সমুদ্রের ঢেউয়ের গাণিতিক রহস্য ও ৩০০ বছরের পুরোনো ধাঁধা
সমুদ্রের সবচেয়ে সাধারণ ঢেউও যেন খামখেয়ালি গাণিতিক ধাঁধা। চাইলেও সমীকরণে ধরা দেয় না। ৩০০ বছরের পুরানো এই জটিলতায় আশার আলো দেখছেন একদল ইতালিয়ান গণিতবিদ। তাঁরা দেখিয়েছেন, কীভাবে সহজ ঢেউয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকে জটিল আচরণ বোঝা যায়। সমুদ্রের ঢেউও যে গণিত মেনে চলে, জানতেন কী?
আলবার্তো মাসপেরোর অফিসের জানালা দিয়ে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়। ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরের এক পাহাড়ের চূড়ায় তাঁর অফিস। সেখান থেকে সাগরের নীল জলরাশি দেখা যায়। মাসপেরো একজন গণিতবিদ। তাঁর কাছে এই দৃশ্য শুধু সৌন্দর্য নয়, বিশাল অনুপ্রেরণা।
ইতালির এই ত্রিয়েস্তে শহরকে স্থানীয়রা ডাকে ‘লা সিত্তা দেল্লা বোরা’ বা বোরার শহর নামে। বোরা হলো একধরনের পাগলাটে বাতাস। এই বাতাস যখন আল্পস পর্বত থেকে নেমে শহরের ওপর দিয়ে সাগরের দিকে ধেয়ে যায়, তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। বাতাসের তোড়ে সাগরের ঢেউগুলো উল্টো দিকে চলতে শুরু করে! সাধারণত ঢেউ সাগরে তৈরি হয়ে তীরের দিকে আসে, কিন্তু বোরার দাপটে ঢেউ তীর থেকে উল্টো গভীর সমুদ্রের দিকে ছুটতে থাকে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই উল্টো ঢেউগুলো কখনোই খুব বেশি দূর যেতে পারে না। মাসপেরো তাঁর জানালা দিয়ে দেখেন, এই ঢেউগুলো কিছুক্ষণ চলার পর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। আবার শান্ত হয়ে যায় সাগর। কেন এমন হয়? ঢেউগুলো কোথায় হারিয়ে যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই গণিতবিদেরা ৩০০ বছরের পুরোনো এক রহস্যের সমাধান করেছেন। চলুন, সেই রোমাঞ্চকর সেই অভিযানের গল্পটা শোনা যাক।
প্রাচীন গ্রিকরা বলত, সাগরের ঢেউয়ের শব্দ নাকি মানুষের প্রতি সমুদ্রের উপহাস বা অট্টহাসি। মানুষ চাঁদ, নক্ষত্র বা আলো নিয়ে অনেক কিছু জানলেও, সমুদ্রের ঢেউয়ের গণিত বরাবরই মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল।
৩০০ বছর আগে লিওনার্দ অয়লার পানির প্রবাহ ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু সমীকরণ লিখেছিলেন। কাগজে-কলমে সেগুলো দেখতে সহজ মনে হলেও সমাধান করা ছিল দুঃস্বপ্ন। আপনি যদি পানির প্রতিটি কণার অবস্থান আর গতিবেগ জানেন এবং ধরে নেন পানির কোনো নিজস্ব ঘর্ষণ নেই, তাহলেই অয়লারের সমীকরণ দিয়ে ভবিষ্যৎ বলা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে সমুদ্রের সুনামি, ঘূর্ণিপাক বা ঢেউয়ের আচরণ এতই জটিল যে এই সমীকরণ মেলানো প্রায় অসম্ভব।
১৮০০ সালের দিকে স্যার জর্জ স্টোকস নামে এক ব্রিটিশ গণিতবিদ এই রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করেন। শৈশবে আয়ারল্যান্ডে সাঁতার কাটতে গিয়ে তিনি একবার বিশাল এক ঢেউয়ের কবলে পড়ে প্রায় মরতে বসেছিলেন। সেই থেকেই ঢেউয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ। ১৮৪৭ সালে তিনি অয়লারের সমীকরণের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন তত্ত্ব দিলেন। তিনি বললেন, যদি বাইরের কোনো বাধা না থাকে, তবে সাগরের ঢেউগুলো অনন্তকাল ধরে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে চলতে থাকবে। বিজ্ঞানের ভাষায় এদের নাম দেওয়া হলো স্টোকস ওয়েভ।
স্টোকস এবং পরবর্তী বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, এই ঢেউগুলো খুব স্থিতিশীল। মানে, ছোটখাটো কোনো ধাক্কা বা বাতাসের ঝাপটা লাগলে ঢেউয়ের আকার নষ্ট হবে না। তাঁরা ভাবতেন, সাগর যদি এতই অস্থির হতো, তবে কোনো ঢেউই মাঝসমুদ্র থেকে তীর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত না।
দুই
১৯৬৭ সাল। টি. ব্রুক বেনজামিন এবং তাঁর ছাত্র জিম ফেয়ার ভাবলেন, স্টোকসের এই তত্ত্বটা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা যাক। তাঁরা ল্যাবরেটরিতে একটি লম্বা ট্যাংকে কৃত্রিম ঢেউ তৈরি করলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ঢেউগুলো ট্যাংকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
প্রথমে তাঁরা ভাবলেন যন্ত্রপাতিতে সমস্যা। কিন্তু পরে বোঝা গেল, স্টোকস ওয়েভ আসলে অতটা স্থিতিশীল নয়। সামান্য একটু নড়া দিলেই এই ঢেউগুলো ছন্দ হারিয়ে ফেলে এবং এলোমেলো হয়ে যায়। একে বলা হয় বেনজামিন-ফেয়ার ইনস্ট্যাবিলিটি।
১৯৯৫ সালে গণিতবিদেরা প্রমাণ করলেন, অয়লারের সমীকরণের মধ্যেই এই অস্থিরতার বীজ লুকিয়ে আছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ঠিক কোন ধরনের ধাক্কায় ঢেউ ভাঙে, আর কোনটাতে ভাঙে না? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানের কোনো ঝড় কি ক্যালিফোর্নিয়ার বিচে আছড়ে পড়া ঢেউকে নষ্ট করতে পারে, নাকি তার আগেই ঢেউ মিলিয়ে যাবে?
২০১১ সালে বার্নার্ড ডেকোনিঙ্ক এবং কেটি অলিভেরাস এই রহস্য সমাধানের জন্য কম্পিউটারে সিমুলেশন শুরু করলেন। তাঁরা দেখতে চাইলেন, ঢেউয়ের ওপর বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কে ধাক্কা দিলে কী হয়।
সাধারণত, একটা ছোট নৌকা যে ঘন ঘন ঢেউ তোলে, তা সাগরের বিশাল ঢেউকে নষ্ট করতে পারে না। কিন্তু বিশাল জাহাজের ধীর গতির ভারী ঢেউ পুরো প্যাটার্নটাই নষ্ট করে দিতে পারে।
ছবি: কেটি অলিভেরাসকিন্তু ডেকোনিঙ্ক ও অলিভেরাস কম্পিউটারে এক অদ্ভুত জিনিস দেখলেন। তাঁরা যখন ধাক্কার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াতে থাকলেন, তখন দেখলেন একটা প্যাটার্ন তৈরি হচ্ছে। প্রথমে একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢেউ ভেঙে যাচ্ছে, এরপর একটু বেশি ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢেউ ঠিক থাকছে, মানে স্থিতিশীল। এরপর আরও বেশি ফ্রিকোয়েন্সিতে আবার ভেঙে যাচ্ছে ঢেউ।
মানে প্রথমে অস্থিরতা, তারপর শান্ত, তারপর আবার অস্থিরতা। তাঁরা দেখলেন, এই প্যাটার্ন বা অস্থিরতার অঞ্চলগুলো সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো জেগে আছে। ইতালিয়ান ভাষায় দ্বীপকে বলে আইসোল। তাই তারা এর নাম দিলেন—আইসোল।
তাঁরা দাবি করলেন, এই অস্থিরতার দ্বীপগুলো অসীম পর্যন্ত চলতেই থাকবে। কিন্তু দাবি করলেই তো হবে না, এটা গণিত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। আর সেখানেই পৃথিবীর বাঘা বাঘা গণিতবিদরা আটকে গেলেন।
তিন
২০১৯ সালে এক কনফারেন্সে ডেকোনিঙ্ক তাঁর এই অদ্ভুত আবিষ্কারের কথা মাসিমিলিয়ানো বার্টিকে জানালেন। বার্টি ফিরে এসে তাঁর দলবল নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। এই দলে আমাদের গল্পের শুরুতে থাকা মাসপেরো এবং তাঁর ছাত্র পাওলো ভেনতুরাও ছিলেন।
কাজটা ছিল অসম্ভব কঠিন। অস্থিরতার প্রথম ধাপটা প্রমাণ করতেই তাদের ৪৫ পাতার বিশাল এক গাণিতিক হিসাব কষতে হয়েছিল। কাজটা করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর! এরপর তারা কম্পিউটারের সাহায্য নিলেন। তাঁদের কম্পিউটার প্রথম ২১টি আইসোলের প্রমাণ বের করল। কিন্তু এরপর অঙ্ক এত জটিল হয়ে গেল যে কম্পিউটার আর কুলাতে পারছিল না।
মাসপেরো বুঝতে পারলেন, তাঁদের এমন কাউকে দরকার যিনি কম্পিউটার অ্যালগরিদমে বিশেষজ্ঞ। তিনি যোগাযোগ করলেন রুতজার্স ইউনিভার্সিটির গণিতবিদ ডোরন জেইলবার্গারের সঙ্গে।
জেইলবার্গার এই চ্যালেঞ্জটা লুফে নিলেন। তিনি তাঁর শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবহার করে কাজ শুরু করলেন। এই গণিতবিদ তাঁর কম্পিউটারের একটা নামও দিয়েছেন—শালোশ বি. একাদ। তবে শুধু নাম দিয়েই থামেননি তিনি, কম্পিউটারকে তাঁর গবেষণাপত্রের লেখক হিসেবে জায়গা দিয়েছেন!
জেইলবার্গারের কম্পিউটার প্রথম ২ হাজারটি আইসোলের হিসাব মাত্র ২০ ঘণ্টায় বের করে ফেলল। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁরা চূড়ান্ত প্রমাণে পৌঁছালেন।
ফলাফল কী? ডেকোনিঙ্ক ও অলিভেরাস সঠিক ছিলেন। সাগরের ঢেউয়ের এই অস্থিরতা কোনো এলোমেলো ঘটনা নয়। এটি একটি সুনির্দিষ্ট গাণিতিক প্যাটার্ন মেনে চলে, যা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত।
চার
এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এখন ৩০০ বছরের পুরোনো অয়লারের সমীকরণ ব্যবহার করে বলে দিতে পারেন, ঠিক কোন ধরনের ধাক্কা বা বাতাস লাগলে সাগরের ঢেউ টিকে থাকবে, আর কখন ভেঙে যাবে। যেই রহস্য গত ২০০ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের বোকা বানাচ্ছিল, তা অবশেষে সমাধান হলো।
মাসপেরো এখন তাঁর ত্রিয়েস্তের অফিসের জানালা দিয়ে সেই বাতাসের উল্টো ঢেউগুলো দেখেন। তিনি এখনো শতভাগ নিশ্চিত নন, তাঁর এই নতুন গণিত দিয়েই ওই ঢেউগুলোর মিলিয়ে যাওয়া ব্যাখ্যা করা যায় কিনা! কারণ, তাঁদের সমীকরণে পানির নিজস্ব ঘর্ষণকে ধরা হয়নি, কিন্তু বাস্তবে সাগরের পানিতে ঘর্ষণ আছে। হয়তো সেই ঘর্ষণের কারণেই বোরার ঢেউগুলো মিলিয়ে যায়। তবে সে গল্প অন্য কোনোদিন করব।
