এমি নোয়েদার: গণিতের নিঃস্বার্থ প্রাণ

১৯১৫ সাল। আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের অপেক্ষায়। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেন না। কারণ একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না কিছুতেই। সমস্যা সমাধান না হলে তত্ত্বটি প্রকাশ করাও অসম্ভব। ফলে কোন উপায় না দেখে আইনস্টাইন হাজির হলেন জার্মানির গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড হিলবার্টের কাছে। হিলবার্টের সাথে দেখা করে আইনস্টাইন তাঁর সমস্যার কথা জানলেন। আলাপ-আলোচনা করে অবশেষে একটি সমাধানে পৌঁছালেন। আইনস্টাইন সে বছরের শেষের দিকে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বটি প্রকাশ করলেন। হিলবার্টও তাঁর নিজস্ব গাণিতিক পদ্ধতিতে আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করলেন।

কিছুদিন পরে হিলবার্ট দেখলেন আপেক্ষিক তত্ত্বের সমাধানে ভুল আছে। সাধারণ কোনো ভুল নয়। এই ভুলের কারণে পাল্টে যাবে গোটা পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি।

ভুলটা কী ছিল?

শক্তির নিত্যতার সূত্র সমস্যা দেখা দিচ্ছে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে। নিত্যতা নীতি অনুসারে, শক্তি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে। এতে মোট শক্তির কোন পরিবর্তন হয় বা। ফলে কোন বস্তুর শক্তি কমলে গতিও কমবে। কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রথম সংস্করণে বলা হচ্ছিল, বস্তুর শক্তি কমলে গতি আরও বেড়ে যায়। হিলবার্ট খবরটা দিলেন আইনস্টাইনকে। আইনস্টাইন জানালেন, তাঁদের পক্ষে এই সমস্যার গাণিতিক সমাধান করা সম্ভব নয়। এমন কাউকে দরকার যার গণিতের দক্ষতা তাঁদের চাইতে বেশি। হিলবার্টের পরিচিত এমন একজন গণিতবিদ আছেন অবশ্য। তিনি একজন নারী। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় নারীদের জন্য পড়ালেখা করাই প্রায় অসম্ভব। সেখানে একজন নারী যে কিনা আইনস্টাইনের সমস্যার সমাধান করবে? হ্যাঁ। সেই নারীর নাম এমি নোয়েদার।

হিলবার্ট এমিকে ডাকলেন গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। খবর পেয়ে ছুটে এলেন এমি। আইনস্টাইন ও হিলবার্ট মিলে বোঝালেন তাঁদের সমস্যার কথা। এমি মনোযোগ দিয়ে সেই সমস্যা শুনলেন এবং সমাধানের জন্য কাজে লেগে পড়লেন। এমি সমস্যার সমাধানও করলেন। এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে একটি নতুন তত্ত্বের জন্ম দিলেন তিনি। তত্ত্বের নাম নোয়েদার তত্ত্ব। ১৯১৮ সালে তাঁর এই তত্ত্বটি প্রকাশিত হয়েছে। এমির মতে, মহাকর্ষ আর বস্তুকে আলাদা মাত্রায় না দেখে একই মাত্রায় দেখতে হবে। তাহলে শক্তির নিত্যতার নীতি ঠিক থাকবে। এভাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের সমস্যার সমাধান করেছিলেন এমি নোয়েদার। তবে এই পর্যন্ত আসতে আনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি।

দুই

তাঁর পুরো নাম এমি এমিলি নোয়েদার। ১৮৮২ সালের ২৩ মার্চ জার্মানির ছোট্ট শহর এর্লানজেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ম্যাক্স নোথার ছিলেন এর্লানজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের নামকরা অধ্যাপক। পরে অবশ্য তিনি ব্যবসায়ী হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। এমির মায়ের নাম এমিলিয়া কাউফম্যান। এমির মায়ের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। সেই সূত্রেই ম্যাক্স নোথার পরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এমিই ঘরের বড় মেয়ে। তাঁর পরে আরো তিনটি ভাই জন্মেছেন নোয়েদার পরিবারে।

ছোটবেলা থেকেই এমি মায়ের কথা মতো চলতেন। মা তাঁকে আর পাঁচ জন সাধারণ মেয়েদের মতো বড় করেছেন। মেয়েকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কল্পনাও করেননি। বাবাও মেয়ের লেখাপড়ার দিকে তেমন খেয়াল করেননি। মেয়েদের সে সময় পড়ালেখার চল ছিল না। মা তাঁকে পিয়ানো বাজানো শিখিয়েছিলেন। কিন্তু এমির তা পছন্দ ছিল না। তাঁর পছন্দ ছিল নাচ। সঙ্গে তখন থেকেই গণিতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় এমির।

একটু বড় হলেই এমি একটি উচ্চ শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। ১৮ বছর বয়সে সেখান থেকে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করলেন ইংরেজি ও ফরসি। ছোটবেলা থেকে বাবার মত গণিতের শিক্ষক হওয়া যার স্বপ্ন, সেই এমি হলেন ইংরেজি ও ফরসি ভাষার শিক্ষক। এমির মন মানে না। তিনি বাচ্চাদের পড়ানোর চাকরি ছেড়ে দিলেন। বাবাকে অনুরোধ করলেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন এমিকে পড়তে দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়ে বলে তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি এর্লানজেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমিও হাল ছাড়ার পাত্রি নন। পরে বাধ্য হয়ে এমিকে শুধু বক্তৃতা শোনার সুযোগ দেওয়া হলো। শর্ত একটাই, এমি কোনো পরীক্ষা দিতে পারবেন না। কথায় আছে, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এমি মেনে নিলেন এই শর্ত। ১৯০০ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত এভাবে শিখেছেন। পরের বছর জুলাই মাসে এমি নুরেনবার্গ শহরে যান এবং ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। তবে এখানেও একটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। তিনি গণিত বিষয়ে জার্মানির যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবেন। কিন্তু সরকারি খাতায় তাঁর নাম থাকবে না। অর্থাৎ সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। এমি মেনে নিলেন। তবুও গণিতকে ছাড়বেন না তিনি।

এমি গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এখানে এক সময় পড়েছেন ও পড়িয়েছেন কার্ল ফ্রেডরিখ গাউস ও বার্নাড রিম্যানের মতো বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদেরা। এমির গণিতের শিক্ষক ছিলেন, হারমান মিনওয়াস্কি- যিনি আইনস্টাইনেরও শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া ছিলেন ডেভিড হিলবার্ট, যিনি বিংশ শতাব্দীর সেরা গণিতবিদদের একজন।

১৯০৪ সালে এমির জন্য একটি সুসংবাদ আসে। তাঁর নিজের শহর এর্লানজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার সম্মতি দেওয়া হয়েছে। এমি এর্লানজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন। পল গর্ডনের তত্ত্ববধানে ২৫ বছর বয়সে সম্পন্ন পিএইচডি সম্পন্ন করলেন।

১৯০৮ সালে ড. এমি এলার্নজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এখানেও একটি শর্ত দেওয়া হলো। কোনো বেতন পাবেন না। এতেও রাজি এমি। গণিতের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি নিরলসভাবে। কিন্তু খেয়েপরে জীবন তো বাঁচাতে হবে! বাবা-মা সব সময় মেয়েকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন।

তিন

এমি প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করছেন বিনা বেতনে। অন্যদিকে গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভিড হিলবার্ট কাজ করছেন বিমূর্ত বীজগণিত নিয়ে। এমি হিলবার্টের কাজের ওপর নজর রাখতেন। হিলবার্টের কাজ শেষ হওয়ার পর এমি সেগুলোকে আরো প্রসিদ্ধ ও সংশোধন করেছিলেন। এভাবেই এমির গাণিতিক জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়েছিল হিলবার্ট। এমির কাজ দেখে মুগ্ধ হিলবার্ট। এমিকে গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে আবেদন করতে বলেন। অতি উৎসাহ নিয়ে এমি আবেদন করলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা অনুষদের অধ্যাপকেরা। তাঁদের মতে, একজন নারীর পায়ের নিচে বসে পুরুষরা পড়বে? এটা কোন ভাবে সম্ভব নয়। এমি জানতেন তাঁর সাথে এমনটাই হবে। তাই তিনি গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখলেন- আমি আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে নয় বরং ডেভিড হিলবার্টের সহকারী হিসাবে যোগ দিতে চাই। বিনিময়ে আমাকে কোনো বেতন দিতে হবে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সকল লেকচার ড. হিলবার্টের নামে প্রকাশিত হবে। ফলে নারীদের লেখা লেকচার বলে কেউ অবহেলা করবে না। এমির এমন উদার চিঠি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর না করতে পারেনি। এর কিছুদিন আগেই আইনস্টাইন তাঁর সমস্যা নিয়ে হিলবার্টের কাছে এসেছিলেন। এরপর এমি নোয়েদার এলেন, সমস্যা দেখলেন এবং সেই সমস্যার সমাধানও করে দিলেন। আইনস্টাইন এমির সম্পর্কে বলেছিলেন, আমার দেখা সেরা কয়েকজন গণিতবিদদের মধ্যে একজন এমি নোয়েদার।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পুরুষ শিক্ষকেরা গেছেন যুদ্ধে। অনেকে মারা গেছেন যুদ্ধে। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাব দেখা দেয়। ভাগ্য খুলে যায় এমির। ৩৭ বছর বয়সে গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হন। কিন্তু শর্ত আছে এখানেও। যুদ্ধের কারণে দেশের অবস্থা খারাপ। তাই প্রথম তিন বছর কেউ বেতন পাবেন না। এদিকে প্রভাষক হওয়ার দুই বছরের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। মা মারা গেছেন ১৯১৫ সালে। অবশ্য ৪০ বছর বয়সে প্রথম বেতন পান তিনি।

চার

নোয়েদারের তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘঠিয়েছিল। ১৯১৯ সালে এমি পুরপুরি গণিতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বিমূর্ত বীজগণিতের অন্যতম প্রধান স্থপতি এমি নোয়েদার। বিমূর্ত বীজগণিত ছাড়াও গণিতে অনেক অবদান রয়েছে এমির। রিং তত্ত্ব, গ্রুপ তত্ত্ব, টপোলজি, ফিল্ড তত্ত্ব, স্বাভাবিকরণ তত্ত্ব, নোয়েদারনিয়ান সমস্যাসহ গণিতের আরও অনেক বিষয়ে কাজ করেছেন তিনি।

১৯৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে এমির ক্যারিয়ার শুরু হয়। চারিদিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আইনস্টাইনের সমস্যা সমাধান করে রীতিমত তারকা বনে যান। আইনস্টাইনও তখন তারকাদের চেয়ে কম কিছু নন। কিন্তু সুখ বেশি দিন সইলো না এমির কপালে। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি এডলফ হিটলার ক্ষমতায় বসলেন। ইহুদিদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করলেন। এমি নোয়েদারও ইহুদি ছিলেন। চাকরি চলে গেল এমির। পড়লেন আবার বিপদে। পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। পেনিসেলভিনিয়ার ব্রায়ান মার নামে একটি গার্লস কলেজ ছিল। এমি ১৯৩৩ সালে সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৫ সালে তাঁর টিউমার ধরা পড়ে। অপারেশন করিয়েছিলেন। অপারেশনের একদিন পর হঠাৎ তাঁর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ১৪ এপ্রিল তিনি মারা যান।

এমি তাঁর সারা জীবন গণিতের পেছনে ব্যয় করেছেন। গণিত ছাড়া অন্য কোন ব্যাপারে তাঁর মনোযোগ ছিল না। ছোটবেলায় যে নাচ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল, তাও ভুলে গেছেন বড় হতে হতে। বিয়ে করেননি সারাজীবনে। গণিতের প্রেমে এতই মগ্ন ছিলেন যে, নিজের শরীরে প্রতিও তেমন যত্ন নিতেন না। অর্থের জন্য কোনদিন ভাবেননি। গণিতের প্রতি তিনি কতটা নিঃসার্থ ছিলেন তাঁর প্রমাণ সারা জীবন দিয়েছেন এমি নোয়েদার।

১৪ এপ্রিল এই গণিতবিদের মৃত্যুবার্ষিকী। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর জন্য রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারী তিতুমীর কলেজ, ঢাকা