দ্য ম্যান হু কাউন্টেড ৪

সংখ্যা দিয়ে পরীক্ষা

উজির মালুফের সাথে সাক্ষাতের সময় আমাদের সাথে যা ঘটেছিল। আমাদের সাথে একজন কবির দেখা হয়। হিসাব-নিকাশের প্রতি তাঁর আস্থা নেই। গণনাকারী এখানে বড় একটি কাফেলার উট গণনা করার একটি মৌলিক পদ্ধতি দেখিয়েছেন। পাত্রীর বয়স ও উটের কানের সংখ্যার মধ্যে মিল স্থাপন করেছেন।

তাড়াতাড়ি করে উজির ইব্রাহিম মালুফের বাসায় গেলাম আমরা। এখানে এসে বিস্মিত হলাম। ভারী লোহার গেট পার হয়ে আমরা একটি সংকীর্ণ করিডোরে পা রাখলা। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন কৃষাঙ্গ দাস। কাঁধে সোনার বাহুবন্ধনী। প্রাসাদের ভেতরের বাগানে প্রবেশ করলাম আমরা। অপূর্ব সুন্দর বাগানটিতে দুই সারি কমলা গাছ ছায়া বিলিয়ে দিচ্ছে। এখান থেকে বিভিন্ন দিকে অনেকগুলো দরজা চলে গেছে। কোনো কোনোটা নিশ্চয় হেরেমের দিকে গেছে।

দুজন দাস ফুল তুলছিল। আমাদের দেখে সরে গিয়ে পিলারের আড়ালে দাঁড়াল ওরা। উঁচু দেয়ালের ভেতর দিয়ে সরু একটি পথ দিয়ে আমরা একটি উঠোনে এসে পৌঁছলাম। উঠোনের ঠিক মাঝখানে চমৎকার একটি ঝর্ণা। তিনটি ফোয়ারা পানি ছিটাচ্ছে। তিনটি তরল রেখা সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে।

আরও পড়ুন

দাসকে অনুসরণ করে আমরা উঠোন পার হয়ে খোদ প্রাসাদে প্রবেশ করলাম। সামনে পড়ল অনেকগুলো সুশোভিত কক্ষ। রূপার প্রলেপযুক্ত রং-বেরংয়ের দামি কাপড় ঝোলানো দেয়ালে। শেষ পর্যন্ত উজিরের সঙ্গে দেখা হলো। বিশাল কুশনে বসে দুই বন্ধুর সাথে আলাপ করছিলেন তিনি।

একজনকে চিনলাম। শেখ সালেম নাসির। আমাদের মরু অভিযানের সহযাত্রী। আরেকজন ছোটখাট গোলগাল চেহারার মানুষ। চেহারায় দয়া ফুটে আছে। দাড়িতে হালকা পাক ধরেছে। জামা-কাপড় কেতাদুরস্ত। গলায় একটা চারকোণা পদক ঝুলছে। পদকের অর্ধেকটা দেখতে সোনালি-হলুদ। বাকিটা ব্রোঞ্জের মতো কালো।

উজির মালুফ আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। পদকধারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে প্রিয় কবি, ইনি হচ্ছেন আমাদের মহান গণনাকারী। তাঁর সঙ্গী তরুণ বাগদাদের বাসিন্দা। পথে বেরিয়ে পড়ার পর আকস্মিকভাবে তাঁর সাথে তার সাক্ষাৎ।’

সম্মানিত শেখকে আমরা ভক্তিভরে সালাম দিলাম। পরে আমরা জেনেছি, তাঁর সঙ্গীটি ছিলেন বিখ্যাত কবি আব্দুল হাজমিদ। যিনি খলিফা আল-মুতাসিমেরও কাছের বন্ধু। গলার পদকটি তিনি পেয়েছেন খলিফার কাছ থেকেই। কাফ, লাম ও আইন অক্ষর তিনটি ছাড়াই ৩০, ২০০ পঙতির কবিতা লেখার পুরস্কার এটি।

কবি হেসে হেসে বললেন, ‘বন্ধু মালুফ, এই পারস্যদেশীয় গণনাকারীর অপূর্ব ক্ষমতা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে।’ সংখ্যাকে মিশ্রিত করলে একটি চালাকি তৈরি হয়। যাকে বলা যায় বীজগাণিতিক ধোঁকা। একবার মোদাদের পুত্র রাজা এল-হারিতের কাছে এক বিজ্ঞ মানুষ আসেন। তিনি নাকি বালু দেখে ভাগ্য বলতে পারেন। রাজা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি নিখুঁত হিসাব করতে পার?’ বিস্ময়ের আবেশ কাটার আগেই তিনি বললেন, ‘নিখুঁত হিসাব করতে না পারলে আপনার সবগুলো পরিকল্পনা অর্থহীন; আপনি যদি নিছক হিসাবের মাধ্যমে সেগুলো করেন তবে সেগুলো আমি অবিশ্বাস করি। ভারতে একটি প্রবাদ শিখেছি, ‘হিসাবকে সাতবার অবিশ্বাস করুন, আরে গণিতবিদকে এক শ বার।’’

উজির বললেন, ‘অবিশ্বাস দূর করার জন্যে আমাদের অতিথিকে চূড়ান্তভাবে একবার পরীক্ষা করা যাক।’ এটা বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বেরেমিজের বাহু ধরে নিয়ে গেলেন প্রাসাদের একদিকের বারান্দায়। জানালা খুলে আরেকটি উঠোনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। সেখানে অনেকগুলো উটের সারি। সবগুলো ভাল জাতের। দেখলাম, দুটো কি তিনটে মঙ্গোলীয় সাদা উট। বাকিগুলো পশমহীন চামড়ার ক্যারেহ।

উজির বললেন, ‘দারুণ এই উটগুলো আমি গতকাল কিনেছি। উপহার হিসেবে আমার পুত্রবধুর বাড়িতে পাঠাতে চাই। আমি জানি এখানে ঠিক কতগুলো উট আছে। তুমি কি বলতে পারবে কতগুলো আছে?’

পরীক্ষাকে আরও কঠিন করতে উজির সাহেব উটগুলোর দিকে মুখ করে শিস দিলেন। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এখানে অনেক অনেক উট। তাও আবার সেগুলো ছোটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। বন্ধু ভুল করলেই আমাদের ভ্রমণের আনন্দ উবে যাবে।

কিন্তু ঘুরে বেড়ানো উটের পালের দিকে চোখ বুলিয়ে বন্ধু বেরেমিজ বললেন, ‘সম্মানিত উজির, আমার হিসাব বলছে, এখানে উট আছে ২৫৭টি।’

‘একদম সঠিক!’ উজির জানিয়ে দিলেন। ‘আল্লাহর কসম, দুই শ সাতান্নটি উটই আছে।’

‘আপনি এত দ্রুত কীভাবে বললেন, তাও নিখুঁত হিসাব?’ কবির চোখে-মুখে এক সাগর কৌতূহল।

‘খুব সহজ,’ বললেন বেরেমিজ। ‘একটা একটা করে উট গণনায় কোনো মজা নেই। তাই আমি প্রথমে খুরগুলো গুণলাম। পরে কানগুলো। মোট পেলাম ১৫৪১। সাথে যোগ করলাম ১। একে ৬ দিয়ে ভাগ করলাম। নিঃশেষে ভাগ হয়ে ২৫৭ হলো।’

‘অসাধারণ,’ উজির কণ্ঠে প্রশংসা। ‘কত মৌলিক চিন্তা! কে ভেবেছিল, নিছক মজা পাওয়ার জন্যে কেউ কান ও খুর গুণবে?’

‘আমি বলব, ‘ বেরেমিজ বললেন, ‘মাঝেমাঝে গণনাকারীর উদাসীনতা বা অক্ষমতা হিসাবকে কঠিন করে তোলে। একটা ঘটনা। আমি তখন খোই শহরে ছিলাম। আমি মনিবের পশুর পাল দেখছি। এসময় এক ঝাঁক প্রজাপতি উড়ে গেল। একজন রাখাল জিজ্ঞেস করল আমি সেগুলো গুণতে পারব কি না। ‘আট শ ছাপ্পান্ন,’ বললাম আমি। রাখাল বলল, ‘কী! আট শ ছাপ্পান্ন? এত বেশি?’ তখন বুঝলাম, আমি প্রজাপতির বদলে গুণেছি পাখার সংখ্যা। দুই দিয়ে ভাগ দিতেই সঠিক সংখ্যা পেলাম।

শুনে উজির খুব মজা পেলেন। সঙ্গীতের মতো মিষ্টি সুরে হেসে উঠলেন।

‘সবকিছুই বুঝলাম,’ কবি বলছেন। ‘উটের সঠিক সংখ্যা পেতে চার খুর ও দুই কানের জন্য ৬ দিয়ে ভাগ দিতে হবে বুঝলাম। কিন্তু ১৫৪১-কে ৬ দিয়ে ভাগ দেওয়ার আগে ১ যোগ করতে হলো কেন?’

‘খুব সহজ,’ জবাব দিলেন বেরেমিজ। ‘কান গুণতে গিয়ে দেখলাম, একটি উটের একটি কান নেই। সে কারণেই ১ যোগ করে নিয়েছি।’

এবার বেরেমিজ উজিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেয়াদবি মাফ করলে জিজ্ঞেস করতাম, আপনার পুত্রবধুর বয়স কত?’

‘না, না, অসুবিধা নেই।’ উজির বললেন, ‘আস্তিরের বয়স ষোলো।’ এবার তিনি সংশয় নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু ওর বয়সের সাথে তো আমি যে উটগুলো উপহার পাঠাব সেগুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক দেখছি না।’

‘আমি শুধু ছোট একটি পরামর্শ দিতে চাই।’ বললেন বেরেমিজ। ত্রুটিযুক্ত উটটি পাল থেকে সরিয়ে নিলে উট থাকবে ২৫৬টি। যা ১৬-এর বর্গ। ১৬ গুণ ১৬ সমান ২৫৬। আস্তিরের বাবাকে পাঠানো উপহার তাহলে গাণিতিকভাবে নান্দনিক হবে। ২৫৬ কে ২-এর ঘাত আকারে প্রকাশ করা যায় (২৮)। আর ২৫৭ হলো মৌলিক সংখ্যা। বর্গ সংখ্যার সাথে ভালাবাসা বেশি মিলে যায়। বর্গ সংখ্যা নিয়ে মজার একটি গল্প প্রচলিত আছে। শোনাব?’

‘আনন্দের সাথেই শুনব,’ বললেন উজির। ‘সুন্দর গল্প সুন্দর করে বললে শুনতেও ভাল লাগে। আমার শোনার কৌতূহল হচ্ছে।’

সৌজন্য প্রকাশ করে গণনাকারী শুরু করলেন, ‘বাদশা সুলাইমান (আ.) সম্পর্কে বলা হয়, সৌজন্য ও জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিনি তাঁর বাগদিত্তা, সুন্দরী রানি বিলকিসকে ৫২৯টি মুক্তার একটি বাক্স উপহার দেন। ৫২৯ কেন? কারণ ৫২৯ হলো ২৩-এর বর্গ। মানে ২৩ গুণ ২৩ সমান ৫২৯। আর ২৩ ছিল রানির বয়স। তরুণী আস্তিরের বয়স ১৬। তাই ২৫৬টি উট দেওয়া সুন্দর দেখায়।’

