সাল। স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল চারটি সমীকরণ লেখেন। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ। এই চার সমীকরণ তখন পর্যন্ত তড়িৎ–চৌম্বক নিয়ে জানা সবকিছুর সারকথা ধারণ করেছিল, সেই সঙ্গে হেনরিখ হার্জ বেতার তরঙ্গ শনাক্ত করার দুই যুগ আগেই আন্দাজ করেছিল এর অস্তিত্বের কথা।

গণিতের এ ধরনের অবিশ্বাস্য সাফল্য অবাক করেছিল সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকেও। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের চিন্তার ফল, মস্তিষ্কজাত—গণিত, বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে যার কোনো যোগসূত্র নেই, তা কীভাবে বাস্তব সব বস্তুর আচরণ এত সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে? এটা কীভাবে সম্ভব?’ নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার তো একে ১৯৬০ সালে ‘গণিতের অযৌক্তিক ধরনের কার্যদক্ষতা’ বলে আখ্যায়িত করে একটি গবেষণাপত্র পর্যন্ত লিখেছিলেন।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ বা মহাজাগতিক বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য সিমুলেশন ব্যবহার করেন। যেমন ‘সূর্য লোহিত দানব নক্ষত্রে পরিণত হলে পৃথিবীর কী পরিণতি হবে?’ এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর জানতে ব্যবহৃত হয় সিমুলেশন। বলা বাহুল্য, এসব সিমুলেশনের মূল ভিত্তিও সেই গণিত। ঘুরেফিরে সেই একই প্রশ্ন, কেন? গণিত এত অবিশ্বাস্য সফলভাবে কাজ করে কেন?

এই প্রশ্নের আরেকটু গভীরে উঁকি দিলে পাওয়া যাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সন্ধান। আইনস্টাইন যেমন বলেছেন, ‘গণিত কি আসলেই সে রকম শুধু মানুষের মস্তিষ্কজাত, উদ্ভাবিত কিছু নিয়মকানুন? নাকি বিমূর্ত কোনো রূপে এটি আগে থেকেই ছিল, মানুষ শুধু এর সত্যিটা আবিষ্কার করেছে নিজেদের বোঝার মতো করে?’ এই প্রশ্ন নিয়ে অনেক বিখ্যাত গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা যুগে যুগে নিজেদের মতামত দিয়েছেন, বিতর্ক করেছেন। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী যে একে মানুষের মস্তিষ্কজাত ভাবতেন, তা তো আগেই বলেছি। এদিকে রজার পেনরোজের (২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী) মতো পদার্থবিজ্ঞানী এবং কার্ট গোডেলের মতো প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিবাদী, গণিতবিদ ও বিশ্লেষণী দার্শনিক মনে করেন দ্বিতীয়টি সত্যি—গণিত আগে থেকেই ছিল, মানুষ শুধু একে নিজের বোঝার মতো করে আবিষ্কার করেছে। কোনটা ঠিক? নাকি দুটোই সত্যি? আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মধ্যকার বিভাজনরেখা পেরিয়ে গেলে কি জানা যাবে এ প্রশ্নের উত্তর? হয়তো, হয়তো নয়। কিন্তু এই প্রশ্ন এত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ, সমাধানের পথে এক পা এগোনোর অর্থও এ ক্ষেত্রে তাই অনেক কিছু।

গণিতের এই অস্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে চাইলে ব্যবহারের দিক থেকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। উদাহরণ দিই।

স্যার আইজ্যাক নিউটন ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন কোনো কিছুর পরিবর্তনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে সঠিকভাবে হিসাবে নেওয়ার জন্য। যদিও তাঁর এ কাজের একটি মূল উদ্দেশ্য ছিল গতির হিসাব-নিকাশ। ক্যালকুলাস যে বিজ্ঞানে, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বেশ কাজের একটি জিনিস, তা বলা বাহুল্য। তারপরও কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসে এর ব্যবহারের কথা ভাবলে চমকে যেতে হয়। মূলত আলো ও পদার্থের মিথস্ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্য গড়ে ওঠে পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখা। ইলেকট্রনের চৌম্বক ভ্রামক হিসাব করলে দেখা যায়, তাত্ত্বিক মান ও পরীক্ষণ থেকে পাওয়া মানের পার্থক্য প্রতি ট্রিলিয়নে মাত্র কয়েক ভাগ।

আইনস্টাইন অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলন, স্থান-কালের বক্রতার কারণেই মহাকর্ষ বলের জন্ম হয়
Kazi Akash
একজন গণিতবিদ কোনো কাজে লাগানোর জন্য নয়, এমনিতেই গণিতের একটি অবকাঠামো বা কিছু নিয়মকানুন গড়ে তুলেছেন। কয়েক যুগ থেকে কয়েক শতক পরে দেখা যায়, সেটাই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে!

গাণিতিক তত্ত্ব ব্যবহার করে এত অস্বাভাবিক রকম প্রায় নিখুঁত হিসাব করার নজির কিন্তু আরও আছে। যেমন কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের মান। ১৯৪৮ সালে র৵ালফ আলফার ও রবার্ট হারমেন নানা তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে হিসাব কষে এই বিকিরণের মান কত হতে পারে, তার একটা আনুমানিক হিসাব প্রস্তাব করেন। তাঁদের অনুমান ছিল, এর মান হবে ৫ ডিগ্রি কেলভিন। মনে রাখা দরকার, তখনো মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ শনাক্ত হয়নি। কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব দাঁড়াতে পারেনি বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে। তখনো এটি অস্পষ্ট ধারণা, একটা গঠন পাচ্ছে। কিন্তু মুখে মুখে সে ধারণা যা–ই হোক, কাগজে-কলমে একে কিংবদন্তির বেশি কিছু বলার উপায় নেই। স্বাভাবিক তো। মহাবিশ্বটা সৃষ্টি হয়েছে একটা অসীম ঘনত্বের বিন্দুর বিস্ফোরণের মাধ্যমে, প্রমাণ ছাড়া এ কথা বললে একে কিংবদন্তির বেশি কিছু বলার উপায় আছে? আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন ১৯৬৪ সালে এই তাপমাত্রা যখন শনাক্ত করেন, তখনো জানতেন না, তাঁদের কাজের মাধ্যমে কসমোলজি পরিণত হচ্ছে বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখায়। শনাক্তকৃত তাপমাত্রার মান ২ দশমিক ৭২৫ কেলভিন। কত কাছাকাছি অনুমান, ভাবা যায়? এগুলো হচ্ছে গণিতের প্রত্যক্ষ কার্যদক্ষতা। কারণ, এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গাণিতিক কাঠামো ও নিয়মকানুন এই উদ্দেশ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে।

গণিতের পরোক্ষ কার্যক্ষমতা কিন্তু আরও অদ্ভুত। হয়তো একজন গণিতবিদ কোনো কাজে লাগানোর জন্য নয়, এমনিতেই গণিতের একটি অবকাঠামো বা কিছু নিয়মকানুন গড়ে তুলেছেন। কয়েক যুগ থেকে কয়েক শতক পরে দেখা যায়, সেটাই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে! পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখেন, বিনা উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা সেই গাণিতিক কাঠামো কারিকুরি দেখাচ্ছে দারুণভাবে।

ফ্রেঞ্চ গণিতবিদ এভারিস্তে গ্যালোয়ি ঠিক এ রকম একটি গাণিতিক তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন—গ্রুপ থিওরি। বহুপদী সমীকরণ সমাধান করা যায় কি না, সেটা বোঝার জন্য এটি গড়ে তোলেন তিনি। অতি সরলীকরণ করে বললে, গ্রুপ বলতে বোঝায় একাধিক বস্তুর সেট দিয়ে তৈরি কিছু বীজগাণিতিক কাঠামো। কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে এগুলো, সে হিসাবে এগুলোর ওপর কিছু গাণিতিক অপারেশন করা যায়। যেমন ধরুন, কিছু ইন্টিজার বা পূর্ণসংখ্যার সেট একটি গ্রুপ তৈরি করেছে, যেগুলোর ওপর চাইলে ‘যোগ’ অপারেশন প্রয়োগ করা যায় (মানে এগুলো যোগ করা যায়)। আবার এমন একটা আইডেন্টিটি বা অদ্বিতীয় জিনিস থাকে, যেটা এগুলোর সঙ্গে যোগ করলে ফলাফল আগেরটাই থাকে। যেমন পূর্ণসংখ্যার সঙ্গে শূন্য যোগ করলেও ফলাফল একই থাকে। সহজ করে গ্রুপ তত্ত্বের উদাহরণ হিসেবে আপাতত এটুকু বুঝলেই হবে। বিশ শতকে এসে পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখলেন, মৌলিক কণাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য বিমূর্ত ক্ষেত্র বেশ ভালো কাজ করে। ষাটের দশকে বিজ্ঞানী মারে গেল-মান ও ইউভাল নিইম্যান আলাদাভাবে গবেষণা করে দেখান, SU(3) নামের একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ হ্যাড্রন নামের অতিপারমাণবিক কণাগুলোর আচরণের প্রতিবিম্ব দেখায়। এর ওপর ভিত্তি করেই পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কীভাবে একই চার্জের কণাগুলো একসঙ্গে থাকে, সে তত্ত্ব গড়ে ওঠে।

১৮৫৪ সালে বার্নাড রিম্যান আবিষ্কার করেন রিম্যানীয় জ্যামিতি। এটি নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির একটি শাখা। ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি বলে, সমান্তরাল সরলরেখা মানে সমতলের ওপরের এমন দুটি রেখা, যেগুলো আজীবন সমান দূরত্ব রেখে সমান্তরালভাবে চলতে থাকবে। নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতিতে সমান্তরাল সরলরেখা মানে সমতল নয়, বরং বক্রতলের ওপরের দুটি সমান্তরাল রেখা। তার মানে, এগুলো আজীবন মাঝে সমান দূরত্ব রেখে চলবে না। কোনো বিন্দুতে এগুলো মিলেও যেতে পারে বা বেড়ে যেতে পারে এগুলোর মাঝের দূরত্ব। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে আলবার্ট আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে রিম্যানের কাজকে ব্যবহার করেন। এটাই গণিতের পরোক্ষ কার্যক্ষমতা।

এখান থেকে একটা সাধারণ চিত্র পাওয়া যায়। গাণিতিক তত্ত্ব কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে যেমন গড়ে উঠতে পারে, তেমনি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াও গড়ে উঠতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহার আবিষ্কৃত হয়। এ জন্য অনেকে মনে করেন, যেহেতু এসব আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন—দুটোই মানুষের মস্তিষ্কজাত, কাজেই আমাদের তৈরি গণিত আমাদের বোঝার মতো ও ব্যবহারযোগ্য হিসেবেই গড়ে উঠেছে।

বিশ শতকের সবচেয়ে মেধাবী গণিতবিদদের একজন মাইকেল আতিয়াহ। তিনি গাণিতিক অবকাঠামো আবিষ্কারের পেছনে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকা নিয়ে একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জার্মান গণিতবিদ লিওপোল্ড ক্রোনেকারের একটি কথা আছে। ‘স্রষ্টা মূলত স্বাভাবিক সংখ্যা (Natural Number) সৃষ্টি করেছেন, আর সবকিছুর জন্য দায়ী মূলত মানুষ।’ বলে রাখা ভালো, স্বাভাবিক সংখ্যা মানে ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা (১, ২, ৩…)। মতান্তরে শূন্যও এর অন্তর্ভুক্ত। এবার ধরা যাক, পৃথিবীতে কোনো মানুষ নেই। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে বসবাসকারী তারা মাছগুলোই এই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। এগুলোর কাছে সবকিছুকে মনে হবে চলমান সরলরেখার মতো। হোক সেটা তার চারপাশের পানি বা তাপমাত্রা কিংবা চাপের পরিবর্তন। এ রকম একটি তারা মাছ কি স্বাভাবিক সংখ্যার কথা ভাবতে পারবে? কীভাবে পারবে? সে তো বিচ্ছিন্ন কিছুর কথা ভাবতেই পারে না। এদিকে স্বাভাবিক সংখ্যা, এক, দুই ইত্যাদি বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন বা বিচ্ছিন্ন জিনিসকে বোঝায়। এই তারা মাছ তো গুনতেই পারে না। সে ক্ষেত্রে সংখ্যার ধারণার কি আদৌ জন্ম হবে?

এই তারা মাছের জায়গায় নিজেদের বসিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে, আমরা যেসব ধারণার সঙ্গে পরিচিত বা যেসব জিনিস আমরা ভাবতে পারি, আমাদের গণিতও সে রকম। যেমন একটা ঝুড়িতে কয়টা আপেল আছে, সেটা গোনার জন্য আমরা স্বাভাবিক সংখ্যা ব্যবহার করি। আবার পানির কিছু নিয়ে হিসাব করতে গেলে মাপি ভর বা ঘনত্ব। একইভাবে কণাত্বরক যন্ত্রে অতিপারমাণবিক কণাগুলো নিয়ে কাজ করার সময় মাপা হয় এগুলোর শক্তি বা ভ্রামক। কয়টা কণা ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা কিন্তু গণনা করা হয় না। কারণ, এই গণনার কোনো অর্থ সেখানে নেই।

এভাবেই তৈরি হয় গাণিতিক অবকাঠামো। তারপর সেগুলো নানা ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। যেগুলো টিকে যায়, সেগুলোই গৃহীত হয় গাণিতিক তত্ত্ব হিসেবে। যেমন একটি গোলকের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল পরিমাপের সূত্র ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আর্কিমিডিসের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সঠিক ফল দিয়েছে দেখেই এটি টিকে আছে।

এখান থেকে বোঝা যায়, মানুষ বিভিন্ন তত্ত্ব যেমন প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নিচ্ছে, তেমনি কোন তত্ত্বের জন্য কী ধরনের গাণিতিক অবকাঠামো ব্যবহার করা হবে, সেটাও ঠিক করে নিচ্ছে প্রয়োজনমতো। তারপরও মহাবিশ্বের এমন অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো ব্যাখ্যা করার মতো তত্ত্ব বা মডেল আমাদের কাছে নেই।

কথা হচ্ছে, মানুষ যতই সুবিধামতো বেছে নিক, মহাবিশ্বে আগে সেই নিয়ম তো থাকতে হবে, কাজ করতে হবে। নয়তো সে বেছে নিতে পারবে না। যেমন ধরুন, আলোর গতি। পৃথিবীতে আলোর যে গতি, মহাবিশ্বের দূর, বহুদূর প্রান্তেও আলোর গতি একই। কোনো সাধারণ পরমাণু পৃথিবীতে যে রকম আচরণ করে, মহাবিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গায়, ১৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহেও সেটি একই আচরণ করবে। যে মহাকর্ষ বল পৃথিবীকে সূর্যের চারপাশে ঘোরায়, সেটিই বিভিন্ন গ্যালাক্সিপুঞ্জকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে। এ ধরনের ব্যাপারগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য গড়ে উঠেছে প্রতিসমতার (Symmetry) ধারণা।

পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো স্থান-কালের সাপেক্ষে প্রতিসমতা দেখায়। অর্থাৎ যেকোনো জায়গায় বা যেকোনো সময়ে ঘটা একটি ঘটনা একইভাবে অন্য যেকোনো জায়গায় বা সময়ে ঘটলে এর সব এলিমেন্ট বা ফ্যাক্টর অপরিবর্তিত থাকলে ঘটনাটি একইভাবে ঘটবে। এ জন্যই একটা এক্সপেরিমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে করলে যে ফল পাওয়া যাবে, একই রকম যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ব্যবহার করে বাংলাদেশের একটি গবেষণাগারে করলেও একই ফল পাওয়া যাবে। এই প্রতিসমতা যদি প্রকৃতিতে না থাকত, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার ব্যাপারে গাণিতিক অবকাঠামো, পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব-সূত্র বা সিমুলেশন ব্যবহার করে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না।

বর্তমানে বিজ্ঞানীদের আশা এ রকমই একটি সর্বজনীন প্রতিসমতার গাণিতিক অবকাঠামো খুঁজে বের করা। সুপারসিমেট্রি। সবকিছুর তত্ত্ব।

দুটো প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম আমরা। এক, গণিত কি আসলেই শুধু মানুষের মস্তিষ্কজাত, উদ্ভাবিত কিছু নিয়মকানুন? নাকি বিমূর্ত কোনো রূপে এটি আগে থেকেই ছিল, মানুষ শুধু এর সত্যিটা আবিষ্কার করেছে নিজেদের বোঝার মতো করে? দুই, তাহলে ভবিষ্যৎ অনুমানের ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার যে অবিশ্বাস্য সফলতা দেখায়, কাজ করে, তা কেন ও কীভাবে করে? এখন আমরা এর প্রথমটির উত্তর জানি। গণিত আসলে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের এক চমৎকার যুগলবন্দী। এই ধারণাগুলো উদ্ভাবন করেছে মানুষ। কিন্তু সেটা তারা উদ্ভাবন করতে পেরেছে; কারণ, এসব ধারণা সত্যি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব সম্পর্ক, সবকিছু আগে থেকেই প্রকৃতিতে ছিল আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায়।

দ্বিতীয়টির উত্তর অনেক জটিল। কারণ, মানুষ নিজের মতো যতই যাচাই-বাছাই করে কিছু গ্রহণ বা বর্জন করুক, একটা জিনিসের অস্তিত্ব মহাবিশ্বে না থাকলে, প্রাকৃতিক মৌলিক নিয়মগুলো আগে থেকেই মহাবিশ্বে কাজ না করলে ইচ্ছেমতো গণিত ব্যবহার করে আমরা কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। তাহলে প্রশ্ন আসে, এসব মৌলিক নীতির অস্তিত্ব আছে কেন? কিংবা প্রশ্নটা এভাবেও করা যায়, ‘মহাবিশ্ব কেন কিছু মৌলিক নীতি ও প্রতিসমতা মেনে চলে?’ এর উত্তর আমরা জানি না। কখনো হয়তো জানতে পারব।

গত ২০০ বছরে মানুষের পথচলা এত দূর এগিয়েছে যে এটুকু আশা আমরা করতেই পারি।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, উইকিপিডিয়া