গণিতে শূন্য কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা
শূন্যকে একসময় সংখ্যাই মনে করা হতো না। সবচেয়ে শক্তিশালী সংখ্যা ভাবার তো কোনো কারণই নেই। শূন্যকে সংখ্যার মর্যাদা পেতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি, প্রতিটি সংখ্যাই আদতে শূন্য দিয়ে গঠিত। কীভাবে?
একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। গণিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা কোনটি? কী উত্তর দেবেন? ১, ২ নাকি ১০? অসীম সংখ্যার এই দুনিয়ায় সেরা সংখ্যা বেছে নেওয়া কঠিন। কিন্তু প্রশ্নটা যদি আমাকে করতেন, এক সেকেন্ডও না ভেবে বলতাম শূন্য। শুনে হতো অবাক লাগছে। কিন্তু গণিতে শূন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। কেন, তা-ই বলছি এই লেখায়।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনের মানুষেরা সংখ্যা লেখার জন্য লিপি ব্যবহার করত। অনেকটা দাগ কেটে গোনার মতো। এক ধরনের চিহ্ন দিয়ে তারা ১-৯ পর্যন্ত লিখত, আরেক ধরনের চিহ্ন দিয়ে ১০, ২০, ৩০ গুনত। এই পদ্ধতিতে তারা ১ থেকে ৫৯ পর্যন্ত গুণতে পারত। কিন্তু ৬০ পর্যন্ত গেলেই বাধত ঝামেলা। কারণ, তাদের লেখার পদ্ধতিতে ১ এবং ৬০ দেখতে একই রকম ছিল!
তারা ৬০ পর্যন্ত গোনার পরে আর ৬১ গুনতে পারত না। এরপর শুরু করত আবার ১ থেকে। তখন ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি বেশ সুবিধাজনক ছিল। কারণ, ৬০ সংখ্যাটিকে অনেক সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায়। এই কারণেই আজও আমরা সময় গুনতে ৬০ ব্যবহার করি। যেমন, এক মিনিটে ৬০ সেকেন্ড, এক ঘণ্টায় ৬০ মিনিট। কিন্তু ১ এবং ৬০ দেখতে যেহেতু একইরকম ছিল, তাই মাঝেমধ্যেও ঝামেলা দেখা যেত। ধরুন, কেউ হয়তো ১টি রুটি চেয়েছে, কিন্তু দোকানি কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তাকে ১টি রুটি দেবে নাকি ৬০টি!
এই সমস্যার সমাধান হিসেবেই জন্ম হলো শূন্যের। অথবা শূন্যের মতো কিছু একটার। তবে শূন্য কিন্তু তখনো সংখ্যার কৃতিত্ব পায়নি। শূন্য ছিল শুধু একটা চিহ্ন। বইয়ের দুটি শব্দের মাঝে যেমন স্পেস বা ফাঁকা জায়গা থাকে, শূন্য ছিল অনেকটা সেরকম। ব্যাবিলনীয়রা কোনো সংখ্যার অনুপস্থিতি বোঝাতে দুটি কোণাকুণি কীলক ব্যবহার করত। এতে অন্য সংখ্যাগুলো সঠিক জায়গায় বসানো যেত, ঠিক যেমনটা এখন আমরা করি।
একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আধুনিক পদ্ধতিতে ৩৬০১ মানে তিন হাজার ছয় শ এক। ব্যাবিলনীয়রা লিখত ষাটটি ষাট, শূন্যটি দশ এবং একটি এক। শূন্যের এমন চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার হাজার বছর ধরে অনেক প্রাচীন সভ্যতায় ব্যবহার হয়েছে। যদিও ওটার নাম শূন্য ছিল না এবং এখন আমরা শূন্যকে যেভাবে ব্যবহার করি, প্রাচীনকালের শূন্যের সেরকম ব্যবহারও ছিল না। ফলে ওটাকে অন্তত শূন্য বলা যায় না। ফাঁকা জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত একটা চিহ্ন বলা যায়।
তবে সবাই এই ফাঁকা জায়গাও ব্যবহার করত না। যেমন রোমানদের সংখ্যা পদ্ধতিতে কোনো ফাঁকা জায়গা বা শূন্যের ব্যবহার ছিল না। কারণ রোমান সংখ্যা পদ্ধতিতে X মানে ১০ বোঝায়, সেটা যেখানেই থাকুক না কেন।
শূন্যকে সত্যিকারের সংখ্যার মর্যাদা দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ। সেজন্য অবশ্য আরও কয়েক শ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথমবার সংখ্যা হিসেবে শূন্যের ব্যবহার দেখা যায় ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত নামে একটি বইয়ে। বইটির লেখক ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই বই লিখেছিলেন। তার আগে অনেকেই জানতেন, ২ থেকে ৩ বিয়োগ করলে অদ্ভুত কিছু ঘটে। কিন্তু এরকম হিসাব তখন বাজে কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো। অর্থাৎ, ঋণাত্মক সংখ্যার ব্যবহার তখনো শুরু হয়নি।
ব্রহ্মগুপ্তই প্রথমে বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। তিনি ঋণাত্মক সংখ্যা এবং শূন্য নিয়ে গাণিতিক নিয়ম বর্ণনা করলেন। শূন্যকে নিয়ে তাঁর সংজ্ঞা আমাদের আধুনিক ধারণার কাছাকাছি, শুধু একটা জিনিস ছাড়া। শূন্য দিয়ে ভাগ করলে কী হয়, তা জানতেন না ব্রহ্মগুপ্ত। তিনি ভাবতেন, শূন্যকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে শূন্য হয়। অর্থাৎ, ০/০ = ০। আবার অন্য যেকোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে কী হবে, তা নিয়েও তিনি দ্বিধায় ছিলেন। তবে একটা সংখ্যা থেকে সেই সংখ্যা বিয়োগ করলে যে শূন্য হয়, এটা ব্রহ্মগুপ্ত দেখিয়েছেন।
ব্রহ্মগুপ্তের এই শূন্যের ধারণা মধ্যযুগে আরবের গণিতবিদেরা গ্রহণ করেন এবং ব্যবহার করতে শুরু করেন। অনেক পরে আরব বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে শূন্যের ব্যবহার শেখেন ইউরোপের পণ্ডিতরা। এভাবেই সারা বিশ্বের শূন্যের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।
যাই হোক, শূন্য দিয়ে ভাগ করলে কী হয়, এই প্রশ্নের সত্যিকারের উত্তর আসতে আরও হাজার বছর লেগেছে। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়েছে ক্যালকুলাসের সাহায্যে। সপ্তদশ শতকে আইজ্যাক নিউটন এবং গটফ্রিড উইলহেম লিবনিজ স্বাধীনভাবে ক্যালকুলাস উদ্ভাবন করেন। ক্যালকুলাসে ব্যবহৃত হয় অসীম ক্ষুদ্র সংখ্যা। সেগুলো শূন্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি কিন্তু আসলে শূন্য নয়।
এই বিষয়টাও একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। ধরুন, আমরা একটা গাড়ি চালাচ্ছি। গাড়ি ক্রমশ দ্রুত চলছে, আর আপনি ধীরে ধীরে এক্সিলারেটর চেপে গতি বাড়াচ্ছেন। ৪ সেকেন্ড পরে আপনার বেগ হবে প্রতি সেকেন্ড ১৬ মিটার। এখন যদি প্রশ্ন করি, ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কতটা দূরত্ব পার করেছেন, উত্তর দিতে পারবেন? সাধারণ গুণ-ভাগ দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ, প্রতি মুহূর্তে আমাদের গাড়ির গতি বেড়েছে। গাড়ি যদি সবসময় একই গতিতে চলত, তাহলে এটা সহজে বের করা যেত। দূরত্ব = গতি × সময় সূত্র ধরেই বের করতে পারতাম, ১৬ × ৪ = ৬৪। কিন্তু এটা সঠিক নয়। কারণ আমরা সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছেছি একদম শেষ সময়ে।
এই সমস্যার সমাধানে নিউটন ব্যবহার করলেন এক অদ্ভুত ট্রিক। তিনি সময়কে টুকরো করতে করতে শূন্যের একদম কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। একে বলে ইনফিনিটাসিমাল বা অসীমের ক্ষুদ্রতম রূপ। সোজা কথায়, শূন্যের খুব কাছের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যাবে কিন্তু শূন্যতে যাওয়া যাবে না।
প্রথমে একদম স্বাভাবিক নিয়মে আমরা দূরত্ব পেয়েছিলাম ৬৪ মিটার। এবার সময়কে দুটি ভাগে ভাগ করে দেখা যাক। প্রথম ২ সেকেন্ড ৪ মিটার গতিতে, তারপর ২ সেকেন্ড ১৬ মিটার গতিতে। তাহলে দূরত্ব হবে ৪ × ২ + ১৬ × ২ = ৪০ মিটার। কিন্তু এটাও একদম সঠিক উত্তর নয়, তবে আগেরটার চেয়ে ভালো।
বুঝতেই পারছেন, একদম নিখুঁত মাপ পেতে হলে সময়ের ব্যবধান আরও কমাতে হবে। আমাদের প্রত্যেক মুহূর্তের গতি দিয়ে প্রত্যেক মুহূর্তের সময় গুণতে হবে। আর এখানেই আমরা শূন্যের মুখোমুখি হবো। আপনি যদি v = t²-কে একটা গ্রাফে আঁকেন এবং আমাদের আগের হিসাবগুলো তাতে বসান, দেখবেন প্রথমটা খুব একটা মিলছে না, তবে দ্বিতীয়টা একটু ভালো। সবচেয়ে নিখুঁত মাপ পেতে হলে যাত্রাটা এত ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করতে হবে যে প্রতিটা টুকরোর সময় শূন্য সেকেন্ড লম্বা। তারপর সব যোগ করতে হবে। কিন্তু একদম শেষে গেলে তো শূন্য দিয়ে ভাগ করা। এটা তো করা যাবে না। তাই শূন্যের একদম কাছাকাছি সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে হবে।
নিউটন আর লিবনিজ এমন কৌশল বের করলেন, যাতে শূন্যের কাছাকাছি সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যাবে। এই পদ্ধতিতে পাওয়া যায় ২১ এবং ১/৩ মিটার দূরত্ব। ওপরের গ্রাফটা দেখলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে।
তবে শুধু গাড়ির দূরত্ব মাপার জন্যই ক্যালকুলাস ব্যবহৃত হয় না। এটা গণিতের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলেও পদার্থবিজ্ঞান থেকে রসায়ন, অর্থনীতি থেকে প্রকৌশল পর্যন্ত সবখানে ক্যালকুলাস ব্যবহৃত হয়। আর এই সবই সম্ভব হয়েছে শূন্যের কারণে, এর অসাধারণ শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য।
এবার বোঝার চেষ্টা করি, শূন্য কেন সব সংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে গণিত অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গিয়েছিল। গণিতবিদেরা কিছু বিপজ্জনক ফাঁক খুঁজে পাচ্ছিলেন। সেগুলো সমাধান করতে গণিতবিদেরা গাণিতিক বস্তুর সংজ্ঞা দিতে শুরু করেন। তখন এমন কিছু বিষয়ের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, যেগুলোকে আগে মনে করা হতো, আনুষ্ঠানিকভাবে সংজ্ঞা দেওয়ার দরকার নেই। এরমধ্যে সংখ্যাও আছে।
সংখ্যা আসলে কী? এটা কোনো শব্দ নয়, যেমন তিন। কোনো চিহ্নও নয়, যেমন ৩। কারণ, এগুলো শুধু নাম। একটা আপেল, একটা নাশপাতি আর একটা কলা দেখিয়ে বলতে পারি, এই বাটিতে তিনটি ফল আছে। কিন্তু সেটাও এর মৌলিক প্রকৃতি বোঝায় না। আমাদের এমন কিছু দরকার যেটা বিমূর্তভাবে গোনা যায়। যাকে আমরা ‘তিন’ বলতে পারি। আধুনিক গণিত ঠিক এই কাজটাই করে শূন্য দিয়ে।
এ জন্য গণিতবিদরা সেট বা সমষ্টির কথা বলেন। যারা বিদ্যালয়ে সেটের অঙ্ক করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, যেকোনো সেট শুরু হয় ফাঁকা সেট দিয়ে। ফলের উদাহরণটা হবে {আপেল, নাশপাতি, কলা}। সব গাণিতিক বস্তুকে শেষ পর্যন্ত সেটের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বর্ণনা করতে হয়, যাতে যৌক্তিক সংগতি থাকে এবং ভিত্তির যেসব ফাঁক গণিতবিদরা খুঁজে পেয়েছিলেন সেগুলো এড়ানো যায়।
সংখ্যাকে সংজ্ঞায়িত করতে গণিতবিদরা শুরু করেন ‘শূন্য সেট’ দিয়ে। অর্থাৎ, যে সেটে শূন্যটি বস্তু আছে। একে {} চিহ্ন দিয়ে লেখা যায় কিন্তু আরও সহজভাবে লেখা হয় ∅ চিহ্ন দিয়ে। একবার খালি সেট পেয়ে গেলে, আমরা বাকি সংখ্যাগুলো সংজ্ঞায়িত করতে পারি। এক মানে হলো এমন একটি সেট, যেখানে একটি বস্তু আছে। তাহলে খালি সেট মানে {{}} বা {∅}। পরের সংখ্যা দুইয়ের জন্য দুটি বস্তু দরকার। প্রথমটা হতে পারে খালি সেট, কিন্তু দ্বিতীয়টা? আমরা তো ইতিমধ্যে আরেকটা বস্তু তৈরি করে ফেলেছি যখন এক সংজ্ঞায়িত করেছিলাম। তাহলে সেটা ব্যবহার করি। ফলে দুই সংজ্ঞায়িত করার সেট দেখতে হবে {∅, {∅}}। তিন হবে {∅, {∅}, {∅, {∅}}}। এভাবে আপনি যত ইচ্ছা চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, আপনি যেকোনো বড় সংখ্যাকে ভাঙলে তার গভীরে শুধু শূন্য আর শূন্যই পাবেন।
অন্যভাবে বলতে গেলে, শূন্য শুধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা নয়, একমাত্র সংখ্যা। কারণ, যেকোনো সংখ্যার ভেতরে উঁকি মারলে সেখানে শুধু শূন্যই দেখবেন, যেমনটা আমরা ওপরে তিনটা সেটে দেখলাম।
শূন্য আসলে গণিতের গল্প। একটা সাধারণ চিহ্ন থেকে শুরু করে শূন্য হয়ে উঠেছে পুরো গণিতের মেরুদণ্ড। শূন্য ছাড়া ক্যালকুলাস অসম্ভব, শূন্য ছাড়া আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অচল, শূন্য ছাড়া মহাকাশ অভিযান থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন পর্যন্ত সবই অচল। এজন্যই শুরুতে বলেছিলাম, আমার কাছে শূন্যই গণিতের সবচেয়ে সেরা সংখ্যা!
