পাঁচ বনদস্যু ও ১০০ স্বর্ণমুদ্রা 

শিল্পীর কল্পনায় বনদস্যুদের স্বর্ণমুদ্রাছবি: সংগৃহীত
খাবারের খোঁজে একেকজন একেকদিকে যায়। খাবার খুঁজতে গিয়ে একজন চরে খুঁজে পায় একটি মাটির হাড়ি। হাড়িতে আছে ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা।

সুন্দরবনের মাঝখানে একটি চরের খোঁজ পাওয়া গেছে। হরিয়াল চর। পাঁচ বনদস্যুর একটি দল সেই চরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অন্য কেউ দখল করার আগেই হরিয়াল চরের দখল নিতে চায় বনদস্যু দলটি। যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুত তারা চরে গিয়ে দখল নিল। তাদের পাঁচ জনের বয়স ভিন্ন ভিন্ন। সবচেয়ে বড় জনের নাম কাদের। তার বয়স ৬০ বছর। তার ছোট নাদেরের বয়স ৫০ বছর। এরপর পর্যায়ক্রমে যদু, জাহিদ ও জনির বয়স যথাক্রমে ৪০, ৩০ ও ২০ বছর।

চরে পৌঁছে তারা বিশ্রাম নেয়। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। খাবারের খোঁজে একেকজন একেকদিকে যায়। খাবার খুঁজতে গিয়ে একজন চরে খুঁজে পায় একটি মাটির হাড়ি। হাড়িতে আছে ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কাদেরের কাছে এনে রাখা হয় মুদ্রাগুলো। এখন এগুলো ভাগ করে নেওয়া হবে। কিন্তু তারা কেউ কাউকে ভাগ দিতে রাজি নয়। সবাই চায় নিজেই পুরো ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে নিতে। এখানে জানিয়ে রাখি, তারা পাঁচ জনই জ্ঞানী, লোভী ও হিংস্র প্রকৃতির মানুষ। অর্থের লোভে রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করবে না। 

প্রশ্ন হলো, কাদের কীভাবে ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা ভাগ করবে? সে সর্বোচ্চ কয়টি স্বর্ণমুদ্রা নিতে পারবে? 

এ অবস্থায় তারা একটি সিদ্ধান্ত নেয়। যে সবচেয়ে বড়, সে প্রথমে ঠিক করবে, স্বর্ণমুদ্রাগুলো কীভাবে ভাগাভাগি হবে। তার মতামতের সঙ্গে যদি দলের অর্ধেক বা তারচেয়ে বেশি মানুষ একমত হয়, তাহলে সেভাবে ভাগাভাগি হবে। কিন্তু যদি অর্ধেকের বেশি মানুষ তার মতামতের বিরোধিতা করে, তাহলে তাকে চর থেকে বের করে দেওয়া হবে। এরপর বাকি চারজনের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, সে মতামত দেবে। তার মতামতও গ্রহণযোগ্য না হলে তাকেও চর থেকে বের করে দেওয়া হবে। এভাবে শেষ পর্যন্ত সবাইকে সুযোগ দেওয়া হবে। 

দলের মধ্যে কাদের যেহেতু সবচেয়ে বয়স্ক, তাই তাকেই প্রথম সিদ্ধান্ত দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। এখন প্রশ্ন হলো, কাদের কীভাবে ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা ভাগ করবে? সে সর্বোচ্চ কয়টি স্বর্ণমুদ্রা নিতে পারবে? 

এ পর্যন্ত পড়ার পরে নিজেই চিন্তা করুন, কাদেরের জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন? কীভাবে নিজে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা পেতে পারেন। তবে মাথায় রাখতে হবে, অন্তত তিন জনের সমর্থন না পেলে কিন্তু আপনাকে এই চর থেকে বের করে দেওয়া হবে। কোনো স্বর্ণমুদ্রা তো পাবেনই না, বরং রাত-বিরেতে সুন্দরবনের গহীনে প্রাণটাও যেতে পারে। 

সমাধান

শুরুতে মাথায় রাখতে হবে, এই চর থেকে কেউ একা বের হতে চাইবে না। কারণ, একা একা গহীন সুন্দরবনে জীবননাশের শঙ্কা আছে। তাই সবাই চাইবে চরে থাকতে এবং একসঙ্গে বাড়ি ফিরতে। স্বর্ণমুদ্রা না পেলেও যাতে তাদের জীবন বেঁচে যায়, সেই চেষ্টা সবাই করবে। এখন কাদেরকে এমন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে, যাতে তাকে অন্তত দুজন ভোট দেয়। মানে সে ছাড়াও যেন আরও দুজন তার পক্ষে থাকে। তাহলে সে-সহ মোট ৩ জন থাকবে এক পক্ষে। অর্থাৎ, তাকে চর ছেড়ে যেতে হবে না। 

পাঁচ জনের মধ্যে কাদের সর্বোচ্চ কয়টি স্বর্ণমুদ্রা পেতে পারে, তা বুঝতে হলে পাঁচ জনের পরিবর্তে প্রথমে দুজন নিয়ে কল্পনা করতে হবে। ধরুন, ওখানে যদি শুধু কাদের ও নাদের থাকত, তাহলে হিসাবটা কেমন হতো? সে ক্ষেত্রে কাদের ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা নিত এবং নাদেরকে একটাও দিত না। এতে নাদেরের কিন্তু করার কিছু নেই। কারণ শর্ত মেনে কাদের এ কাজ করেছে। কীভাবে? 

ধরুন, নাদের একটিও স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে কাদেরের মতামতের বিরোধিতা করল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষ যেহেতু দুজন, তাই নাদের বিরোধিতা করলেও সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ভোট তার বিপক্ষে যাবে। বাকি নিজের ৫০ শতাংশ ভোটের কারণে (যেহেতু সে নিজে নিজেকে ভোট দিচ্ছে) সে ১০০ স্বর্ণমুদ্রাই পাবে। অর্থাৎ নাদেরের বাধ্য হয়ে এটা মানতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভাগাভাগি হবে ১০০ ও ০ আকারে। 

এবার ভাবুন, দুজনের পরিবর্তে ওই চরে তিনজন আছে। এবার কিন্তু সমাধান করা সহজ হবে না। কারণ এখানে অর্ধেক মতামতের জন্য কমপক্ষে দুজনের মত মিলতে হবে। অর্থাৎ কাদেরের কথায় সায় দিতে হবে বাকি দুজনের যেকোনো একজনকে। তাহলে কাদেরসহ বাকি একজনের ভোটের কারণে কাদেরের ভোট ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কাদের নিজের পক্ষে টানবে দুজনের অন্তত একজনকে। অর্থাৎ কাদের চাইবে যদুকে কমপক্ষে ১টি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে হলেও নিজের পক্ষে রাখতে। কারণ কাদেরের পক্ষে যদি যদু না আসে, তাহলে কাদেরকে চর থেকে বের করে দেওয়া হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাবে নাদের। আর নাদের যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায়, তখন ওপরের দুজনের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটা ঘটবে যদুর ভাগ্যে। অর্থাৎ নাদের ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে নেবে, যদুকে একটিও দেবে না। তাহলে কাদেরের চর থেকে চলে যাওয়া যদুর জন্য ক্ষতিকর। কারণ কাদের চরে থাকলে যদু অন্তত একটি স্বর্ণমুদ্রা পাবে। কিন্তু কাদেরকে বের করে দেওয়া হলে যদু একটাও পাবে না। তাই যদু কাদেরের পক্ষে থাকবে।

এ ক্ষেত্রে আপনাদের মনে হতে পারে, যদু কেন শুধু একটি স্বর্ণমুদ্রায় রাজি হবে? সে তো আরও চাইতে পারে। কিন্তু যদুর চাওয়ায় আসলে লাভ হবে না। কারণ এখানে সবাই লোভী। ফলে কাদেরের কথা মানলে যদু অন্তত একটি মুদ্রা পাবে। আর না মানলে একটিও পাবে না। তাই বাধ্য হয়েই সে কাদেরের কথা মানবে।  তখন ভাগাভাগি হবে ৯৯, ০ ও ১ আকারে।

এবার ধরুন, চরে চারজন মানুষ আছে। এবার কীভাবে ভাগাভাগি হবে? আগের নিয়মই চলবে। যদি কাদেরকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে নাদের ৯৯টি, যদু ০ এবং জাহিদ একটি স্বর্ণমুদ্রা পাবে। সবাই যেহেতু জ্ঞানী এবং লোভী, তাই সবাই একইরকম ভাববে। নিজের কতটা আখের গোছানো যায়, সেই চেষ্টাই করবে। খেয়াল করুন, তিন জন থাকলে যদু একটি মুদ্রা পেত। কিন্তু কাদেরকে বের করে দিলে যদুর ক্ষতি। আর এখানে কাদেরকে জিততে হলে অন্তত একজনের ভোট লাগবে। নিজের ভোট তো আছেই। তাই কাদের এখানে আবার যদুকে মাত্র একটি স্বর্ণমুদ্রা দেবে এবং নিজে ৯৯টি রাখবে। আর নাদের এবং জাহিদকে একটিও মুদ্রা দেবে না। ফলে তার নিজের ভোটসহ যদুর ভোট নিয়ে তার পক্ষে মোট ভোট হবে ২টি। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ। ফলে এ ক্ষেত্রে ভাগাভাগি হবে ৯৯, ০, ১ ও ০ আকারে। 

এবার আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। অর্থাৎ, পাঁচজন মানুষের মধ্যে কাদের কীভাবে মুদ্রাগুলো ভাগাভাগি করবে। এখানে তার জিততে হলে নিজে ছাড়াও অন্তত দুজনের ভোট লাগবে। আর তার নিজের ভোটসহ মোট ভোট হবে তিনটি। এখানেও আগের যুক্তি কাজ করবে। অর্থাৎ কাদের বের হয়ে গেলে নাদের হবে নেতা। তখন নাদের ৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে জাহিদকে একটি মুদ্রা দেবে। আর জদু ও জনিকে কিছুই দেবে না। অর্থাৎ কাদের না থাকলে যদু ও জনির ক্ষতি। কারণ তারা দুজন নাদেরের কাছ থেকে কোনো স্বর্ণমুদ্রাই পাবে না। তাই কাদের এবার যদুর পাশাপাশি জনিকে একটি স্বর্ণমুদ্রা দেবে। খেয়াল করুন, কাদের না থাকলে যদু ও জনি ফিরবে শূন্য হাতে। কিন্তু কাদের থাকলে তারা দুজন অন্তত একটি স্বর্ণমুদ্রা পাবে। তাই যদু ও জনি কাদেরকে ভোট দেবে। অর্থাৎ তখন ভাগাভাগি হবে ৯৮, ০, ১, ০ ও ১ আকারে। 

সুতরাং এই সমস্যা সমাধানে কাদের সর্বোচ্চ ৯৮টি স্বর্ণমুদ্রা এবং যদু ও জনি একটি করে স্বর্ণমুদ্রা পাবে। এতে তাদের নিয়মও ঠিক থাকবে এবং সবাই অন্তত প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। 

সূত্র: ম্যাথ ইজ ফান ডট কম অবলম্বনে