সবাই গণনাকারীর দিকে তাকাল বিস্ময় নিয়ে। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘১৬-এর বর্গ ২৫৬, যার অঙ্কগুলো যোগ করলে পাওয়া যায় ১৩। ১৩-এর বর্গ ১৬৯। ১৬৯-এর অঙ্কগুলোর যোগফল আবার ১৬। ফলে ১৩ ও ১৬ সংখ্যা দুটির মধ্যে দারুণ একটি সম্পর্ক আছে। একে আমরা বলতে পারি দ্বিঘাত সম্পর্ক। সংখ্যাদের বাকশক্তি থাকলে আমরা হয়ত তাদের আলাপ শুনতাম: ১৬ হয়ত ১৩-কে বলছে, ‘আমি তোমার প্রতি আমাদের বন্ধুত্বের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। আমার বর্গ ২৫৬, যার অঙ্কগুলোর যোগফল ১৩।’ ১৩ উত্তরে বলছে, ‘তোমার সৌজন্যের জন্যে ধন্যবাদ, প্রিয় বন্ধু। আমিও তোমাকে উপহার দিতে চাই। আমার বর্গ ১৬৯, যার অঙ্কগুলোর যোগফল ১৬।’

‘আমার মনে হয় ২৫৬-এর পক্ষে আমি যথেষ্ট কারণ উল্লেখ করেছি। ২৫৭-এর চেয়ে সংখ্যাটি অনেক অনেক সুন্দর।’

‘তোমার বুদ্ধিটা খুব অনন্য,’ উজির উত্তর দিলেন। ‘হ্যাঁ, এটাই করব আমি, যদিও মানুষ বলবে আমি সুলাইমানকে (আ.) নকল করেছি। কবির দিকে ঘুরে উজির বললেন, ‘দেখছি এই মানুষটি গল্প যেমন বলতে পারেন, তেমনি বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে তুলনাও টানতে পারেন। তাকে সচিব বানিয়ে তো ভালই করেছি।’

‘সম্মানিতে উজির, আমি দুঃখিত,’ বেরেমিজ বললেন, ‘আপনার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারি এক শর্তে। আমার বেকার ও নিঃস্ব বন্ধু হানাক তাদে মাইয়ারও একটি চাকরি প্রয়োজন।’

গণনাকারীর উদারতা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তিনি এভাবে আমাকে উজিরের সামনে তুলে ধরবেন তা আমি ভাবতেও পারিনি।

‘আপনি উত্তম অনুরোধ করেছেন।’ উজির জানালেন। ‘আপনার বন্ধুকে যথাযোগ্য বেতনে নথি লেখকের দায়িত্ব দিচ্ছি।’

উজির ও মহানুভব বেরেমিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমি সাথে সাথে সম্মত হয়ে গেলাম।

লেখক পরিচিতি:

মালবা তাহান ব্রাজিলীয় গণিত লেখক হুলিও সিজার দা মেইয়ো এ সৌজার (১৮৯৫-১৯৭৪) ছদ্মনাম। গণিতের রহস্য ও আনন্দ মানুষের কাছে প্রকাশের জন্যে লেখক নামটি বেছে নিয়েছেন। মালবা তাহান ছদ্মনামে একশোর বেশি বই লিখেছেন। ছদ্মনাম সবাই জেনে ফেলার পরেও এই নামেই লিখেছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লেখালেখি করে গেছেন তিনি।

অসাধারণ বইগুলোর জন্য তিনি ব্রাজিলিয়ান লিটারেরি একাডেমির মর্যাদাজনক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৪ সালে তাঁর ছদ্মনাম দিয়ে তৈরি করা হয় দ্য মালবা তাহান ইনস্টিটিউট। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে রিও ডি জেনোরিও সংসদ ঠিক করে তাঁর মৃত্যুদিন ৬ মে দেশে গণিত দিবস হিসেবে পালিত হবে। দ্য ম্যান হু কাউন্টেড তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই। ২০০১ সালেই বইটির ৫৪তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।