গণিত জানে মৌমাছি

মৌমাছি অত্যন্ত পরিশ্রমী প্রাণী। বিশেষ করে কর্মী মৌমাছি। এক কেজি মধু সংগ্রহ করতে প্রতিটি কর্মী মৌমাছিকে প্রায় এক কোটি ফুলের কাছে যেতে হয়। এ সময় এগুলোকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ কিলোমিটার পথ। কথাগুলো নাসির উদ্দিন স্যার বলছিলেন তাইয়্যেবাকে। হঠাৎ মৌমাছি প্রসঙ্গে কথা বলার কারণ, তাইয়্যেবাকে মৌমাছিতে কামড় দিয়েছে। এখন সে মৌমাছির ওপর প্রচণ্ড খেপে আছে। রাগে লাল হয়ে সোহানা জিজ্ঞাসা করে, পৃথিবীতে মৌমাছির কী দরকার, স্যার? কাজের কাজ কিছু করে না, সুযোগ পেলেই শুধু কামড় দেয়।

স্যার বললেন, মৌমাছি না থাকলে মধু পেতে কোথায়?

মধু না হয় খেলাম না। না খেলে কী এমন ক্ষতি হয়?

স্যার বললেন, মধুর পুষ্টিগুণ তো কম নয়। ২০০ গ্রাম মধু আর দেড় লিটার দুধে প্রায় একই পুষ্টি থাকে। তা ছাড়া মৌমাছি যে অনেক বুদ্ধিমান, সে কথা জানো?

কী রকম বুদ্ধিমান? বুদ্ধি খাটিয়ে এগুলো কী করে?

ধরো, এগুলোর বাসার কথাই বলি। এগুলোর বাসায় অনেকগুলো ছোট ঘর বা প্রকোষ্ঠ দিয়ে তৈরি, খেয়াল করেছ?

হ্যাঁ, দেখেছি, গোল গোল দেখতে।

না, গোল নয়। ভালো করে খেয়াল করে দেখবে, সেগুলো ষড়ভুজাকার।

তা ষড়ভুজাকার হলেই কী? এখানে বুদ্ধির কী আছে?

প্রকৃতির অনেক কিছুই ষড়ভুজাকার। এর একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে। মৌমাছি সব সময় ষড়ভুজাকার বাসা তৈরি করে, যাতে বেশি মধু সঞ্চয় করতে পারে। এর সঙ্গে গণিতের সম্পর্ক আছে।

বলেন কী, স্যার? মৌমাছিও গণিত বোঝে?

ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই। মৌমাছির শরীরে একধরনের মোম তৈরি হয়। সেই মোম দিয়ে এগুলো বাসা তৈরি করে। তবে মোম তৈরি করতে এগুলোর অনেক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। তাই মৌমাছি চায় কম মোম ব্যবহার করে বেশি মধু সংগ্রহ করতে। এ জন্যই ষড়ভুজাকার বাসা তৈরি করে।

কিন্তু স্যার, ষড়ভুজাকার বাসায় যে মধু বেশি সঞ্চয় করতে পারে, এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মনে হয়, বৃত্তাকার বা বর্গাকার বাসা তৈরি করতে পারলে আরও বেশি মধু সঞ্চয় করতে পারত।

বৃত্তাকার বাসা তৈরি করলেও একটা সমস্যা থেকেই যায়। বৃত্তের চারপাশে কিছু জায়গা ফাঁকা থাকে। এই ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ করতে অনেক মোমের প্রয়োজন। এতে মধু দিয়ে ৯০ ভাগ ভরাট করা সম্ভব হয়। বাকি ১০ ভাগ কিন্তু ফাঁকাই থাকে।

মৌমাছি বৃত্তাকার বাসা তৈরি করলে বৃত্তের মাঝে এধরণের ফাঁকা যায়গা থেকে যাবে।

তাহলে বর্গাকার বাসা তৈরি করলে তো ওই ফাঁকা জায়গা থাকবে না। অথবা ত্রিভুজাকার বাসাও তো বানাতে পারে।

ত্রিভুজেও কোনো জায়গা ফাঁকা থাকে না, এ কথা ঠিক। কিন্তু ত্রিভুজের প্রতিটি কোণ ৬০ ডিগ্রি করে। যদি বর্গাকার বাসা তৈরি করে তাহলেও ৯০ ডিগ্রি কোণের বাসা তৈরি হয়। কিন্তু যদি বাসাটি ষড়ভুজাকার হয়, তাহলে ১২০ ডিগ্রি কোণের বাসা তৈরি হয়। বুঝতে পারছ ব্যাপারটা?

স্যার, বুঝতে পারছি। কিন্তু তারপরও একটু কেমন যেন লাগছে।

বুঝেছি! তুমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছ না যে ষড়ভুজাকার বাসায় বেশি মধু সঞ্চয় করা সম্ভব।

না স্যার, মানে…। আপনি যেহেতু বলছেন, তাহলে হবে নিশ্চয়ই।

আমি বলছি বলেই যে হবে, তা নয়। তোমাকে একটা গাণিতিক প্রমাণ দেখাই। এবার আর কোনো সন্দেহ থাকবে না।

গাণিতিক প্রমাণ থেকে বৃত্তকে প্রথমেই বাদ দিই। কারণ, এর মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকে। কেবল ত্রিভুজ, বর্গ ও ষড়ভুজে কোনো ফাঁকা জায়গা থাকে না। তাই এই তিন দিয়েই তোমাকে প্রমাণ দেখাই।

উদাহরণস্বরূপ ধরে নিই, ত্রিভুজ, বর্গ ও ষড়ভুজ প্রতিটির পরিসীমা ৩৬ সেন্টিমিটার। পরিসীমা বলতে প্রতি বাহুর যোগফলকে বোঝায়।

প্রথমে ত্রিভুজ দেখি। এর প্রতিটি বাহুই সমান। ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল বের করতে হলে উচ্চতা h নির্ণয় করতে হবে। তাহলে পিথাগোরাসের উপপাদ্য অনুসারে,

AD2+CD2= AC2

h2+62= 122

h2= 144-36

h2= 108

h=√108

h= 6√3 বা 10.329

আমরা জানি, ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল= 1/2 (ভূমিউচ্চতা)

=1/2 (12×6√3 )

= 6×6√3

= 62.3538 সেন্টিমিটার।

বর্গের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা অতি সহজ।

আমরা জানি, বর্গের ক্ষেত্রফল= (এক বাহুর দৈর্ঘ্য)= 92= 81

এবার ষড়ভুজাকারের ক্ষেত্রফল দেখা যাক। সহজে ক্ষেত্রফল বের করার জন্য ষড়ভুজের মধ্যে একটি ত্রিভুজ আঁকি। আগের মতো ত্রিভুজের উচ্চতা নির্ণয় করি।

সুতারং, h2+32= 62

বা, h2= 62-32

বা, h2= 36-9

বা, h2= 27

বা, h=

বা, h= 3

বা 5.19 সেন্টিমিটার।

মৌমাছি চিত্রের মতো ষড়ভুজাকার বাসা তৈরি করে

এই ষড়ভুজের মধ্যে এমন আরও ৬টি ত্রিভুজ আঁকা যাবে। তাই ষড়ভুজের ক্ষেত্রফল হবে,

= 1/2 (ভূমি×উচ্চতা) × 6

= 1/2 (6×3√3 ) × 6

= (6×3√3 ) × 3

= 93.530 বর্গ সেন্টিমিটার।

সুতরাং আমরা পেলাম:

ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল= 62.3538 বর্গ সেন্টিমিটার

বর্গের ক্ষেত্রফল= 81 বর্গ সেন্টিমিটার

ষড়ভুজের ক্ষেত্রফল= 93.530 বর্গ সেন্টিমিটার

এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছ, একটি মৌমাছি যদি একই পরিমাণ মোম দিয়ে একটি করে ত্রিভুজাকার, বর্গাকার ও ষড়ভুজাকার বাসা তৈরি করে তবে ষড়ভুজাকার বাসাতেই বেশি মধু ধরানো যাবে।

তাইয়্যেবা বলল, জি স্যার, বিশ্বাস না করে আর উপায় নেই। মৌমাছি আসলেই অনেক বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী প্রাণী। এখন ওগুলোর ওপর আমার আর কোনো রাগ নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: কোয়ান্টাম্যাগাজিন ডট ওআরজি