পাই ও টাউ দ্বন্দ্ব

আতা ও তোতা খুব ভালো বন্ধু। দুজনেই গণিতের ছাত্র। আলোচনা চলছে দুই বন্ধুতে। বিষয় পাই ও টাউ।

আতা বলল, পাই (π) কত রহস্যময় একটি সংখ্যা। চাইলেই কেউ কোনো দিন গুনে শেষ করতে পারবে না। আবার মুখস্থ করাটাও কিন্তু বেশ কঠিন। কারণ, দশমিকের পরের সংখ্যাগুলোর মধ্যে কোনো মিল নেই।

তোতা বলল, এ ধরনের বৈশিষ্ট্য কিন্তু টাউয়েরও আছে। পাইয়ের মতো টাউও (𝜏) রহস্যময়।

আতা: ধুর ব্যাটা, আমি কথা বলছি পাই নিয়ে। তুই কোথায় পাইয়ের সম্পর্কে আমাকে আরও কিছু বলবি। তা না করে টাউ নিয়ে লাফালাফি করছিস?

তোতা: টাউ নিয়ে কথা বলারও সময় এসে গেছে। তা ছাড়া টাউয়ের গুরুত্বও কিন্তু পাইয়ের তুলনায় কম নয়, বরং টাউয়ের মান পাইয়ের দ্বিগুণ।

আতা: এটা কোনো কথা হলো তোতা? সেই আর্কিমিডিস থেকে শুরু করে গণিত ও বিজ্ঞানের সব রথী–মহারথী কাজ করেছেন পাই নিয়ে। তাঁদের মধ্যে নিউটন, রামানুজন, রাদারফোর্ড, অয়লারের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা রয়েছেন। তুই বলতে চাস তাঁরা ভুল ছিলেন?

তোতা: পাই ভুল বা পাই নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা ভুল, সে কথা আমি বলছি না। আমি শুধু বলছি, পাইয়ের জায়গায় টাউ ব্যবহার করলে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান আরও সহজে ব্যাখ্যা করা যায়।

আতা: কীভাবে? গণিতে টাউয়ের জায়গাটা কোথায়? পাই কতটা সহজে পাওয়া যায় দেখ। একটি বৃত্তের পরিধিকে ওই বৃত্তের ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে পাই (π) পাওয়া যায়। যেমন: বৃত্তের পরিধি 2πr এবং বৃত্তের ব্যাস 2r। অনুপাত= 2πr/2r= π।

তোতা: ধীরে বন্ধু ধীরে। বৃত্তের সংজ্ঞা অনুসারে, একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে সর্বদা সমান দূরত্ব বজায় রেখে যে বক্ররেখা ঘুরে আসে, তা–ই বৃত্ত। এখানে নির্দিষ্ট বিন্দু মানে বৃত্তের কেন্দ্র। আর কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্ব বজায় রেখে যে রেখাটি ঘুরে আসে, সেটা ব্যাসার্ধ। আর ব্যাসার্ধের দ্বিগুণ হল বৃত্তের ব্যাস। তাহলে দেখতেই পাচ্ছিস, বৃত্তের সংজ্ঞায় ব্যাসার্ধ গুরুত্ব পাচ্ছে। আমি খামোখা বৃত্তের পরিধিকে ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ না করে ব্যাস দিয়ে ভাগ করতে যাব কেন? ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলেই তো হয়। যেমন: বৃত্তের পরিধি 2πr এবং বৃত্তের ব্যাসার্ধ r। তাহলে অনুপাত= 2πr/r= 2π = 2𝜏 (টাউ)।

আতা: মানছি যে বৃত্তের পরিধিকে ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলেও একটি ধ্রুবক (টাউ) পাওয়া যায়। কিন্তু বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করলে? পাই ব্যবহার করলে ক্ষেত্রফল= πr2। এবার টাউ ব্যবহার করে দেখ, ক্ষেত্রফল= 𝜏/2.r2। কী তোতা? কোন সূত্রটা দেখতে সুন্দর লাগছে?

তোতা: হ্যাঁ, পাই ব্যবহার করলে ক্ষেত্রফলেরটা সুন্দর লাগছে ঠিক, কিন্তু এমন তো নয় যে 1/2 আকারে কোনো সমীকরণ হয় না। ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল= 1/2 ×ভূমি×উচ্চতা। শুধু গণিতে কেন? পদার্থবিজ্ঞানে খুঁজে দেখ। পড়ন্ত বস্তুর সূত্রে 1/2.gt2, গতিশীল বস্তুর গতিশক্তির সূত্রে 1/2.mv2। এই সমীকরণগুলো দেখতে কি সুন্দর নয়?

আতা: তুই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিস। আমি বলিনি এগুলো সুন্দর নয়, কিন্তু তোর টাউয়ের চেয়ে পাইয়ের ক্ষেত্রফলের সূত্রটা বেশি সুন্দর।

তোতা: আচ্ছা ঠিক আছে। বৃত্তের পরিধি নির্ণয় কর। পাই ব্যবহার করলে পরিধি=2πr , কিন্তু টাউ ব্যবহার করলে পরিধি= 𝜏r। এবার মনে হচ্ছে না টাউ ব্যবহার করা সুবিধাজনক? আরও উদাহরণ দেখাই। একটি বৃত্ত ৩৬০ ডিগ্রি। এ ক্ষেত্রে বৃত্তীয় পরিমাপ হবে 2π রেডিয়ান। যদি ১৮০ ডিগ্রি হয়, তাহলে π রেডিয়ান এবং ৯০ ডিগ্রির জন্য রেডিয়ান π/2। এই পরিমাপগুলোতেই টাউ ব্যবহার কর। দেখবি একটা মিল রয়েছে। যেমন ৩৬০ ডিগ্রির জন্য 𝜏 , ১৮০ ডিগ্রির জন্য 𝜏/2 ও ৯০ ডিগ্রির জন্য 𝜏/4। তা ছাড়া একটি পূর্ণাজ্ঞ বৃত্তের পরিমাপ বোঝাতে শুধু 𝜏 ব্যবহার করলেই হয়, 2π বসাতে হবে না।

আতা: ধীরে বন্ধু! একক বৃত্তের ব্যাপারে জানিস নিশ্চয়। যে বৃত্তের ব্যসার্ধ ১ একক, তাকে একক বৃত্ত বলে। এই একক বৃত্তের ক্ষেত্রফল= π। এর অর্ধেক π/2 , চার ভাগের এক ভাগ হলে π/4 । এবার একক বৃত্তের ক্ষেত্রফলে টাউ বসালে মানগুলো হয় যথাক্রমে 𝜏/2, 𝜏/4 ও 𝜏/8 । এবার বল তো, ক্ষেত্রফল হিসাবে π, নাকি 𝜏/2 সুবিধাজনক?

তোতা: ঠিক আছে। এ ক্ষেত্রে পাই সুবিধাজনক মানলাম। কিন্তু সমীকরণের বেলায়? গণিতের সবচেয়ে সুন্দর সমীকরণ ধরা হয় অয়লারের eiθ = cosθ+ i sinθ সমীকরণকে।

এই সমীকরণকে π দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে পাওয়া যায়,

e= cosπ+ i sinπ

e= -1+ i (0)

e= -1

এবার পাইয়ের পরিবর্তে টাউ ব্যবহার করে দেখা যাক।

ei𝜏= cos𝜏+ i sin𝜏

ei𝜏= 1+ i (0)

ei𝜏= 1

এটা দেখতে আগের তুলনায় বেশি সুন্দর। এ ছাড়া কচির সমাকলনীয় সূত্র, রিম্যান জিটা ফাংশন সূত্র, গাউসিয়ান সূত্রসহ অনেক সূত্রে 2π ব্যবহার করা হয়েছে। 2π–এর পরিবর্তে 𝜏 ব্যবহার করলে সূত্রগুলো আরও সরল হয়ে যায়। এবার তো মেনে নিবি, পাইয়ের চেয়ে টাউ ব্যবহার করা যৌক্তিক।

আতা: না হে বন্ধু! এমন অনেক ক্ষেত্রই আছে, যেখানে টাউ ব্যবহার করলে সমীকরণ আরও জটিল হয়ে যাবে। যেমন n সংখ্যক বাহুবিশিষ্ট বহুভুজের কোণের পরিমাপের সমষ্টি= (n-2)π। কিন্তু টাউ ব্যবহার করলে দাঁড়ায়, সমষ্টি= (n-2)π/2। আরও ধর, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি। এবার পাই ও টাউ মাধ্যমে প্রকাশ করলে পাওয়া যাবে যথাক্রমে π ও 𝜏/2। কোনটা বেশি সুন্দর?

তোতা: আরে সমীকরণ, সূত্র বাদ দে। ধর, তুই পাই দিবস পালন করবি আর আমি টাউ দিবস। সে ক্ষেত্রে তুই মাত্র ১৪ দিন উৎসব করতে পারবি। অর্থাৎ, মার্চের ১ তারিখ (পাইয়ের মান দশমিকের পরে এক ঘর ধরলে ৩.১) থেকে মার্চের ১৪ তারিখ (৩.১৪ অনুসারে) পর্যন্ত। কিন্তু আমি জুনের ২ তারিখ (৬.২ অনুসারে) থেকে জুনের ২৮ তারিখ (৬.২৮) পর্যন্ত উৎসব করতে পারি। এখানেও আমি তোর থেকে এগিয়ে।

আতা: এটা কোনো যুক্তি হলো না। টাউয়ের পক্ষে তোর সব যুক্তি দেখানো শেষ। এখন উল্টাপাল্টা বকছিস। তা ছাড়া টাউ ব্যবহারের জন্য যে কারণগুলো দেখালি, সেগুলো হালকা মানের। এর চেয়ে পাই অনেক বেশি শক্তিশালী।

তোতা: আর শক্তিশালী প্রমাণ করা লাগবে না। ক্ষুধায় পেটের অবস্থা খারাপ। চল আগে কিছু খেয়ে নিই।

দুই বন্ধুর ঝগড়া বা আলোচনা এখানেই শেষ। কেউ কিন্তু কারও চেয়ে কম যায় না। তবে এ কথা সত্যি যে গাউসিয়ান অবিচ্ছেদের মতো অনেক সূত্রে পাই খুব শক্তিশালী জায়গা দখল করে আছে। তাই পাই পরিবর্তন করলে গণিত ও বিজ্ঞানের আমূল পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। মূলত ২০০১ সালে বব প্যালেইস নামের একজন গণিতবিদ পাইয়ের পরিবর্তে টাউ ব্যবহারের ধারণা দেন। তিনি টাউয়ের একটি প্রতীকও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতীকটি অপ্রচলিত ও অদ্ভুত। ২০১০ সালে মাইকেল হার্টল টাউয়ের বর্তমান প্রতীকটি প্রস্তাব করেন। তিনিই ২৬ জুন টাউ দিবস পালনের ঘোষণা দেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: টাউ ডে ডটকম, ট্রিলাইট ডটকম ও উইকিপিডিয়া