কোন অঙ্কটি বাদ দিয়েছি

পনি কাগজ-কলম নিয়ে বসেছেন। ইচ্ছামতো একটি সংখ্যা লিখলেন। বেশ গোপনে লিখবেন। আমাকে দেখাবেন না। বলবেন না। সংখ্যাটি ছোট হতে পারে। বড়ও হতে পারে। সংখ্যাটিতে ০ থাকতে পারে। সংখ্যাটি ৫, ৭, ৮ বা এর বেশি অঙ্ক (ডিজিট) থাকলেও সমস্যা নেই।  সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আপনি সংখ্যাটি লিখুন।

এখন আপনাকে বললাম, সংখ্যাটি উল্টিয়ে লিখুন। ইংরেজিতে বলা যায় সংখ্যাটির রিভার্স সংখ্যা লিখুন। আপনি কিন্তু আমাকে জানতে দেবেন না রিভার্স সংখ্যাটি কী, বা কত অঙ্কের সংখ্যা। এগুলো আমি জানতেও চাই না। আপনিও জানাবেন না।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন আপনি প্রথমে ৭৯৪৭৩০৯ সংখ্যাটি লিখেছেন। একে উল্টিয়ে লিখলে হবে ৯০৩৭৪৯৭। এখন আপনি দুটি সংখ্যা পেলেন। এই সংখ্যাগুলোর কোনো কিছুই আমি জানব না।

এবার আপনাকে একটু সামান্য যোগ-বিয়োগের অঙ্ক করতে হবে। প্রথমে আপনি দেখুন সংখ্যা দুটির মধ্যে বড় কোনটি ও ছোট কোনটি। বড়টি থেকে ছোট সংখ্যাটি বিয়োগ করুন।

বিয়োগফলটি যথারীতি গোপন রাখুন। কাউকে জানাবেন না। আমাকে তো নয়ই। এরপরই শুরু হলো ম্যাজিকের আসল ঘটনা। আপনি বিয়োগফলের অঙ্কটি থেকে যেকোনো একটি অঙ্ক বাদ দিয়ে বাকি অঙ্কগুলোর যোগফল কত হয় দেখুন।

এবার সেই যোগফলটি আমাকে বলুন।

আমি মনে মনে একটু হিসাব করে বলে দেব আপনি কোন অঙ্কটি বাদ দিয়েছেন। সেটা ৫, ৭ নাকি ০, না ৪, সেটা আমি নিমেষে বলে দেব।

আপনি কোন ডিজিটটি বাদ দিয়েছেন, তা আমি কীভাবে বলতে পারলাম? এটাই ধাঁধা। আপনাকে বলতে হবে কীভাবে আমি কিছু না জেনেও বলে দিতে পারি আপনার বাদ দেওয়া গোপন ডিজিটটি।

আমরা ওপরের উদাহরণ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারি। আপনি প্রথমে লিখেছেন ৭৯৪৭৩০৯। একে উল্টিয়ে লিখেছেন ৯০৩৭৪৯৭। এখন হিসাব করে দেখলেন (৯০৩৭৪৯৭ - ৭৯৪৭৩০৯) = ১০৯০১৮৮। এই বিয়োগফলে আছে ৭টি অঙ্ক। এর মধ্য থেকে আপনি আপনার ইচ্ছামতো যেকোনো একটি অঙ্ক বাদ দিয়ে বাকি ৬টি অঙ্কের যোগফলটি শুধু আমাকে বলুন। আমি বলে দেব আপনি কোন অঙ্কটি বাদ দিয়েছেন।

এটা তো আমার জানার কথা নয়। আপনি কোনো কিছুই আমাকে জানাননি। শুধু শেষ যোগফলটি জানিয়েছেন, যার মধ্যে আপনার বাদ দেওয়া অঙ্কটি ধরা হয়নি। তাহলে আমি কীভাবে জানলাম আপনার বাদ দেওয়া গোপন সংখ্যাটি? এটাই ধাঁধা।

ধাঁধাটি পিসি সরকারের  

গণিতের ওপর আমার কয়েকটি বই পড়ে একদিন আখতার ভাই আমাকে এই ধাঁধাটি ধরেন। আখতার ভাই, মানে শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, যিনি আমাদের প্রথমা প্রকাশনে রয়েছেন। তিনি শিশুসাহিত্যিক হলেও গণিতের ধাঁধা জানেন। তিনি বললেন, এটা নাকি জাদুসম্রাট পিসি সরকারের ধাঁধা। ছোটবেলায় তিনি পিসি সরকারের একটা বই পড়ে এটা শিখেছিলেন। পিসি সরকার সেই বইয়ে ছোটদের জন্য সহজ কিছু জাদুর কৌশল লিখেছিলেন। আখতার ভাই বলেন, পিসি সরকার নাকি একবার জাপানে গিয়ে গণিতের এই ধাঁধা ধরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ধাঁধার কৌশলটি রপ্ত করে আখতার ভাইও এই অসাধারণ জাদু দেখিয়ে স্কুলের বন্ধুদের একেবারে বাক্রুদ্ধ করে দিতেন। তিনি বললেন, এ পর্যন্ত কেউ এই ধাঁধার রহস্য বের করতে পারেননি। কারণ, কোন বইয়ে কবে পিসি সরকার এটা লিখে গেছেন, সেই বই এখন বাজারে আছে কি না, কে জানে!

আখতার ভাইয়ের ধারণা ছিল আমিও এই ধাঁধার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব না। কয়েক দিন ব্যস্ত ছিলাম বলে ওই ধাঁধা ভাঙানোর চেষ্টা করিনি। পরে এক বিকেলে মাত্র ২০ মিনিট চিন্তা করে ধাঁধার উত্তর বের করে ফেললাম। শুধু তা-ই নয়, কীভাবে কৌশলটি কাজ করে, এর গাণিতিক ব্যাখ্যাও বের করলাম।

সমাধান

আপনার যোগফলটি যদি এক অঙ্কের (ডিজিট) হয়, তাহলে ৯ থেকে ওই অঙ্কটি বিয়োগ করতে হবে। বিয়োগফলটিই হবে আমার উত্তর। অর্থাত্ আপনি যদি বলেন, যোগফল ৫, তাহলে আমি বলব, আপনি (৯-৫) = ৪ অঙ্কটি বাদ দিয়েছেন।

যোগফলটি যদি ৯-এর বেশি, অর্থাত্ দুই বা তারও বেশি অঙ্কের হয়, তাহলে যোগফলের অঙ্কগুলো যোগ করে এক অঙ্কে যেতে হবে। এরপর ৯ থেকে বিয়োগ করলেই আপনার বাদ দেওয়া অঙ্কটি পাওয়া যাবে।

আপনার যোগফল যদি ৯ হয়, তাহলে বাদ দেওয়া অঙ্কটি হবে (৯ - ৯) = ০ অথবা ৯। এখানে দুটির যেকোনো একটি অঙ্ক হবে উত্তর।

 

কেন ৯ থেকে বিয়োগ করতে হয়

লক্ষ করলে দেখা যাবে যেকোনো সংখ্যাকে উল্টিয়ে লিখে বড় থেকে ছোট সংখ্যাটির বিয়োগফলের অঙ্কগুলোর যোগফল ৯-এর গুণিতক (মাল্টিপল)। অর্থাত্ যোগফলটি সব সময় ৯ দিয়ে বিভাজ্য। এখন যদি একটি অঙ্ক বাদ দিয়ে যোগফল বের করা হয়, তাহলে তাকে ৯ দিয়ে ভাগ করলে মিলবে না, কিছু অবশিষ্ট থাকবে। একটি অঙ্ক বাদ দেওয়ার কারণেই যোগফলটি ৯ দিয়ে বিভাজ্য হচ্ছে না। সুতরাং প্রাপ্ত যোগফলটি ৯ থেকে বিয়োগ করলেই বাদ দেওয়া অঙ্কটি পাওয়া যাবে।

যেমন, গত সংখ্যায় প্রকাশিত উদাহরণে বলা হয়েছে, আপনি প্রথমে লিখলেন ৭৯৪৭৩০৯। একে উল্টিয়ে লিখলেন ৯০৩৭৪৯৭। এখন হিসাব করে দেখলেন (৯০৩৭৪৯৭-৭৯৪৭৩০৯) = ১০৯০১৮৮। এই বিয়োগফলে আছে ৭টি অঙ্ক। এদের যোগফল ২৭। সংখ্যাটি ৯ দিয়ে বিভাজ্য। কিন্তু ধরা যাক আপনি একটি অঙ্ক, ৮ বাদ দিলেন। বললেন, যোগফল ১৯। এখন আমার কাজ। আমি দেখলাম, ১৯-এর অঙ্ক দুটি যোগ করলে পাই, (১ + ৯) = ১০, আবার (১ + ০) = ১। এবার (৯ - ১) = ৮। সুতরাং আমি চট করে বলে দেব যে আপনি ৮ বাদ দিয়েছেন।

 

কীভাবে আমি উত্তরটি বের করলাম

উত্তরটি বের করার জন্য আমি প্রথমে কয়েকটি সংখ্যা নিয়ে পরীক্ষা করলাম। দেখলাম প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংখ্যাগুলোকে উল্টিয়ে লিখে বিয়োগ করলে বিয়োগফল ৯ দিয়ে বিভাজ্য। সুতরাং বুঝলাম এখানে ৯-এর একটি ব্যাপার আছে। পরে একটি সংখ্যা নিয়ে হিসাব শুরু করলাম। যেমন, ৪৭৪৩৭। একে উল্টিয়ে লিখলে হয় ৭৩৪৭৪। বড়টি থেকে ছোটটি বিয়োগ করলে হয় (৭৩৪৭৪ - ৪৭৪৩৭) = ২৬০৩৭। এখন ক্রমান্বয়ে ২, ৬, ০, ৩, ৭ অঙ্কগুলো বাদ দিয়ে অবশিষ্ট অঙ্কগুলোর যোগফল ক্রমান্বয়ে বের করলাম। দেখলাম, ২ বাদ রাখলে যোগফল = ১৬। এর অঙ্ক দুটির যোগফল (১ + ৬) = ৭। এই ৭-কে ৯ থেকে বিয়োগ করে পেলাম ২, যে অঙ্কটি প্রথমে বাদ রেখেছিলাম। যদি দ্বিতীয় অঙ্ক, ৬ বাদ রেখে যোগ করি, ফল হবে ১২, (১ + ২) = ৩ এবং (৯ - ৩) = ৬, যে অঙ্কটি প্রথমে বাদ রেখেছিলাম, সেটিই ফিরে পেলাম। অনুরূপভাবে ক্রমান্বয়ে অন্য অঙ্কগুলো, ০, ৩ ও ৭ বাদ রেখে যোগ করে ৯ থেকে বিয়োগ করে দেখলাম বাদ রাখা অঙ্কটি ফিরে পাওয়া যায়। এভাবে বাদ রাখা অঙ্কটি বের করার নিয়ম আবিষ্কার করলাম। এই পদ্ধতিতে চেষ্টা করে যেকোনো কঠিন সমস্যার সমাধান বের করা যায়।

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত