আজ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস বা পাই দিবস। এবারের গণিত দিবসের থিম বা বিষয়বস্তু হলো, ‘সবার জন্য গণিত’। প্রতিবছর মার্চের ১৪ তারিখ সারাবিশ্বে এ দিবসটি আন্তর্জাতিক গণিত দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয় ২০২০ সাল থেকে। ২০১৯ সালে ইউনেস্কো সারা বিশ্বের গণিতবিদদের জন্য ১৪ই মার্চ বা পাই দিবসকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস হিসেবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পাই দিবস পালনের শুরুটা আরও অনেক আগে, ১৯৮৮ সালে। এ প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর নিত্যনতুন থিম নিয়ে সারা বিশ্বে একযোগে এ দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থা প্রথম ২০২০ সালে যে থিম নিয়ে কাজ করেছিল, সেটি হলো ‘গণিত সর্বত্র’। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই যে গণিতের প্রয়োগ দেখা যায়, তা থেকেই এটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবার ২০২১ সালে পুরো বিশ্ব ছিল মহামারি করোনায় আক্রান্ত। খুব সাদামাটাভাবে পালিত হয়েছিল বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি। সে বছরের থিম ছিল ‘একটি উন্নত বিশ্বের জন্য গণিত’। করোনাভাইরাসের বিস্তার, তথা টিকা আবিষ্কারে গাণিতিক মডেল, অ্যালগরিদম এবং জেনেটিক কোডিং করার সময় গণিত ব্যবহারের অপরিহার্যতা মনে রেখেই বিষয়টি ঠিক করা হয়েছিল। আর ২০২২ সালে বিষয় ছিল ‘গণিত সবাইকে এক করে’।
গণিত এমন একটি সার্বিক ভাষা, যা আমাদের সবার দরকার। প্রত্যেককে এর ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্মগুলো সারতে হয়। আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যে মোবাইল ব্যবহার করি, সেই মোবাইলের নম্বর মূলত কতগুলো অংকের সমন্বয়ে তৈরি একটি বড় সংখ্যা। কোনো আয়োজনে আমরা যখন একত্রিত হই, তখনো হিসাব কষা প্রয়োজন হয় কাজটিকে সফল করার জন্য। আসলে করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের যে লাগামহীন উর্দ্ধগতি বিরাজ করতে শুরু করে, তাতে বিশ্বের মানুষকে রক্ষায় নিজেদের একত্রিত করার কোনো বিকল্প ছিল না।
আগেই বলেছি, এ বছর ২০২৩ সালের জন্য বিষয়বস্তু ঠিক করা হয় ‘সবার জন্য গণিত’। আর এটি প্রস্তাব করেন ফিলিপাইনের একজন স্কুল ছাত্র—মার্কো জার্কো রোটাইরো। এই বিষয়টি নির্ধারণের ব্যাপারে তাঁর যুক্তি ছিল, তিনি বিশ্বাস করেন, গণিত সবার জন্য হওয়া উচিত। কারণ, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিভিন্ন মাত্রার স্বাভাবিক কিছু গাণিতিক ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা ব্যক্তি ভেদে একেকজনের একেকরকম। তারপরও আমাদের সবাইকে অবশ্যই গণিতের বিস্ময় উপভোগ করতে হবে। গণিত বিষয়টি শুধু যে প্রতিভাধর এবং প্রতিভাবানদের জন্য বলে আমরা মনে করি, এ ধারণাটির পরিবর্তন হওয়া উচিত। প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আরও অনেকেই আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থায় তাঁদের মতামত পাঠিয়েছিলেন। যেমন কেবট লার্নিং ফেডারেশন, ব্রিস্টল থেকে ফিন ম্যাক্লোলিনের মতে, অনেকে নিজেকে গণিতবিদ মনে করেন না। কিংবা ভাবেন, গণিত তাঁদের জন্য নয়। এরকম কথা হরহামেশাই অনেককে বলতে শোনা যায়। তবে গণিত সবার জন্য। আর প্রত্যেকেই গাণিতিকভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। এসব কিছু মিলিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে এবারের থিমটি।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রান্তিক পর্যায়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণিত নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে গণিতকে একটি ভয়ানক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, যাদের শুধু কিছু নির্দিষ্ট ধরনের গাণিতিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা আছে এবং গণিত নিয়ে গবেষণা করছেন, গণিতের রাজ্যটি শুধু তাঁদের জন্য। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। সকালে উঠেই আমরা জানতে চাই, কয়টায় ঘুম থেকে উঠেছি। এর মাধ্যমে শুরু আমাদের দিনভর গণিত-যাত্রা। তারপর সারাদিন যে বিভিন্ন কাজ করতে হয় আমাদের, তার সঙ্গেও কোনো না কোনোভাবে গণিত জড়িত থাকে। দিনশেষে একজন মানুষ কখন ঘরে ফিরবেন এবং কখন ঘুমাতে যাবেন, তা-ও হয়ে থাকে সময়নির্ভর একটা গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী।
এবার আসি পাই দিবসের কথায়। এই দিবসটি প্রথম উদ্যাপন করা হয় ১৯৮৮ সালে। মজার ব্যাপার হলো, এ দিবসটি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গণিত বিভাগের কোনো বিজ্ঞানী বা শিক্ষকের উদ্যোগে উদ্যাপিত হয়নি। বরং হয়েছিল সান ফ্রান্সিসকোর দ্য এক্সপ্লোরেটরিয়াম নামে একটি বিজ্ঞান জাদুঘরের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে। তাঁর নাম ল্যারি শ। এ কাজের জন্য তাঁকে ‘পাই-এর রাজপুত্র’ উপাধি দেওয়া হয়েছে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি তাঁদের নতুন শিক্ষার্থীদের আবেদনের অ্যাকসেপটেন্স লেটার পাই দিবসে ডাকযোগে বা ইমেইলে পাঠায়। কাকতালীয়ভাবে এ দিনে মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুবরণ করেন এ দিনেই। পাই এর মান মোটামুটিভাবে ৩.১৪১৫৯২৬ পর্যন্ত নিলে আমরা দেখি, কোনো বছরের ৩য় মাসের ১৪ তারিখ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে পাই দিবসের পাশাপাশি পাই মিনিট ও পাই সেকেন্ডও হিসেব করা যায়।
গণিতে পাইয়ের মান দশমিকের পর অসীম পর্যন্ত কোনো পৌনঃপুনিক ক্রম ছাড়াই চলতে থাকে। বৃত্তের পরিধির ব্যাসের অনুপাত নিয়ে পাইয়ের মান গণনা করা হয়। ২০১৯ সালে গুগলের কর্মচারী এমা হারুকা ইওয়াও পাইয়ের মান ৩১ ট্রিলিয়ন অঙ্কে গণনা করে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙেছেন। গণনা করা অঙ্কের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল ৩১,৪১৫,৯২৬,৫৩৫,৮৯৭টি! ২৫টি ভার্চ্যুয়াল মেশিন ব্যবহার করে এ গণনা করতে প্রায় ১২১ দিন সময় লেগেছে। আর গণিতের যে সবচেয়ে সুন্দর সমীকরণ, সেই অয়লার সমীকরণেও পাইয়ের উপস্থিতি আমাদের আনন্দিত করে। এ দিন প্রায়ই মানুষ কেক কেটে বা পাই (পিঠা) খেয়ে দিনটি উদযাপন করে।
এখন প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থার এই দিনটিকে আলাদা করে পালন করার উদ্দেশ্যটা কী? যতদূর জানা যায়, সংস্থাটি মোটামুটি এগারোটি উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী গণিতকে জনপ্রিয় করার কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। যেমন গণিতভীতি দূর করা; শিক্ষায় গণিতের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ জনগণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অবহিত করা; বিজ্ঞানভিত্তিক একটি জাতি গঠনে গাণিতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণিতের ভূমিকা; লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য মেয়েদেরও গাণিতিক সক্ষমতা বাড়ানো; একটি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ এবং সর্বোপরি মানুষের মঙ্গলের জন্য একটি আধুনিক সমাজ গঠনে গণিতের যে ভূমিকা আছে, সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। আমরা দেখতে পাই, এর অনেকগুলোই একটি উন্নত দেশ গঠনে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা, সেগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। বাংলাদেশ যে ২০৪১ সালে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে, তা সফল করতে হলে আমাদেরকেও আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থার উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে সমানতালে কাজ করতে হবে। আমরা যার যার জায়গা থেকে যেটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে গেলেই মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।
আমাদের সবার জীবন পাইয়ের মতো সুন্দর হোক। সুখ-সাচ্ছন্দ্যগুলো পর্যাবৃত্ত হোক দশমিকের পরের পাইয়ের অংকগুলোর মতো।
লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)