গণিতবিদ প্রাণীরা

ঘুম আসছে না? ভেড়া গুনতে থাকুন উল্টো দিক থেকে ১০০, ৯৯...১, ০। ঘুম নেমে আসবে দুই চোখে। কিন্তু যদি ভেড়াদের ঘুম না আসে? তবে কি তারা মানুষ গোনে? পশুপাখিরা কি আসলে গুনতে পারে?

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। স্কুল-কলেজে অঙ্কভীতি কম-বেশি সবার থাকে। বীজগণিত, পাটিগণিতের মারপ্যাঁচে কতজন যে পরীক্ষার খাতায় বড় বড় গোল্লা পেয়েছেন তার হিসাব নেই। তবে পশুপাখিদের হিসাব-কিতাবের দক্ষতা সম্পর্কে জানলে মানুষ হিসেবে আমরা বোধ হয় অবাকই হব।

ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টিয়ানো অ্যাগ্রিলো প্রাণীদের গণিত-দক্ষতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। মুরগি, ঘোড়া, কুকুর, বানর এমনকি অমেরুদণ্ডী মৌমাছি, মাকড়সারও সংখ্যাজ্ঞান আছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

দুই এক্কে দুই, দুই দুগুণে চার...এভাবে নিশ্চয়ই পশু-পাখিরা নামতা মুখস্থ করে না। তাহলে তারা কীভাবে অঙ্ক শেখে? তাদের অঙ্কের মাস্টারই বা কে? কেউ কেউ বলে, পূর্বপুরুষ থেকে গণিতের জ্ঞান লাভ করে প্রাণীরা। আবার কারও মতে, গণিতের ধারণা বংশগত নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তারা গণিতের সাহায্য নেয়।

আসলে ১, ২, ৩, ৪—এ রকম সংখ্যার ধারণা পশুপাখিদের নেই। তারা কেবল সংখ্যাতত্ত্বের ধারণার ওপর ভিত্তি করে সমস্যার সমাধান করে। কুকুরদের ওপর গবেষণা করে জানা গেছে, কোনো কিছু সংখ্যায় কতটি আছে, সেই বিচার করতে পারে না এরা। বরং সেগুলো কতখানি জায়গা দখল করল, তা খেয়াল করে। তবে সেডোনা নামের এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর আবার অন্য ধারণা দেয়। লন্ডনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন ক্রিস্টা ম্যাকফারসন। তিনিই সেডোনাকে নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি কুকুরের সামনে দুটি ম্যাগনেটিক বোর্ড রাখলেন। প্রতিটি বোর্ডে বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতির বস্তু সেঁটে দেওয়া হলো, একটি বোর্ডে কম পরিমাণ, অন্যটিতে বেশি। এরপর সেডোনাকে বলা হলো, বেশি পরিমাণ বস্তু সাঁটা বোর্ডকে বেছে নিতে। সেডোনা সফলতার সঙ্গে বেশি বস্তুর বোর্ডটিকে বেছে নিল। ভিন্ন ভিন্ন জ্যামিতিক আকার তাকে দ্বিধায় ফেলতে পারেনি। এর মানে, পৃষ্ঠতলকে উপেক্ষা করেই পশুরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মারিয়া এলিনা কুকুর নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেন। একটি কুকুরের সামনে সমান আকৃতির দুটি প্লেট রাখলেন। একটিতে বড় আকৃতির কয়েক টুকরা খাবার দেওয়া হয়। আরেকটি প্লেটে খাবারের টুকরার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যদিও টুকরার আকৃতি ছিল ছোট।

এরপর কুকুরটিকে দুটি প্লেটের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হলো, সে দ্বিতীয় প্লেটটি বেছে নেয়। এতে ধারণা করা যায় যে পশুরা হয়তো মোট পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়।

পাটিগণিত জানা মুরগিছানা

হালকা হলুদ ছোট্ট মুরগিছানারা নাকি অঙ্ক কষতে জানে! রয়্যাল সোসাইটি জার্নালে এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন ট্রেনটো বিশ্ববিদ্যালয়ের রোসা রুগানি। সদ্য ডিম ফুটে বের হওয়া মুরগিছানার অঙ্ক কষার পারদর্শিতা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি আর তাঁর দল মুরগিছানাদের নিয়ে গবেষণা করছেন। ছানাগুলোর জন্মের পর থেকেই ঠিক মুরগি আকৃতির ৫টি বস্তু রেখেছেন সেগুলোর সাথে। তাঁরা চেয়েছিলেন, ছানারা যাতে কৃত্রিম বস্তুগুলোর সঙ্গে সামাজিকভাবে মিশে যেতে পারে। ধীরে ধীরে ৫টি বস্তুকে ছানারা তাদের মা ভাবতে শুরু করে। এরপর ছানাদের আলাদা করে পরীক্ষা করা হয়। মুরগি আকৃতির বস্তুগুলোর সঙ্গে একই রকম আরও কিছু বস্তু যোগ করা হয়। তারপর সবগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটা ভাগে বস্তুর সংখ্যা অনেক কম, আরেকটায় বস্তুর সংখ্যা বেশি। এই দুই ভাগের মাঝে মুরগিছানাগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়। দেখা যায়, ছানারা বড় দলের কাছে গিয়ে ঘেঁষেছে। কারণ তারা জানে, মা ১টি বা ২টি বস্তুবিশিষ্ট দলের মতো দেখতে নয়, বরং ৪-৫টি বস্তুর বড় দলের মতো।

একপলকে অঙ্ক কষা

১, ২ বা ৩ গুনে পশুপাখিরা হিসাব করে না। তারা মনে মনে আপেক্ষিক একটা গণনা করে। সেই গণনা কেমন হয়, তা আমরা একটা সূত্র দিয়ে বুঝতে পারি। সূত্রটিকে বলা হয় ওয়েবারের সূত্র। তাত্ত্বিক সূত্রে না গিয়ে বরং দুটি ছবি দিয়ে সূত্রটিকে বোঝার চেষ্টা করি।

কোন বৃত্তে বেশি বিন্দু?

ছবি ১-এ দুই জোড়া বৃত্ত একঝলকে দেখে না গুনেই বলে দেওয়া যায় বাঁ পাশের বৃত্তে বিন্দুর সংখ্যা বেশি। কিন্তু চিত্র ২-এর ক্ষেত্রে এভাবে বলা সম্ভব নয়। একটা একটা করে বিন্দু গুনে বলতে হবে ডান পাশে ৯টি আর বাঁ পাশে ৮টি বিন্দু, মানে ডান পাশের বৃত্তে বেশি বিন্দু আছে। ওয়েবারের সূত্র আমাদের বলে, ৮ বনাম ২-এর পার্থক্য সহজে ধরতে পারলেও ৮ বনাম ৯-এর পার্থক্য বোঝা অত সহজ নয়। পশুপাখিরা ৮ বনাম ২-এর পার্থক্য নির্ণয়ের মতো ১, ২, ৩ করে না গুনেই সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পায়।

মস্তিষ্কের গুণনক্ষমতা

জার্মানির আন্দ্রেস নাইডার প্রাণীদের আচরণের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগসূত্র খুঁজতে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, দুটি প্রাণী যখন একই রকম আচরণ করে, তখন তাদের দুটির মস্তিষ্ক দুই রকমভাবে কাজ করতে পারে। যেমন ক্ষুদ্র মাছি ও স্তন্যপায়ী বাদুড়—দুটিই উড়তে পারে। তবে ওড়ার ক্ষেত্রে দুটির মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন সিগন্যাল অনুযায়ী কাজ করে।

আন্দ্রেস নাইডার পরীক্ষা করেছেন, কীভাবে বানর ও পাখির মস্তিষ্ক পরিমাণগত বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করে। তিনি ম্যাকক বানরের সঙ্গে ক্যারিয়ন কাকের স্নায়ুকোষের তুলনা করেছেন। সংখ্যা বিশ্লেষণের সঙ্গে জড়িত স্নায়ুকোষ চিহ্নিত করেছেন। নাম দিয়েছেন নম্বর নিউরন বা সংখ্যা স্নায়ুকোষ। তিনি বলেছেন, যখন প্রাণীরা সংখ্যায় একটা জিনিস চিহ্নিত করে, তখন একটি বিশেষ গ্রুপের স্নায়ুকোষ উত্তেজিত হয়। আবার দুটি জিনিস নির্দেশ করলে ভিন্ন গ্রুপের স্নায়ুকোষ উত্তেজিত হয়। একইভাবে অপর কোনো ভিন্ন গ্রুপের স্নায়ুকোষের উত্তেজনায় তিনটা জিনিস গুনতে পারে।

মস্তিষ্কে এই স্নায়ুকোষগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে। যেমন বানরের ক্ষেত্রে নম্বর নিউরনগুলো নিওকর্টেক্সে অনেক স্তরে বিভক্ত। মস্তিষ্কের এই জায়গা সংখ্যা বিশ্লেষণের মতো জটিল কাজগুলো করে। পাখিদের এমন বহুস্তরের নিওকর্টেক্স থাকে না। নাইডার ও তাঁর সহকর্মীরা পাখিদের মাথায় ভিন্ন রকমের নিউরন আবিষ্কার করেছেন, যা বানরের নম্বর নিউরনের মতোই কাজ করে।

নাইডার এভাবে নিশ্চিত করেছেন, নম্বর নিউরন সবার মস্তিষ্কে থাকলেও একেকটির জন্য একেকভাবে নিউরনগুলো বিশেষায়িত কাজ করে। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিজাবেথ ব্র্যানন রেসাস বানরের গাণিতিক দক্ষতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিটি প্রাণীই জন্মগতভাবে গণিতবিদ। গুনতে পারার ক্ষমতা প্রাণিকুলের প্রতি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর উপহার। গণিত শিক্ষকদের প্রতি তাঁর উপদেশ, প্রচলিত কারিকুলামে যে বয়সে বাচ্চাদের অঙ্ক শেখানো হয়, তার থেকে একটু আগেভাগেই যেন তাদের গণিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত