বিরল সংখ্যা কেন বিরল

দুই পণ্ডিতের ঝগড়া লেগেছে। চায়ের দোকানে। গণিতের পণ্ডিত বলে কথা। সাধারণ মানুষ তাঁদের ঝগড়ার মাথামুণ্ডু বোঝে না। কোথায় তাঁরা রাজনীতির গরম খবর নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলবেন, তার মধ্যে বেরসিক দুই পণ্ডিতের ঝগড়া। তাঁদের আসরটা ঠিক জমছে না। একে একে লোকজন পালায় চায়ের দোকান ছেড়ে। পড়ে থাকে শুধু দোকানদার।

ঝগড়া জমে উঠছে। সংখ্যাতত্ত্বের নানা ক্যাঁচাল। স্পেশাল নাম্বার, প্রাইম নাম্বার কত-কী! কেউ হার মানতে রাজি নন। হঠাৎ কে যেন বলে ওঠে, ‘ওহে পণ্ডিতগণ, সংখ্যার রামায়ণ মহাভারত সব তো উদ্ধার করলেন, বলুন তো প্রথম রেয়ার নাম্বার কোনটা?’

পণ্ডিত দুজন তো থ! চোখ তুলে দেখেন, পাগল চেহারার অচেনা এক লোক কখন এসে দাঁড়িয়েছেন দোকানের এক কোণে। পাগলাটে লোকটা লালমোহন গাঙ্গুলির মতো তালি বাজিয়ে বলে উঠলেন, ‘পারলেন না তো! জানতাম ও মুরোদ আপনাদের নেই!’

চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে দুই পণ্ডিতের। বলে কী পাগলা?

‘প্রথম রেয়ার মানে বিরল সংখ্যাটা হলো গিয়ে ৬৫...’ বলে দুষ্টুমিভরা হাসিমুখ করে তাকালেন দুই পণ্ডিতের দিকে। তারপর বললেন, ‘৬৫-এর কী এমন গুণ বুঝলেন না তো! ৬৫-এর অঙ্ক দুটো উল্টে ফেলুন। ৬ আর ৫-এর জায়গা বদল আরকি। তাহলে সেটা হবে ৫৬, তাই তো! এবার মূল সংখ্যার সঙ্গে যোগ করুন একে। তাহলে দাঁড়ায় ৬৫ + ৫৬ = ১২১ । (১১) = ১২১, অর্থাৎ যোগফলটা পূর্ণ বর্গ সংখ্যা।

কোনো একাধিক অঙ্কের সংখ্যাকে জায়গা বদল করাতে হবে আগে। তারপর সংখ্যা দুটোকে যোগ দিতে হবে। যোগফল যদি পূর্ণ বর্গ সংখ্যা হয়, তাহলে বুঝবেন সেটা বিরল সংখ্যা। তবে এখানেই শর্তের শেষ নয়। বিরল হতে হলে পূরণ করতে হবে আরেকটা শর্তও। সংখ্যা দুটোকে বিয়োগ দিন। ৬৫ − ৫৬ = ৯। বিয়োগফলটাও পূর্ণ বর্গ সংখ্যা তাই না, ৩ = ৯।

কিন্তু ৬৫ বিরল কেন? কারণ, পরের বিরল সংখ্যাটা পেতে হলে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। সংখ্যাজগতের দ্বিতীয় বিরল সংখ্যাটা হলো ৬২১৭৭০। এটা শর্ত মানে কি না দেখা যাক—

৬২১৭৭০ + ৭৭১২৬ = (৮৩৬)

৬২১৭৭০−৭৭১২৬ = (৭৩৮)... ”

মনে মনে কী যেন হিসাব কষে একজন পণ্ডিত বলে উঠলেন, ‘ঠিক বললেন না জনাব, বিরল সংখ্যা আরও আছে।’ লোকটার চোখে বিজয়ীর উল্লাস, ‘২৪২ বিরল সংখ্যা। দুটো শর্তই পূরণ করে এই সংখ্যাটা।

২৪২ + ২৪২ = (২২)

২৪২ − ২৪২ = ০...’

‘শর্তমতে ২৪২ বিরল সংখ্যাই বটে।’ বললেন পাগলমতো লোকটা, ‘এমন সংখ্যা আরও আছে ২০৪০২, ২৪৬৪২, ২০৪০৬০৪০২, ২০০৪০০৬০০৮০০৬০০৪০০২ ইত্যাদি। গুনে শেষ করতে পারবেন না। তাহলে আর বিরল কথাটার ইজ্জত কোথায় রইল, বলুন?

এই ধরনের সংখ্যাগুলোকে বলে পেলিনড্রোমিক সংখ্যা। এদের অঙ্কগুলো উল্টো দিক থেকে সাজালে মূল সংখ্যাটাই ফিরে আসে। তাই বিরল সংখ্যার তালিকায় ঠাঁই নেই এদের।’ লোকটা থামলেন কিছুক্ষণ। দম নিলেন লম্বা করে। তারপর বললেন, ‘১ থেকে ১০২০-এর মধ্যে কতগুলো বিরল সংখ্যা আছে জানেন, মাত্র ৮৪টা!’

‘বুঝলাম, আসলেই বিরল,’ বললেন দ্বিতীয় পণ্ডিত। ‘কিন্তু এগুলো আবিষ্কার করলেন কে?’ বলেন প্রথম পণ্ডিত। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন পাগলমতো লোকটার দিকে।

‘এক ভারতীয় গণিতবিদ-শ্যামসুন্দরগুপ্ত,’ জবাবে বললেন লোকটা। তারপর পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ধরিয়ে দিলেন দুই পণ্ডিতের দিকে। ৮৪টা বিরল সংখ্যার তালিকা রয়েছে তাতে। ৬৫, ৬২১৭৭০, ২৮১০৮৯০৮২, ২৮১০৮৯০৮২, ২০২২৬৫২২০, ২০৪২৮৩২০০২, ৮৬৮৫৯১০৮৪৭৫৭, ৮৭২৫৪৬৯৭৪১৭৮, ৮৭২৫৬৮৭৫৪১৭৮, ৬৯৭৯৩০২৯৫১৮৮৫, ...ইত্যাদি।

কাগজটা দিয়েই চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লেন লোকটা। হনহন করে দ্রুতপায়ে চলে গেলেন গাঁয়ের পথ ছেড়ে। একসময় তাঁর লম্বা একহারা দেহটা মিলিয়ে গেল মোড়ের ওপারে। দুই পণ্ডিতের চোখে আর অবজ্ঞা নেই, রয়েছে বিস্ময়। অজানাকে জানার বিস্ময়, সঙ্গে পাগলাটে লোকটার নাম-পরিচয় না জানার বিস্ময়ও।

সূত্র: নাম্বার অ্যাপ্লেনটি, শ্যামসুন্দরগুপ্ত ডট কম

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত