ক্যাপিলারি অ্যাকশন!
ধরা যাক, আপনি খেতে বসেছেন। পাশেই পানির গ্লাস রাখা। হঠাৎ হাতের ধাক্কায় গ্লাস উল্টে টেবিলে পানি পড়ে গেল। আপনি তাড়াহুড়ো করে আপনার পকেটে থাকা টিস্যু পেপার বের করে পানির ওপর চেপে ধরলেন। মুহূর্তেই টিস্যু পেপার পানি শুষে নিল। কখনো ভেবে দেখেছেন, এই ব্যাপারটা আসলে কেন ঘটে?
আমাদের আশপাশে প্রতিদিন এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যেগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে চমকপ্রদ বিজ্ঞান। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা বলেই হয়তো ব্যাপারগুলো আমরা খুব বেশি তলিয়ে দেখি না। তবে পেছনের বিজ্ঞানটা জানতে পারলে সেটা ব্যবহার করে কিন্তু বেশ কিছু মজার পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব।
টিস্যু পেপারের তন্তুগুলোর মাঝে কিন্তু বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে। টিস্যু পেপার পানিতে রাখা হলে পানি এই ফাঁকা জায়গাগুলো দখল করে। আপনি যদি টিস্যু পেপার পানির ওপর চেপে না ধরে লম্বালম্বিও ধরে থাকতেন, পানি কিন্তু টিস্যু পেপারের গা বেয়ে ওপরে উঠে আসত। এর কারণ ক্যাপিলারি অ্যাকশন বা কৈশিক ক্রিয়া। পানির অণুগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে। একে কোহিসিভ ফোর্স বা সংসক্তি বল বলা হয়। আবার পানির অণুগুলো টিস্যু পেপারের সেলুলোজ অণুগুলোকেও আকর্ষণ করে। পানির অণু ও সেলুলোজ—দুটোই পোলার বলে একটি অণুর ধনাত্মক প্রান্ত অপর অণুর ঋণাত্মক প্রান্তকে আকর্ষণ করে। উল্টোটাও ঘটে। এই আকর্ষণ বলকে অ্যাডহিসিভ ফোর্স বা আসঞ্জন বল বলা হয়।
পানির অণুগুলোর নিজেদের মধ্যের সংসক্তি বলের চেয়ে পানি ও টিস্যুর অণুর মধ্যকার আসঞ্জন বল শক্তিশালী হলে পানির অণুগুলো টিস্যু পেপারের অত্যন্ত সরু তন্তুর মধ্য দিয়ে ওপরে উঠে আসে। পানির অণুগুলো এখানে অভিকর্ষের বিরুদ্ধে কাজ করে। কারণ, আসঞ্জন বল ও পানির পৃষ্ঠটান। টিস্যু পেপারের তন্তুগুলো সরু না হয়ে অনেক মোটা হলে অবশ্য পানি টিস্যু পেপার বেয়ে খুব বেশি ওপরে উঠে আসতে পারত না। সে ক্ষেত্রে নলের গায়ের কাছাকাছি, দুই পাশে পানি একটু ওপরে উঠে থাকত, নলের মাঝে তৈরি হতো মিনিস্কাস। সরু নল, জালিকা বা তন্তুতে ঘটা এই ব্যাপারটিকেই বলা হয় ক্যাপিলারি অ্যাকশন। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাপারটিকে আরও মজার উপায়ে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখা যায়।
যা যা প্রয়োজন
সাতটি ওয়ান টাইম গ্লাস; লাল, হলুদ ও নীল রঙের খাওয়ার রং (ফুড কালার); পেপার টাওয়েল বা টিস্যু পেপার; পানি ও ড্রপার
১। প্রথমে একটি পেপার টাওয়েল নিয়ে সেটিকে ২ নং ছবির মতো করে ভাঁজ করতে হবে। মোট ছয়টি টাওয়েল এভাবে প্রস্তুত করতে হবে।
২। সাতটি ওয়ান টাইম গ্লাসের মধ্যে বাম দিকে থেকে শুরু করে প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম ও সপ্তম গ্লাসটি পানি দিয়ে ভর্তি করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম ও সপ্তম গ্লাসে পানির পরিমাণ বাকি দুটি গ্লাস থেকে কিছুটা কম হবে।
৩। এখন প্রথম ও সপ্তম গ্লাসে লাল রং, তৃতীয় গ্লাসে হলুদ এবং পঞ্চম গ্লাসে নীল রং ড্রপার দিয়ে মেশাতে হবে। ১৫ ফোঁটা করে রং মেশালেই হবে (ছবি ৪)।
৪। এবার ভাঁজ করে রাখা ছয়টি পেপার টাওয়েলকে ৫ নং ছবির মতো করে গ্লাসগুলোর মাঝে বসিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, টাওয়েলগুলো যাতে একেবারে গ্লাসের নিচের প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছায়।
৫। গ্লাসগুলোকে এভাবে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। ছয় ঘণ্টা পর দুটি করে গ্লাসের রং একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে মাঝখানের খালি গ্লাসে ৬ নং ছবির মতো চমত্কার রং তৈরি হবে। বাম দিক থেকে লাল ও হলুদ মিলে মাঝখানের গ্লাসে কমলা রং তৈরি করবে। মাঝখানে হলুদ ও নীল মিলে সবুজ রং তৈরি করবে। ডান দিকে নীল ও লাল মিলে বেগুনি রং তৈরি করবে।
ক্যাপিলারি অ্যাকশনের কারণে রঙিন পানি অভিকর্ষের বিরুদ্ধে পেপার টাওয়েল বেয়ে উঠে পাশের গ্লাসে এসে জমেছে এবং অপর পাশের গ্লাস থেকে আসা রঙিন পানির সঙ্গে মিশে নতুন সব রং তৈরি করেছে।
ক্যাপিলারি অ্যাকশনের ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু আরও মজার সব পরীক্ষা করা যায়। আমরা ফুল ব্যবহার করে আরও একটা পরীক্ষা করে দেখি—
যা যা প্রয়োজন
লম্বা ডাঁটাসহ সাদা গোলাপ ফুল তিনটি, ওয়ান টাইম গ্লাস তিনটি, লাল, নীল ও সবুজ, খাওয়ার রং, ড্রপার, চিনি, ভিনেগার ও পানি
১। সাদা গোলাপ তিনটির পাতাগুলো ফেলে দিয়ে শুধু ডাঁটা রাখতে হবে। ডাঁটার নিচের অংশটুকু সমান করে কেটে নিতে হবে।
২। তিনটি ওয়ান টাইম গ্লাস পানি দিয়ে ভর্তি করে লাল, নীল ও সবুজ রং ড্রপার দিয়ে মেশাতে হবে। এরপর গ্লাস তিনটিতে এক চামচ করে চিনি এবং কয়েক ফোঁটা করে ভিনেগার মিশিয়ে দিতে হবে (ছবি ৮ ও ৯)।
৩। ফুল তিনটিকে গ্লাস তিনটিতে রেখে দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি অপেক্ষা করতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর দেখা যাবে, সাদা ফুল তিনটি নিজ নিজ গ্লাসের রঙে রঙিন হয়ে গিয়েছে!
এই ব্যাপারটার পেছনেও কিন্তু ক্যাপিলারি অ্যাকশনের ভূমিকা আছে। গোলাপের ডাঁটার ভেতরে জাইলেম নামে এক ধরনের খুব সরু ভাস্কুলার টিস্যু আছে, যেগুলো এই পানিকে পরিবহন করে গোলাপের পাপড়িতে নিয়ে যায়। এই টিস্যুর কোষ এবং পানির মধ্যে যে আসঞ্জন বল কাজ করে, সেটি রঙিন পানিকে ডাঁটা বেয়ে গোলাপের পাতায় পৌঁছাতে সাহায্য করে। সাদা গোলাপ না পেলে সাদা রঙের অন্য কোনো ফুল (যেমন চন্দ্রমল্লিকা) দিয়েও পরীক্ষাটি করা যাবে।
নিজে করুন
দ্বিতীয় পরীক্ষাটা নিয়ে চাইলে আরও মজার কিছু করা যায়। একটা সাদা গোলাপ নিয়ে সেটার ডাঁটার নিচের অংশকে সমান চার ভাগে ভাগ করে অল্প একটু ওপর পর্যন্ত কেটে নিন। এবার একেকটা কাটা অংশকে একেক রঙের পানিতে রেখে ডুবিয়ে রাখুন। রঙিন পানির গ্লাসগুলোকে এ জন্য পাশাপাশি রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। তারপর দেখুন গোলাপটির রং কী হয়!
লেখকদ্বয়: সদস্য, একাডেমিক টিম, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি (এসপিএসবি)
ছবি: খালেদ সরকার