গুণের সহজ কৌশল

আমার ভাইয়ের মেয়ে থিয়া। বয়স ১০। বাসায় গেলেই ওর প্রশ্নের শেষ নেই। চাচ্চু, বৃষ্টি পড়ে কেন? উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলবে, তাহলে আকাশে মেঘ কেন হয়? এরকম নানান প্রশ্ন। থিয়া থেকে বাঁচার একটা কৌশল বের করলাম। ওকেই প্রশ্ন করলে কেমন হয়? বললাম, আচ্ছা বলো তো, ১৩-এর সঙ্গে ১৪ গুণ করলে কত হয়? থিয়ার মুখটা যেন চুপসে গেল। এমন একটা ভাব ধরল যেন এরকম প্রশ্ন ও জীবনেও শোনেনি। কাছে এসে  বলল, চাচ্চু বলো তো, ডিম আগে না মুরগি আগে? আমি ওর চালাকি ধরে ফেলেছি। বললাম, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তাহলে আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেব।

থিয়া বলল, এটা কোনো প্রশ্ন হলো? গুণ কি মুখে মুখে করা যায়? এর জন্য দরকার খাতা-কলম। সেগুলো তো আছে পড়ার টেবিলে। তুমি বরং বলো, ডিম আগে এসেছে নাকি মুরগি? থিয়াকে বললাম, সব সময় অঙ্ক করতে খাতা-কলম লাগে না। মাঝেমধ্যে খাতা-কলম ছাড়াই অঙ্ক করা যায়। এজন্য তোমাকে কিছু গাণিতিক কৌশল শিখতে হবে। শিখবে?

থিয়া কোনো ভাবেই অঙ্ক শিখতে রাজি হয় না। ওর নাকি অঙ্কের নাম শুনলে শরীর কেমন গরম গরম লাগে। মাথা কাজ করে না। থিয়াকে আশ্বস্ত করলাম, আমি তোমাকে যে অঙ্ক শেখাব, তাতে ভয়ের কিছু নেই। তুমি বরং মজা পাবে, সহজে গুণ করতে পারবে। কোনোরকম আমতা আমতা করে সে শিখতে রাজি হলো।

আচ্ছা মামুনি, তুমি কি বলতে পারো গুণ কী? থিয়া বলল, গুণ আবার কী? গুণ তো গুণ করা। আমি বললাম, গুণ মানে কী বোঝায়, তুমি জানো? থিয়া মাথাটা দুপাশে ঘুরিয়ে জানিয়ে দিল, সে জানে না। আমি বললাম, ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নাই। যোগ করতে পারো? এবার মাথা ওপরে-নিচে করে সে জানাল, যোগ করতে পারে। আমি ওকে বললাম, যোগের সংক্ষিপ্ত রূপই গুণ। যেমন ধরো, ৬ + ৬ + ৬ + ৬ + ৬ + ৬ + ৬ + ৬ =  কত? থিয়া অনেকক্ষণ আঙুল গুনে গুনে জানাল ৪৮। আমি বললাম, তুমি অনেকক্ষণ ভেবে যোগ করে বের করলে যোগফল ৪৮। কিন্তু তুমি চাইলে এটাকে গুণ করে আরও সহজে যোগফল পেতে পার। সেটাও হবে ৪৮। ভালো করে খেয়াল করো, এখানে মোট কয়টি ৬ আছে? থিয়া জানাল, ৮টি। আমি বললাম, তাহলে ৬-কে ৮দিয়ে গুণ করে দাও। তাহলেই পেয়ে যাবে যোগফল।

এবার থিয়া হাসি মুখে বলল, তুমি যে বললে গুণ সহজ! এখন তো আবার নামতা মুখস্থ করতে হবে। নামতা মুখস্ত করতে আমার একটুও ভালো লাগে না চাচ্চু।

এবার আমি একটু বিপদে পড়ে গেলাম। ভাবলাম, ওকে তাহলে গুণের সহজতম পদ্ধতিটি শিখিয়ে দেওয়া যাক। বললাম, থিয়া, আমি তোমাকে একটা সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তোমাকে এটা অনেক চর্চা করতে হবে। তাহলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারবে। শিখবে?

থিয়া সায় দিল ওপর-নিচে মাথা নেড়ে।

এবার আমি থিয়াকে প্রথমে আগের যোগফলটি সহজে বের করার পদ্ধতিটি শিখিয়ে দিলাম। সেজন্য পকেট থেকে বের করলাম একটুকরো কাগজ আর একটা কলম। তারপর প্রথমে নিচের চিত্রের মতো ৮ × ৬ লিখে তার নিচে দুটি বৃত্ত আঁকলাম। বৃত্ত না এঁকেও করা যায়। কিন্তু প্রথমে ওর গণিতভীতি দূর করা প্রয়োজন। তাই এই আঁকাআঁকির ব্যবস্থা।  

যেহেতু ৮টি ৬ ছিল তাই এভাবে গুণ করা। এবার প্রত্যেকটি অঙ্কের নিচে মোট ১০ বানাতে হবে। প্রথমে ৮ দিয়ে শুরু করি। ৮ আছে, তাহলে আর কত হলে ১০ হবে? থিয়া চট করে বলে দিল, ২। বেশ, ৮-এর নিচের ফাঁকা ঘরে বসিয়ে দিলাম ২।

এরপরের সংখ্যাটি ৬। এতটুকু বলতেই থিয়া লাফাতে লাফাতে বলল, চাচ্চু, নিচের ঘরে ৪ বসবে। দেখলাম, থিয়া এবার অঙ্ক করতে মজা পাচ্ছে। তা ছাড়া, নিচের ঘরে আসলেই ৪ বসবে। ৬ আছে, তাহলে ১০ হতে লাগবে আর ৪। বসিয়ে দিলাম ৬-এর নিচের ফাঁকা ঘরে ৪।

থিয়াকে বললাম, এবার আমাদের একটু বিয়োগ করতে হবে। বিয়োগ করতে পারবে তো? থিয়া আবার মাথা ওপরে নিচে করে বলল, গুণ আর ভাগ না করতে হলেই সব পারবে। এবার থিয়াকে দেখালাম, আমাদের কোণাকুণি বিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ, হয় ৬ থেকে ২ বিয়োগ করতে হবে অথবা ৮ থেকে ৪ বিয়োগ করতে হবে। যেটাই করি না কেন উত্তর একই হবে—৪। নিচের চিত্রের মতো সমান চিহ্নের ডান পাশে বসিয়ে দিলাম ৪।

এখন আমাদের আর ছোট্ট একটা গুণ করতে হবে। এবার থিয়া চরম আপত্তি জানাল। ও মাথা নেড়ে বলল, গুণই যদি করতে হবে, তাহলে এতক্ষণ বসে বসে যোগ-বিয়োগ কেন করলাম! আমি ওকে অনেক কষ্টে বোঝালাম, এটা ছোট গুণ, তাই তোমার মনে হচ্ছে, সরাসরি গুণ করলেই হতো। কিন্তু তুমি যখন ৯৮-কে ৯৭ দিয়ে গুণ করবে, তখন তো আর নামতা করে গুণ করতে পারবে না। বরং এই পদ্ধতিতেই সহজে গুণ করতে পারবে। শুধু ছোট্ট একটা গুণের কাজ এখন বাকি। নিচের বৃত্তের সংখ্যাদুটি গুণ করতে হবে, ব্যাস!

থিয়া রাজি হলো। বলল, ২-কে ৪ দিয়ে গুণ দিলে তো ৮ হয়। আমি বললাম, হ্যাঁ। গুণফলটা সমানের ডান পাশে বসিয়ে দাও। এবার থিয়া খুশি হয়ে বলল, চাচ্চু উত্তর মিলে গেছে। এই গুণফলটা ৪-এর পাশে বসালে ৪৮ হয়।

থিয়া এভাবে গুণের সহজ নিয়ম শিখেছিল আমার কাছে। আর আমিও ওর প্রশ্নের হাত থেকে সেবারের মতো রক্ষা পেয়েছিলাম।

তোমাদের হয়তো মনে হতে পারে, ৬-এর সঙ্গে ৮ গুণ করলে ৪৮ হয়, এটা তো সবাই জানে। এর জন্য আর এত ঝামেলা পোহাতে যাব কেন! থিয়ার মতো তোমাদের উদ্দেশেও বলে রাখি, এই কৌশল ব্যবহার করেই আমরা দুই অঙ্কের বড় বড় গুণ করতে পারি। তখন আর তোমাদের এমনটা মনে হবে না। তবে আমরা সেটা করব পরের কোনো পর্বে। আজকে আরও একটা ছোট গুণের মাধ্যমে এখানে শেষ করব। তোমরা নিজেরাই এ প্রক্রিয়ায় ৭-এর সঙ্গে ৮ গুণ করে দেখতে পারো। এখন আর নিচের সমাধান দেখো না। এতক্ষণ থিয়াকে যেভাবে শেখালাম, সেভাবে নিজেরা চেষ্টা করে তারপর আবার এখান থেকে সমাধান দেখবে। দেখো তো, তোমরা উত্তর মেলাতে পারো কি না।

এভাবেই ওপরের ছবির মতো ৭ ও ৮-এর নিচে দুটি বৃত্ত এঁকে নাও। এবার হিসাব করে দেখো, ১০ হতে হলে কোন বৃত্তে কত বসাতে হবে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। ৭-এর নিচে ৩ এবং ৮-এর নিচে ২ বসবে।

এবার কোনাকুনি বিয়োগ করতে হবে। ৭ থেকে ২ বিয়োগ করো আর ৮ থেকে ৩ বিয়োগ করো, বিয়োগফল হবে ৫। তাহলে সমান চিহ্নের ডানপাশে বসিয়ে দাও ৫।

এবার বাকি থাকল শুধু গুণ করা। ৩-এর সঙ্গে গুণ করে দাও ২। অর্থাৎ, নিচের দুটি বৃত্তের সংখ্যাদুটি গুণ করতে হবে। গুণফল হবে ৬। বসিয়ে দাও ৫-এর ডানপাশে। তাহলে উত্তর পেয়ে গেলাম ৫৬।

তুমিও কি গুণফল ৫৬ পেয়েছ? যদি আমার সঙ্গে তোমার উত্তর মিলে যায়, তাহলে তুমি সহজে গুণ করার কৌশলটি শিখে ফেলেছ। অভিনন্দন। এখন শুধু তোমাকে বারবার চর্চা করতে হবে। তাহলে এভাবে বৃত্ত এঁকে, খাতা-কলমে আর গুণ করতে হবে না। মাথার মধ্যে নিজেই চট করে পেয়ে যাবে উত্তর।

থিয়াকে গুণের এই সহজ পদ্ধতি শেখানোর পরে মনে হলো খুব বেশি মজা পায়নি। হয়তো এত সময় নিয়ে এই ছোট গুণ করার কারণে মজাটুকু উবে গেছে। চাইলেই আজকে ওকে আরও বড় গুণ দেখিয়ে মজার মাত্রাটা বাড়িয়ে দেওয়া যেত। যেমন ধরো, চাইলে ৯৫-এর সঙ্গে ৮৬ গুণ করে দেখানো যেত। কিন্তু তাতে কৌশলটা ভালো করে আয়ত্তে আসত না। পরেরদিন নিশ্চয়ই ওর আনন্দের মাত্রা বেড়ে যাবে আরও কয়েক গুণ।

যাহোক, ওকে বাসায় চর্চা করার জন্য কিছু কাজ দিয়েছিলাম। চাইলে তোমরা সেগুলো চর্চা করে দেখতে পারো।

ক. ৮ × ৮ =

খ. ৯ × ৯ =

গ. ৭ × ৭ =

ঘ. ৮ × ৯ =

ঙ. ৭ × ৯ =

চ. ৫ × ৯ =

ছ. ৮ × ৬ =

জ. ৪ × ৯ =

ঝ. ৯ × ৬ =

ঞ. ৭ × ৮ =

তুমি কি সবগুলোর উত্তর খুঁজে পেয়েছ? সবগুলো সমাধান করে নিচের উত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নাও।  

ক. ৬৪

খ. ৮১

গ. ৪৯

ঘ. ৭২

ঙ. ৬৩

চ. ৪৫

ছ. ৪৮

জ. ৩৬

ঝ. ৫৪

ঞ. ৫৬

এখানে একটা শর্তের কথা বলে রাখি। বৃত্তের মধ্যে যে সংখ্যাগুলো আছে তার গুণফল ১০-এর চেয়ে বেশি হলে এ নিয়ম খাটবে না। সেক্ষেত্রে অন্য একটি কৌশল ব্যবহার করতে হবে। সে কৌশল পরের পর্বে দেখানো হবে। পরেরবার শিগগিরই আসব কথা দিয়ে আমি এ পর্যায়ে মানে মানে কেটে পড়লাম। তোমাদেরও কথা দিচ্ছি, শিগগিরই আসব।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: স্পিড ম্যাথ ফর কিডস অবলম্বনে