ক্যালকুলাসের হাতেখড়ি: ফাংশন
‘Old mathematicians never die, they just lose some of their functions.’
ক্যালকুলাস নিয়ে আগে একটা মজার গল্প বলি৷ অঙ্কের এক জাঁদরেল অধ্যাপক তাঁর সাধের ক্যালকুলাস বই হারিয়ে বেজায় রেগে গেছেন৷ তাঁর ধারণা, বইটি চুরি করা হয়েছে এবং এটা কোনো দুষ্টু শিশু বা ছেলের কাণ্ড৷ শিশুরা যখন পার্কে খেলাধুলা ও হইচই করছে, তখন খ্যাপা অধ্যাপক হঠাৎ ওখানে হাজির হয়ে বলতেন, ‘দেখাচ্ছি মজা, আমি তোদের ডিফারেন্সিয়েট (differentiate) করে ছাড়ব৷’ ‘ডিফারেন্সিয়েট’ মানে কী, সে তো শিশুরা জানে না, ওরা তো আর ক্যালকুলাস শেখেনি, তাই সবাই ভয় পেয়ে পালিয়ে যেত৷ অধ্যাপকের অত্যাচারে এলাকার ছেলেমেয়েদের হাসি-গান-হুল্লোড় সব বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো৷ শিশুদের দুর্দশা দেখে পাড়ার এক কিশোরী ওদের পক্ষ হয়ে লড়াই করতে এগিয়ে এল বীরবেশে৷ মেয়েটি ক্যালকুলাস জানে৷ ও শিশুদের কানে কানে শিখিয়ে দিল অধ্যাপককে ঘায়েল করার মন্ত্র৷ এরপর অধ্যাপক পার্কে গন্ডগোল বাধাতে এলেই শিশুরা সবাই মিলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলত, ‘হা, হা, হে, হে! জানো তুমি আমরা কে? আমরা হচ্ছি এক্সপোনেনশিয়াল ফাংশন (exponential function), আমরা ডিফারেন্সিয়েট করাকে ভয় করি না৷ আমাদের যত খুশি ডিফারেন্সিয়েট করতে পারো, ওতে আমাদের কিচ্ছু হয় না৷’ এরপর থেকে পাগলা অধ্যাপক আর শিশুদের জ্বালাতন করতেন না৷
এ গল্পটির রস পেতে হলে ফাংশন, ডিফারেন্সিয়েট, ক্যালকুলাস, এক্সপোনেনশিয়াল শব্দগুলোর অর্থ জানতে হবে৷ ক্যালকুলাস হলো গণিতের এক শাখা, আর গণিত হলো একধরনের ভাষা বা খেলা৷ অঙ্ক নিয়ে তোমার মনে যদি অকারণ ভয় থাকে, তবে তোমার অবস্থা ওই শিশুদের মতো! কিশোরীর মতো কেউ যদি তোমার কানে কানে অঙ্কের গোপন কথাটি ফাঁস করে দেয়, তবে সব ভয় দূর হয়ে যাবে৷ প্রথমেই ফাংশন কথাটির অর্থ বোঝা যাক৷ শুধু ক্যালকুলাস নয়, গণিতের প্রতিটি শাখায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷ যাঁরা গণিত, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন, ‘ফাংশন’ তাঁদের জীবনের নিত্যসঙ্গী৷ তবে আগেই বলে রাখা ভালো যে অঙ্কের ফাংশন কোনো কাজ বা গানের অনুষ্ঠান নয়৷
একটা ঢালু পথ বেয়ে ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠছেন৷ যেদিকে চলেছেন তাকে x এবং ওপরের দিকটাকে y বলে ডাকা যাক৷ আপনি যতই হাঁটছেন x ততই বাড়ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে y বাড়ছে৷ বোঝাই যাচ্ছে যে y ও x–এর মাঝে একটা সম্পর্ক আছে৷ অঙ্কের ভাষায় এই সম্পর্ককে ফাংশন বলে এবং একে y=f (x) হিসেবে লেখা হয়৷ অঙ্কে সবকিছু সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়৷ ফাংশন শব্দটি হয়ে গেছে f এবং y=f (x) সমীকরণটির অর্থ, y হলো x–এর ফাংশন৷ যেমন y=x একটি সমীকরণ এবং এখানে f(x)=x এবং x এবং y–এর মাঝের সম্পর্কটা বেজায় সোজা, x যদি ১ হয়, তবে y–এর মান ১ হবে, x যদি ৫ হয়, তবে y–এর মান ৫ হবে ইত্যাদি৷ আপনি যে ঢালু রাস্তা দিয়ে ওপরে উঠছেন, তার সম্পর্ক যদি এমন হয় তাহলে বলা যাবে, x দিকে (সামনে) ৫ ফুট চললে আপনি y দিকে (ওপরে) ৫ ফুট উঠবেন৷ এবারে ‘সম্পর্কহীন’ সম্পর্কের কথা ধরা যাক! y=০ একটি সমীকরণ, এখানে f(x)=০, যে পথে আপনি চলেছেন, সেটা সমতল, ঢালু নয়৷ আপনি সামনের দিকে যতই চলুন, একটুও ওপরে উঠতে পারবেন না, x এবং y–এর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই৷
মাছ, মাংস, সবজি, চাল, ডাল, হলুদ, লবণ, মসলা, পেঁয়াজ, হাতা, খুনতি, কড়াই, বঁটি, হাঁড়ি দিয়ে রান্নার কাজ সারতে হয়৷ এসব ব্যবহার করে একজন রাঁধুনি পছন্দসই যেকোনো খাবার বানিয়ে দিতে পারেন৷ একজন বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীকে তেমনি বিভিন্ন ফাংশন নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়৷ আজকাল এক বা একাধিক কম্পিউটারের জটলা হলো একজন তাত্ত্বিক গবেষকের রান্নাঘর, বিভিন্ন ফাংশন এবং আইনকানুন মিশিয়ে ওখানে প্রতিদিন তিনি হরেক রকমের খাবার বানান৷ এই খাবার হলো কোনো নতুন চিন্তা, কোনো নতুন উপায়, নকশা, মডেল, সমীকরণ, আইন বা কোনো পুরোনো সমস্যার নতুন সমাধান৷ একেই বলে গবেষণা! কম্পিউটারের সাহায্যেই ওই রান্না চেখে দেখা হয়৷ সাধ ভালো হলে বা অভিনব কিছু হলে তিনি এ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন৷ অনেক ধরনের ফাংশন আছে, যেমন বীজগণিতের ফাংশন, ত্রিকোণমিতির ফাংশন, বিশেষ ফাংশন, বেসেল ফাংশন, গামা ফাংশন, বিবাগী (transcedental) ফাংশন, আর কোয়ান্টাম তত্ত্বে আছে ওয়েভ ফাংশন৷ কয়েকটি সহজ ফাংশন নিচে লেখা যাক৷
(1) y=ax+b,
(2) y=sin(x),
(3) y=exp(x),
(4) y=N exp(-x)
প্রথমটি একটি সরলরেখা, দ্বিতীয়টি ত্রিকোণমিতির, তৃতীয়টি এক্সপোনেনশিয়াল এবং চতুর্থটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সবচেয়ে কাছের ইলেকট্রনের ওয়েভ ফাংশন৷ প্রতিটি সমীকরণ y ও x–এর মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, তা ফাংশনটি অঙ্কের ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছে৷ ৪ নম্বর সমীকরণে হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে y–কে গ্রিক অক্ষর ‘সাই’ দিয়ে লেখা হয় এবং ওকে ওয়েভ ফাংশন বলে৷ সেই সঙ্গে x–কে বদলিয়ে r লেখা হয় এবং r হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রনের দূরত্ব৷
ফাংশনের গ্রাফ আঁকলে এই সম্পর্ক আরও ভালো করে বোঝা যায়৷ যদি প্রথম সমীকরণে a=২ ও b=৩ হয়, তাহলে y=২x+৩ এবং এই সমীকরণে x–এর মান ০, ১, ২ হলে y–এর মান ৩, ৫ এবং ৭ হবে৷ x ও y–এর এই মানগুলো দিয়ে গ্রাফ আঁকলে একটি সরলরেখা পাওয়া যাবে৷ দ্বিতীয় সমীকরণের গ্রাফ আঁকলে দেখা যাবে যে x–এর সঙ্গে y–এর মান ঢেউয়ের মতো ক্রমাগত বাড়ছে এবং কমছে৷ ঢেউকে অঙ্কের তুলি দিয়ে আঁকতে গেলে এ ধরনের ফাংশন ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে৷ তৃতীয় সমীকরণটির গ্রাফ আঁকলে দেখবে যে x–এর সঙ্গে সঙ্গে y লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে৷ এমন ভয়াবহ সম্পর্ক কাম্য নয়, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য এমনটি ঘটতে দেওয়া যেতে পারে৷ একেই এক্সপোনেনশিয়াল ফাংশন বলে, যার কথা শিশুদের মুখে শুনে গণিতের পাগলা অধ্যাপক ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন!
৪ নম্বর সমীকরণে হাইড্রোজেন পরমাণুর সবচেয়ে কাছের ইলেকট্রনের কক্ষপথকে (ওকে 1s বলা হয়) একটি এক্সপোনেনশিয়াল ফাংশন দিয়ে লেখা হয়েছে৷ তবে ভ্যারিয়েবলিটি নেগেটিভ৷ x বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে exp(x) যেমন প্রচণ্ড বেগে বাড়ে, exp(-x) তেমনি প্রচণ্ড বেগে কমে৷ কোয়ান্টাম তত্ত্বে ওয়েভ ফাংশনের বর্গ হলো অস্তিত্বের সম্ভাবনার ঢেউ৷ তাই নিউক্লিয়াস থেকে যতই দূরে যাওয়া যাবে, x ততই বাড়বে, exp(-x) এবং সেই সঙ্গে ইলেকট্রনটি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ততই দ্রুত কমে যাবে৷ তবু দূরত্ব অসীম না হওয়া পর্যন্ত সম্ভাবনাটি শূন্য নয়৷ একটি ইলেকট্রন যেন সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে! ধরতে গেলে ওকে যেকোনো স্থানে পাওয়া যেতে পারে৷ তবে নিউক্লিয়াসের কাছে ওকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি৷ যেহেতু তুমি আর আমি কতগুলো পরমাণুর সমষ্টি, তাই আমরাও একে অপরের মাঝে এবং সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে আছি!
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র