অসীমের দেখা পেয়েছিলেন রামানুজন

এইচ হার্ডির সামনে বসে আছেন এক তরুণ। সামনে তাঁর আবিষ্কার করা অনেকগুলো ফর্মুলা। সেগুলো তিনি ছাপাতে চান। এ জন্যই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের গণিতের এই অধ্যাপকের কাছে সুদূর ভারত থেকে আসা। তাঁর আরও অনেক ফর্মুলা নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু হার্ডির কথা, প্রমাণ ছাড়া এসব কিছুই ছাপানো যাবে না। আর তরুণ বারবার বলছেন, এগুলো তো সবই ঠিক ফর্মুলা! দেরি কেন!

হার্ডি তরুণটিকে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরিতে। বললেন, জীবনে সম্মানিত হওয়ার অনেক উপায় আছে। কিন্তু তাঁর মতে, সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে লাইব্রেরির এই তাকগুলোয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যাওয়া। এখানে বায়রনের কবিতা আছে, আছে মরগ্যান বাইবেল, সেন্ট পলের চিঠি। আর আছে আইজ্যাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা

হার্ডির মতে, এই তরুণের আবিষ্কার নিউটনের বইটির মতোই মূল্যবান। ফর্মুলাগুলো প্রমাণিত হলে তার নোটবুকের স্থান হবে ট্রিনিটি কলেজের এই লাইব্রেরিতে।

তরুণের নাম শ্রীনিবাস রামানুজন। গণিতে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি বা শিক্ষা না থাকলেও এমনই অসামান্য অর্জন কী করে করেছিলেন রামানুজন, সেই ব্রিটিশ ভারতে! চেন্নাইয়ের এক দরিদ্র কেরানি থেকে কী করে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন সেটাই দেখা যায় ব্রিটিশ ছবি দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটিতে।

ছবিটি নির্মাণ করেছেন ম্যাট ব্রাউন, মুক্তি পেয়েছে ২০১৫ সালে। ঘটনার শুরু ১৯১৪ সালে। চেন্নাইয়ের নাম তখন মাদ্রাজ। ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান রামানুজন দিনের বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকেন মন্দিরে। ঈশ্বরের আরাধনা করা ও মন্দিরের মেঝেতে চক দিয়ে অঙ্কচর্চাই তাঁর বড় কাজ। চাকরির জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বলে কেরানির চাকরিটিও জোটে না।

শেষ পর্যন্ত যেখানে কাজ মিলল, সেখানকার বড় কর্তা নারায়ণ আইয়ার রামানুজনের কাজ দেখে আকৃষ্ট হলেন। গণিতের যে সূত্রগুলো রামানুজন আবিষ্কার করেছেন, নারায়ণ সেগুলো বুঝতে পারেন না, কিন্তু এগুলোর সম্ভাবনা আঁচ করতে পারেন।

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জি এইচ হার্ডির কাছে রামানুজনের কাজ পাঠিয়ে দেন নারায়ণ। হার্ডি প্রথমে ভেবেছিলেন গণিতবিদ বন্ধু জন লিটলহুডের পাঠানো কাজ এগুলো। অনেক দিন থেকেই হার্ডির সঙ্গে জন কাজ করতে চাইছিলেন। পরে যখন হার্ডি জানতে পারলেন, না, সে রকম কিছু নয়, তখন রামানুজনের চিঠির উত্তর দিলেন। রামানুজনকে ডেকে পাঠালেন কেমব্রিজে।

রামানুজন তো দারুণ খুশি। স্ত্রী জানকী বিদায় জানাতে প্রস্তুত হলেও বেঁকে বসলেন মা। চার সন্তানকে গর্ভে ধরেও শেষ পর্যন্ত তাঁর বড় ছেলেটিই কেবল বেঁচে আছে। দেড় বছর বয়সে বসন্ত রোগে প্রায় মরতে মরতে ফিরেছেন রামানুজন। কী করে একমাত্র সন্তানকে কাছছাড়া করবেন মা? আর ব্রাহ্মণসন্তানের সাগর পাড়ি দেওয়াও তো মানা।

কিন্তু রামানুজনের দৃঢ়তায় একসময় মা বাধ্য হলেন রাজি হতে। রামানুজন এলেন কেমব্রিজে। ট্রিনিটি কলেজ ক্যাম্পাসে আছে নিউটনের বিখ্যাত সেই আপেলগাছ! দেখে দারুণ অনুপ্রাণিত হলেন রামানুজন।

রামানুজনের উচ্ছ্বাস কমে গেল হার্ডির সঙ্গে দেখা করে। অকৃতদার এই অধ্যাপক বড্ড নীরস। সংখ্যা ছাড়া বোঝেন না কিছুই। কিন্তু রামানুজনের কাছে তাঁর সূত্রগুলো হচ্ছে পেইন্টিংয়ের মতো। প্রকৃতির সব উপাদানের মধ্যেই প্যাটার্ন দেখতে পান তিনি। এগুলো ঈশ্বরের অভিব্যক্তি হিসেবে ধরা দেয় তাঁর কাছে। মোত্সার্টের মাথায় থাকে তাঁর পুরো সিম্ফনি, তেমনি রামানুজনও দেখতে পান ফর্মুলা। কিন্তু সেগুলোর প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।

হার্ডি বোঝেন, রামানুজন হলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর গণিতবিদ লিওনার্দ অয়লারের মতো প্রতিভা। অয়লার বেশির ভাগ গাণিতিক ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন চোখের দৃষ্টি খোয়ানোর পর। আরেক গণিতবিদ কার্ল জ্যাকোবিও এভাবে মনে মনে আবিষ্কার করতেন গাণিতিক সূত্র। তবুও হার্ডি প্রমাণ চান। কারণ, তিনি জানেন সূত্রগুলো প্রমাণিত না হলে বার্ট্রান্ড রাসেল, জন লিটলহুডের সমর্থন পেলেও পেতে পারে, কিন্তু ট্রিনিটি কলেজের বাকি ফেলো অধ্যাপকেরা কিছুতেই স্বীকৃতি দেবেন না রামানুজনের এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে।

হার্ডির প্রেরণায় রামানুজন দিন-রাত লাগিয়ে তাঁর সূত্রগুলো প্রমাণের চেষ্টা করতে থাকেন। ভালোবাসার মানুষ জানকীকে ছেড়ে থাকতে বড় কষ্ট হয় তাঁর। জানকীর চিঠি অনেক দিন পান না তিনি। কী করে পাবেন, রামানুজনের মা জানকীর চিঠি পাঠাতেই দেন না। রামানুজনের চিঠিও জানকীকে দেন না তিনি। তাঁর ধারণা, জানকীও যদি বিলেতে চলে যায়, তাহলে রামানুজন আর ফিরে আসবেন না।

মায়ের কথায় ব্রাহ্মণ রামানুজন নিরামিষাশী থেকে যান, কিন্তু ওই ঠান্ডার দেশে এত পরিশ্রমের পর এ খাবার তাঁকে পর্যাপ্ত শক্তি দিতে পারে না। এরই মধ্যে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। খাবারের জোগান আরও কমতে থাকে। তা ছাড়া রামানুজন শিকার হন বর্ণবৈষম্যেরও। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধরা পড়ে প্রাণনাশী যক্ষ্মা।

এরই মধ্যে রামানুজন-আবিষ্কৃত পার্টিশন নির্ণয়ের ফর্মুলা প্রমাণিত হয়। এ আবিষ্কারে গাণিতিক ইনফিনিটির একধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। জি এইচ হার্ডির প্রচেষ্টায় রামানুজন পান রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ (এফআরএস)। বাঙালিদের মধ্যে জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশেরাও পেয়েছিলেন এই ফেলোশিপ। একটু সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন রামানুজন। কথা ছিল, আবার আসবেন কেমব্রিজে। কিন্তু ফেরার পথে অসুখটা বেড়ে যায়। আর কমেনি। ১৯২০ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন।

সিনেমায় রামানুজনের চরিত্রে দেব প্যাটেল ও জি এইচ হার্ডির চরিত্রে জেরেমি আয়রনস অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ছবির খাতিরেই রামানুজনের গাণিতিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অবদানের কথা বিশদভাবে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু পারিবারিক টানাপোড়েন ও প্রবাসের বৈরী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে কীভাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তার একটি মানবিক চিত্রায়ণ পাওয়া যাবে।

রামানুজনের ফর্মুলা এখন ব্যবহার হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃতি বোঝার জন্য। ১৯৭৬ সালে রামানুজনের শেষ দিককার একটি নোটবুক আবিষ্কৃত হয়। এ ঘটনাকে তুলনা করা হয়েছিল বেটোফেনের দশম সিম্ফনি আবিষ্কারের সঙ্গে। রামানুজনের সেই লস্ট নোটবুক এখন আছে ট্রিনিটি কলেজের লাইব্রেরিতে, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকার সঙ্গে।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: ফেমাস ম্যাথমেটিশিয়ানস ডট কম

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত