পাই। গ্রিক অক্ষর π দ্বারা চিহ্নিত বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসার্ধের অনুপাত। এর মান কখনো পরিবর্তন হয় না; যেকোন বৃত্তের বেলায় পাইয়ের মান ধ্রুবক। তবে সেটা শুধু সমতল ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বৃত্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তার আগে একটা গল্প বলে নেই।
গল্পটি অ্যান ড্রুয়ানকে নিয়ে, তিনি বিশ্ব খ্যাত কার্ল সাগানের কসমস সায়েন্স ডুকমেন্টারির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বর্হির্জাগতিকদের উদ্যেশ্যে পাঠানো নাসার ভয়েজার ইন্টাস্টেলার মেসেজ রেকর্ডের তিনি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরও ছিলেন। ড্রুয়ান তার আবেগঘন এক স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, তিনি এই পাই সংক্রান্ত একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়ে গণিত-বিজ্ঞানের পথ থেকে সরে গিয়েছিলেন। তাঁর এক শিক্ষক বলছিলেন, পাই (π) একটি ধ্রুবক, যেকোন বৃত্তের ক্ষেত্রেই তা অপরিবর্তনীয়। পাইয়ের (π) এই সার্বজনীনতা নিয়ে ড্রুয়ান প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন এটি মহাবিশ্বের প্রতিটি বৃত্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?’ হাইস্কুল শিক্ষক ড্রুয়ানকে উপহাস করে এ ধরনের বোকার মতো প্রশ্ন না করার জন্য বলেছিলেন।
শিক্ষকের এই অনমনীয়তা তার ভালো লাগেনি এবং মারাত্মক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। ড্রুয়ান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর তিন বছরকে ‘বিপর্যয়কর’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। স্নাতক না করেই স্কুল ছেড়ে যাওয়ার পরেই তিনি প্রাক-সক্রেটিক দার্শনিকদের কথা জানতে পারেন। এরপর নিজেকে বিজ্ঞানের প্রতি নতুনভাবে আবেগ অনুভব করেন। এই প্রাক সক্রেটেসীয় দার্শনিকরা ছিলেন কৃষক, নাবিক, তাঁতীদের সন্তান। তাঁরা ছিলেন থেলিস, পিথাগোরাস, এমপিডকলাস, ডেমোক্রিটাস। এদের প্রথম দুজনের হাতেই তৈরি হয়েছিল ইউক্লিডীয় জ্যামিতির ভিত্তি।
ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে কয়েকটি স্বতসিদ্ধ আছে। এই স্বতসিদ্ধগুলো খুবই সাধারণ। তার ফলাফল বা উপপাদ্যগুলো মোটামুটি আমাদের সাদা চোখে দেখা চারপাশের জগতের কথাই বলে। স্বতসিদ্ধগুলো হচ্ছে: ১. যে কোনো বিন্দু হতে অন্য যে কোনো বিন্দু পর্যন্ত সরলরেখা আঁকা যায়। ২. একটি সসীম রেখাকে অনির্দিষ্টভাবে বর্ধিত করা যায়। ৩. যে কোনো বিন্দু ও যে কোন দূরত্ব নিয়ে একটি বৃত্ত আঁকা যায়। ৪. প্রত্যেক সমকোণই সমান। ৫. একটি সরলরেখা অপর দু’টি সরলরেখাকে ছেদ করলে এর যে পার্শ্বে উৎপন্ন অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের যোগফল দুই সমকোণ অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর হয়, সরলরেখা দুটিকে ওই-পার্শ্বে বর্ধিত করলে তারা সে-পার্শ্বের একটি বিন্দুতে মিলিত হয়।
পঞ্চম স্বতসিদ্ধকে বাদ দিলে পুরো ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে গণ্ডগোল লেগে যায়। ত্রিভুজের কোণের ব্যাপারে আর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সমান্তরাল সরলরেখা বলতে আমরা যা বুঝি তাও থাকে না। তবে পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটি বাদ দিয়ে ‘যদি একটি সরলরেখার বাইরের বিন্দু দিয়ে কমপক্ষে দুটি সমান্তরাল রেখা আঁকা যায়’ এমন একটি স্বতঃসিদ্ধ ইউক্লিডীয় বাকী স্বতসিদ্ধের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাহলে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি আমূল পাল্টে যাবে। সেখানে দুটি সমান্তরাল রেখা মধ্যকার দূরত্ব ইউক্লিডীয় জগতের মতো সকল জায়গায় সমান হবে না। ক্রমশ কাছাকাছি হবে অথবা দূরে সরে যাবে কিন্তু কখনো তারা মিলবে না। ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি দুই সমকোণের ছোট হবে, রেখা দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলবে; পরিণত হবে বোলাই, লোবাচেভস্কির জ্যামিতিতে। উল্লেখ্য ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান। আরেক ধরনের জ্যামিতি রয়েছে, রিম্যানীয় জ্যামিতিতে কমপক্ষে দুই সমকোণের চেয়ে বেশি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে পরিধি ও বৃত্তের ব্যাসের অনুপাত সবসময় ‘পাই‘(π) নামের একটি ধ্রুবক অর্থাৎ অপরিবর্তনীয় যার মান ২২/৭ এর সমান। এই জ্যামিতিকে অধিবৃত্তিক বলা হয়, এর বক্রতা শূন্য। ঋণাত্মক বক্রতা বিশিষ্ট বোলাই, লোবাচেভস্কির জ্যামিতি পরাবৃত্তিক, ঘোড়ার পিঠে পৃষ্ঠবক্রতাও ঋণাত্মক বক্রতা বিশিষ্ট। এখানে উপরোক্ত অনুপাতের মান সবসময় ‘পাই’ ধ্রুবকের চেয়ে বেশি হবে। রিম্যানের জ্যামিতি হল উপবৃত্তিক, গোলকের পৃষ্ঠতলে এই বক্রতার অভিজ্ঞতা লাভ করি। এর বক্রতা ধনাত্মক এবং এ জ্যামিতিতে পরিধি ও বৃত্তের ব্যাসের অনুপাত ইউক্লিডিয় জ্যামিতির ‘পাই’ ধ্রুবকের মানের চেয়ে কম হবে। গঠন কাঠামোটি যত বড় হবে ততই ইউক্লিডীয় পাই ধ্রুবকের চেয়ে মান কম হবে। সাদা চোখে ইউক্লিডিয় দেখালেও আমাদের মহাবিশ্বের সামগ্রিক কাঠামোটি রিম্যানীয় জ্যামিতির অন্তর্ভূক্ত। এর পরিধি ও বৃত্তের অনুপাত পাইয়ের মান সদা পরিবর্তনশীল এবং পাই ধ্রুবকের চেয়ে কম হতে থাকবে। আমরা চিন্তা করতেই পারি বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি কেমন হবে? পরিধি ও ব্যাসের মান কাছাকাছি চলে আসবে, সমান হয়ে যাবে। এমন কি বৃত্তের পরিধি তার ব্যাসের চেয়ে ছোট হতে পারে।
উল্লেখ্য পাইয়ের ইতিহাস সমগ্র গণিতের ইতিহাসের সমান্তরাল। সভ্যতার শুরুতে এমনকি জ্যামিতির বিকাশের দিনগুলোতে রহস্যময় এই বৃত্তের ‘পরিধি ও ব্যাসের’ অনুপাতের সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়েছিল। বিভিন্ন লেখক পাইয়ের ইতিহাসকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে প্রাচীনকালের জ্যামিতি যুগ, সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপের ক্যালকুলাসের যুগ এবং কম্পিউটারের আবির্ভাবের পর কম্পিউটার যুগ।
পাই হলো একটি অমূলদ সংখ্যা (Irrational number)। অমূলদ সংখ্যার বৈশিষ্ট হচ্ছে এ ধরনের সংখ্যা দুটি পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা যায় না। কারণ দশমিকের পর এ সংখ্যাগুলো অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত এবং তাতে ডিজিটের কোনো পুনারাবৃত্তি হয় না। পাই-এর আসন্ন মান প্রথম গণনা করেছিলেন ২২’শ বছর আগের গণিতবিদ আর্কিমিডিস। যদিও গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটলই (৩৮৪-৩২২) এই অমূলদ সংখ্যার কথা বলেছিলেন। এর দু হাজার বছর পর জোহান হেনরিক ল্যাম্বার্ট (১৭৬৭-১৭৭৭) প্রথম প্রমাণ করেন পাই একটি অমূলদ সংখ্যা। পাইয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি অবীজগণিতীয় সংখ্যা। রেখায় যেসব সংখ্যার সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব নয় তাদেরই ট্রান্সসেডেন্টাল বা অবীজগণিতীয় সংখ্যা বলে। এই কারণেই পাই-ও অবীজগণিতীয় সংখ্যা। সেজন্য এগুলোকে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং স্কয়ার রুট বা বর্গমূলের ফলাফল হিসেবে নির্ণয় করা যাবে না। রুলার কম্পাসের সাহায্যে একটি বৃত্তের সমান ক্ষেত্রফল আঁকা যাবে না। ট্রান্সসেডেন্টাল সংখ্যা সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন গণিতবিদ লিওনার্দো অয়লার। তবে ১৮৬২ সালে বিষয়টি প্রথম প্রমাণ করেন জার্মান গণিতবিদ ফার্দিনান্দ লিন্ডারম্যান (১৮৫২-১৯৩৯)।
১৪ মার্চ, পাই দিবস হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এটা এসেছে পাইয়ের মান ৩.১৪ থেকে এসেছে। পাই দিবস কখনও কখনও ১৪ মার্চ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটে উদযাপন করা হয়। ওই দিন দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটকে পাই মিনিট নামে আখ্যায়িত করা হয়। দুপুর ১টা ৫৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডকে পাই সেকেন্ড বলা হয়। পাই সেকেন্ডে পাইয়ের মানের (৩.১৪১৫৯২৬) কাছাকাছি সময়ে পাই দিবস উদ্যাপন করা সম্ভব হয়।
পাই দিবস আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রদানের জন্য সুখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও জন্মদিন। এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন আরেক বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং।
১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো পাই দিবস পালিত হয় সানফ্রানসিসকো-এর একটি বিজ্ঞান জাদুঘরে। জাদুঘরের বৃত্তাকার স্থানে এর কর্মচারী ও দর্শনার্থীরা মিলে কেক (পাই) খেয়ে দিনটি উদ্যাপন করেন। ওই জাদুঘরের কর্মকর্তা ল্যারি শ এই দিবস উদ্যাপনের উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে ‘পাই-এর রাজপুত্র’ বলা হয়। পরবর্তী সময়ে, ল্যারির কন্যা সারার মন্তব্য থেকে বোঝা যায় নির্বাচিত তারিখটি আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিনটি মিলে যাওয়া একটি উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অনেক সময় তাদের নতুন শিক্ষার্থীদের গ্রহণপত্র পাই দিবসে ডাকে দিয়ে থাকে। পাই ডে এমন একটি বার্ষিক এক্সপ্লোরেটরিয়াম ঐতিহ্য হয়ে ওঠে যে ধারণাটি দ্রুতগতিতে বাড়তে বেশি সময় নেয়নি, ১২ মার্চ, ২০০৯-এ ইউএস কংগ্রেস একে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেছিল।
২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে পাই দিবস উদযাপিত হচ্ছে। দেশের বেশ কিছু গণিত ক্লাব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা আয়োজনের মধ্যে দিবসটি পালিত হয়। আয়োজনের মধ্যে রয়েছে পাই শোভাযাত্রা, পাই-এর মান বলা, পাই নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি। তবে মাথায় রাখতে হবে গণিত বা বিজ্ঞান হাত তুলে বিজয় চিহ্ন দেখানোর ব্যাপার নয়, এটা চর্চা আর অনুধাবনের বিষয়। চর্চার জন্য প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বই।
পাই দিবস আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রদানের জন্য সুখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও জন্মদিন। এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন আরেক বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং।
আমার কাছে কখনো কখনো মনে হয় লবেচেভস্কিয় জ্যামিতিতে দুটো সমান্তরাল সরলরেখা ক্রমাগত পরস্পরের কাছাকাছি আসে কিন্তু কখনো মেলে না, ঠিক, পাইয়ের মানও দশমিকের পর আসতেই থাকে কখনো ফুরায় না। তেমনি পৃথিবীতে অনেক ধারণা আছে তারা সাংঘর্ষিক মনে হলেও তা নয়। কখনো তাদের অনেক কাছের মনে হয়, কখনো দূরের মনে হয়, কিন্তু কখনো মেলে না। কিন্তু সবসময় শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান রেখে পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে চলে। আজ পাই দিবস। সংঘর্ষপূর্ণ বিশ্বে এই শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের চর্চা করে যেতে হবে ।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত (সায়েন্স জার্নাল)