আমরা সবাই A4 (এ ফোর) সাইজের কাগজ ব্যবহার করি। এর দৈর্ঘ্য ১১.৬৯ ইঞ্চি (২৯.৭ সেমি) ও প্রস্থ ৮.২৭ ইঞ্চি (২১ সেমি)। সংখ্যাগুলো দেখে মনে হয় না যে এদের মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু থাকতে পারে। কিন্তু না! এই বিশেষ আকারের পেছনে রয়েছে সুচিন্তিত এক গাণিতিক মডেল।
A সিরিজের কাগজের মধ্যে A4 সবচেয়ে পরিচিত। এ ছাড়া আছে A0 (এ জিরো), A1, A2, A3, A4.....A10 পর্যন্ত। চাইলে তা আরও বিস্তৃত করা সম্ভব। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আকার হলো A0 (১১৮.৯ সেমি × ৮৪.১ সেমি)। আসলে অ-এর পাশের সংখ্যা যত বাড়ে, আকার তত ছোট হয়।
A সিরিজের কাগজের যে দুটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হয়েছে, তার উভয়টির ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত সমান: ২৯.৭/২১=১১৮.৯/৮৪.১=১.৪১৪ (প্রায়)। এই অনুপাত A সিরিজের কাগজের সব মাপের জন্য সত্য। সংখ্যাটিকে কি পরিচিত মনে হচ্ছে? হওয়ারই কথা, কারণ √২ = ১.৪১৪ (প্রায়)। অর্থাৎ A সিরিজের কাগজের দৈর্ঘ্য সব সময় এর প্রস্থের √২ গুণ হয়। এত কিছু রেখে এই অনুপাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী? সেটি বোঝার জন্য একটি আয়ত আঁকা যাক, যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত √২:১। এখন একে দৈর্ঘ্যের ঠিক মাঝ বরাবর প্রস্থের সমান্তরালে রেখা টেনে দ্বিখণ্ডিত করলে যে দুটি আয়ত পাওয়া যাবে, তাদের প্রত্যেকের আকার হবে: √২/২ একক (= ১/√২ একক)( ১ একক)। বড় পাশটিকে (এখানে ১ একক) দৈর্ঘ্য এবং ছোটটিকে (এখানে ১/√২ একক) প্রস্থ মনে করলে ক্ষুদ্রতর আয়ত দুটির প্রত্যেকের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত আবারও সেই √২:১ পাওয়া যায়। কেননা, ১ কে ১/√২ দিয়ে ভাগ করলে হয় √২। তার মানে, √২:১ অনুপাতবিশিষ্ট কোনো কাগজকে দৈর্ঘ্যের মাঝ বরাবর কাটলে বা ভাঁজ করলে কাগজটি যে দুটি অংশে বিভক্ত হয়, সেই অংশগুলোরও দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত √২:১ হয়। এ রকম দ্বিখণ্ডিত করার প্রক্রিয়া যতবারই চালানো হোক না কেন, অনুপাতটি অপরিবর্তিত থাকে। এটিই A সিরিজের কাগজের মাপের মূলনীতি। A0 সাইজের কাগজকে দ্বিখণ্ডিত করলে পাওয়া যায় A1। আবার A1 সাইজের কাগজকে দ্বিখণ্ডিত করলে পাওয়া যায় A2; A2 সাইজের কাগজকে দ্বিখণ্ডিত করলে পাওয়া যায় A3; A3 সাইজের কাগজকে দ্বিখণ্ডিত করলে যে মাপ পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় A4... ইত্যাদি। অন্যভাবে বললে, A0 সাইজের কাগজকে যথাক্রমে শূন্য বার, একবার, দুবার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার...ক্রমাগত দ্বিখণ্ডিত করতে থাকলে যথাক্রমে A0, A1, A3, A4, A5...সাইজের কাগজ পাওয়া যায়।
তাহলে A0 সাইজের কাগজের মাপ জানা থাকলে সেখান থেকে হিসাব করে সহজেই যেকোনো অহ সাইজের মাপ বের করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো এই প্রাথমিক মাপ (A0⇒১১৮.৯ সেমি ( ৮৪.১ সেমি) নির্ধারণ করা হলো কিসের ভিত্তিতে? কাগজটি কতখানি পুরু বা পাতলা, তা বোঝাতে ব্যবহৃত একক হলো মংস (Gram per square meter) বা g/m2, যা ওই কাগজের প্রতি বর্গমিটারের ভর নির্দেশ করে। এই এককটিকে অনেক সময় সংক্ষেপে শুধু মত্ধস ডাকা হয়। যেমন: ৬০ গ্রাম কাগজ, ৮০ গ্রাম কাগজ, ১২০ গ্রাম কাগজ ইত্যাদি। যদিও এভাবে বললে এককটির প্রকৃত তাত্পর্য বোঝা যায় না। কোনো কাগজ যদি ১ gsm হয়, তাহলে বুঝব তার এক বর্গমিটার কেটে ভর মাপলে এক গ্রাম হবে। যত বেশি gsm, তত পুরু কাগজ। A0 সাইজের কাগজের মাপ এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে তার ক্ষেত্রফল এক বর্গমিটার হয়: ১১৮.৯ সেমি x ৮৪.১ সেমি=৯৯৯৯.৪৯ বর্গসেমি=১ বর্গমিটার (প্রায়)। তার মানে, A0 সাইজের কাগজের পুরুত্ব যত gsm হবে, তার একটা শিটের ভরও তত গ্রাম। যেমন একই পুরুত্ববিশিষ্ট ১০০টি A0 সাইজের কাগজের শিটের মোট ভর যদি ৮ কম (আট কেজি) হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেগুলো 80 gsm (আশি জিএসএম) কাগজ। আবার, A4 সাইজের কাগজের ক্ষেত্রফল যেহেতু A0 সাইজের কাগজের ষোলো ভাগের এক ভাগ (১/৪২= ১/১৬) সেহেতু A4 সাইজের একটি 80 gsm শিটের ভর ৮০/১৬ গ্রাম = ৫ গ্রাম। তাই gsm এককে অ সিরিজের যাবতীয় কাগজের ভর হিসাবের সুবিধার্থে A0 সাইজের কাগজের ক্ষেত্রফল এক বর্গমিটার ধরা হয়েছে।
দুটি শর্ত মেনে A0 সাইজের মাপ নির্ধারিত হয়েছে: প্রথমত, দৈর্ঘ্য, প্রস্থের √২ গুণ এবং দ্বিতীয়ত, ক্ষেত্রফল এক বর্গমিটার। দৈর্ঘ্য x মিটার ও প্রস্থ-মিটার ধরলে শর্ত দুটি যথাক্রমে x= y√২এবং xy = ১ এই দুটি সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। দ্বিতীয় সমীকরণে প্রথমটি থেকে x-এর মান বসিয়ে পাওয়া যায়, y√2×y = ১⇒y2 = 1/√2⇒y =√(১/√২) = ০.৮৪১ মিটার(প্রায়)= ৮৪.১ সেমি (প্রায়)। একইভাবে সমাধান করলে পাওয়া যায়, x = ১১৮.৯ সেমি (প্রায়)।
এখন প্রশ্ন, একই অনুপাত বজায় রেখে দ্বিখণ্ডিত করার এই ব্যবস্থা কেন বেছে নেওয়া হলো? এর সুবিধা কী? ধরা যাক, আমরা A4 সাইজের দুটি ডকুমেন্ট বা ছবি পাশাপাশি (দৈর্ঘ্যকে লম্বভাবে রেখে) বসিয়ে ফটোকপি করতে চাই। সে ক্ষেত্রে, একটা A3 সাইজের কাগজে তা খাপে খাপে মিলে যাবে। আবার, 2x2 বিন্যাসে চারটি A4 সাইজের কাগজ রাখলে তা সামগ্রিকভাবে A2 সাইজের হবে। অর্থাৎ কোনো ডকুমেন্ট বা ছবির মাপ ছোট-বড় করা, সমানভাবে ভাঁজ করা কিংবা একই মাপের দুটি ছবি পাশাপাশি সাজানো, এসব ক্ষেত্রে খুব সহজেই কাগজের মাপ বেছে নেওয়া যায়, যদি তা অ সিরিজের হয়। কোনো অপচয় ছাড়াই। এ কারণেই এই মাপগুলো এভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। একই মূলনীতি ব্যবহার করে কাগজ বা ডকুমেন্টের আরও বেশ কিছু সিরিজ প্রচলিত আছে (B সিরিজ, C সিরিজ ইত্যাদি) যেগুলোর মাপ অ সিরিজের থেকে ভিন্ন। কালার ল্যাবে বা স্টুডিওতে ছবি প্রিন্ট করার জন্য বিশেষায়িত একটি মাপ ইদানীং বহুল প্রচলিত, যার নাম জ সিরিজ (3R, 4R, 5R ইত্যাদি)। A সিরিজের মতো এই মাপগুলোর পেছনেও আছে বিভিন্ন ব্যবহারিক সুবিধা। তবে তা নিয়ে হয়তো আরেক দিন কথা হবে।
বলে রাখা ভালো, উল্লিখিত সিরিজগুলোর বাইরে লিগ্যাল (১৪ইঞ্চি x ৮.৫ইঞ্চি), লেটার (১১ইঞ্চি x ৮.৫ইঞ্চি)ইত্যাদি কিছু মাপ আছে, যেগুলোর বিশেষ কোনো বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক ভিত্তি নেই। কাগজ ব্যবহারের গোড়ার দিকে স্রেফ আকস্মিকভাবে এসব মাপ চালু হয়েছিল মূলত দাপ্তরিক ও আইনি কাজের জন্য এবং এখনো তা ক্ষেত্রবিশেষে চালু আছে। তবে কাগজের ওই সব পুরোনো অসুবিধাজনক মাপকে হটিয়ে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত ও কাঠামোবদ্ধ মাপগুলো।
লেখক: চিকিত্সক ও গবেষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল
*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত