২০২১-এ বিজ্ঞানের সেরা ১০

২০২১ সালকে পেছনে ফেলে আমরা ২০২২ সালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। একটা বছর পেছনে ফেলে নতুন একটা বছরকে স্বাগত জানানোর অর্থ এই নয় যে, পুরনো বছরের সবকিছু আমরা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আসব। বছর শেষে নতুন বছর আসছে, কিন্তু মানবজাতির অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় কিন্তু কোনো ছেদ নেই, নেই কোনো প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে বিজ্ঞানে আজকের আবিষ্কার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এর কিছু কিছু ফল যে আমরা ভোগ করব না, সেটাও না। তবে যেকোন কাঁচা আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সময়ের সঙ্গে আরও বেশি পরিপক্ক হয়। বিজ্ঞানের চলমান অগ্রগতির সাথে হাঁটতে হলে সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সম্পর্কে জানা জরুরি। এগুলো টেক্সট বইয়ে আসতেও বেশ খানিকটা সময় লাগে। ২০২১ সালে নির্বাচনের ভিত্তিতে সায়েন্স জার্নাল একটি আবিষ্কারকে চ্যাম্পিয়ন বা যুগান্তকারী এবং ৯টি আবিষ্কারকে রানার্স-আপ ঘোষণা করেছে। সারা পৃথিবীর অসংখ্য অংশপগ্রহণকারীর ভোটের ভিত্তিতে এই ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া আবিষ্কারে ভোট পড়েছে মোট ৩৯ শতাংশ, প্রথম রানার-আপে ৩৪ শতাংশ আর দ্বিতীয় রানার আপে ২৭ শতাংশ।

চ্যাম্পিয়ন: প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন

জীববিজ্ঞানের এমন এক আবিষ্কার, যা এই শাখার বেশ কয়েকটি সেক্টরে খুব দ্রুত বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এরকম একটা সফলতাকে বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী আবিষ্কারের মর্যাদা দেয়া হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। নামকরা জার্নাল সায়েন্স ২০২১ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী আবিষ্কারের মর্যাদা দিয়েছে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠনের সহজ ও নির্ভুল উপায় বাতলে দেয়ার প্রোগ্রাম আলফাফোল্ড ও রোজ-টিটিএফোল্ডকে।

আলফাফোল্ড সফটওয়্যার প্রোগ্রামটি তৈরি করেছে লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপমাইন্ড টেকনোলোজিস। অন্যদিকে রোজ-টিটিএফোল্ড-এর পেছনে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের এক দল গবেষক।

রানার-আপ ১: প্রাচীন ডিএনএ

গুহার মেঝের মাটিতে পাওয়া ডিএনএতে লেখা আছে প্রাচীন, বিলুপ্ত প্রাণী ও নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির কিছু অজানা অধ্যায়। স্পেনের এসটাটুয়াস গুহায় পাওয়া ডিএনএ থেকে ৮০ থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার বছর আগে বসবাসকারী মানুষের সম্পর্কে জানা গেছে। জর্জিয়ার একটি গুহা থেকে ২৫ হাজার বছরের পুরোনো একটি মাটি থেকে নিষ্কাশিত ডিএনএতে নিয়ান্ডারথাল-এর অজানা এক শাখা সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক ভালুকের সাথে ১২ হাজার বছর পুরনো কৃষ্ণ-ভালুকের ডিএনএ তুলনা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, শেষ তুষারযুগের পরে গুহায় বসবাসকারী ভালুকগুলো উত্তরে আলাস্কার দিকে পরিযান করেছে।

রানার-আপ ২: মানবদেহে ক্রিসপার

মানবদেহের অভ্যন্তরে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিন এডিটিংয়ের সফলতা এসেছে এ বছরেই। চিকিৎসাশাস্ত্রে ক্রিসপার প্রযুক্তির প্রথম সফলতা দেখা যায় ২০২০ সালে। তবে সেটা ছিল রক্তের স্টেম সেলকে রোগীর দেহের বাইরে এনে ল্যাবে করা এডিটিং। ২০২১ সালে বিজ্ঞানীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সরাসরি রোগীর দেহেই জিন এডিটিংয়ের কাজটা সেরে ফেলেছেন। এভাবে তাঁরা রোগীর যকৃতে বিষাক্ত উপাদানের পরিমাণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি চোখে জেনেটিক ডিজিজে আক্রান্ত একজনের দৃষ্টিশক্তিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।

রানার-আপ ৩: মিউয়ন

ইলেকট্রনের অস্থিতিশীল ওজনদার আত্মীয়। মিউয়নের চুম্বকত্বের তত্ত্বীয় গণনা ও পরীক্ষার ফলাফলে অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। এ ধরনের অসামঞ্জস্যতার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। এই সীমার বাইরে যাওয়ার অর্থ হল, পার্টিকেল ফিজিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতি কি তবে পদার্থবিদিদেরকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরে নতুন ফিজিক্স খুঁজতে বাধ্য করবে? সেটা জানতে সময় লাগবে।

রানার-আপ ৪: কোভিড পিল

গত দুইটা বছর কোভিড-১৯ বিশ্বকে তার জাত চিনিয়ে দিয়ে গেছে। এই মহামারীতে দিশেহারা সারা বিশ্ব। ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। মাঝে এর প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও আবার বেড়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ভাইরাসটি জানান দিচ্ছে, আমি সহজে ছেড়ে যাচ্ছি না।

তবে গবেষকরাও কম যান না। তারা এমন এক পিল উদ্ভাবন করেছেন, যা সংক্রমণের শুরুতে গ্রহণ করলে খারাপ অবস্থা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এটা যদি সত্যি হয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ের বিচারে এটাকে বেশ ভালো খবর বলতে হবে।

রানার-আপ ৫: ক্রমবর্ধমান ভ্রুণ কোষ

আমরা কখনো কি চিন্তা করে দেখেছি যে মাতৃগর্ভে এক তাল কোষ কীভাবে বিভিন্ন কাজে পারদর্শী টিস্যুতে ভাগ হয়ে যায়? প্রথমে আমরা কী ছিলাম? দুটি কোষের মিলন থেকে সৃষ্ট আরও কিছু কোষ। এরপর আরও কিছু এবং পরে আরও কিছু। মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে এই যে কোষের বৃদ্ধি এবং অতঃপর আস্ত এক মানুষ যে কিনা এই লেখাটা লিখছি বা অনেকে পড়ছি। মানুষের ভ্রুণ কোষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনেক বাধানিষেধ আছে। আগে শুধু ইঁদুর ও অন্য প্রাণীর ভ্রুণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু সবকিছু তো আর মানুষের সাথে মিল পাওয়া যায় না। তাই সেসব ফলাফল কখনও মানবদেহের জন্য কনক্লুসিভ হতে পারে না। এবার গবেষকরা সরাসরি ডোনেট করা ভ্রুণ কোষ নিয়ে কাজ করেছেন এবং বিশেষ বিশেষ টিস্যুতে ভাগ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সূত্র পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন মানুষের ক্রমবর্ধমান ভ্রুণ কোষ প্রায় বলতে গেলে সবকিছুতেই ইদুরের ভ্রুণ কোষের সাথে মিল আছে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তাও না।

রানার-আপ ৬: ফিউশন এনার্জি

ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি বা এনআইএফ লক্ষ্যবস্তু বরাবর ১.৯ মেগাজুল শক্তিসম্পন্ন লেজার রশ্মি ছুঁড়ে ১.৩ মেগাজুলের বেশি পরিমাণ শক্তি উদ্ধার করতে পেরেছে। নিউক্লিয়ার ফিউশন রি-অ্যাকশন ঘটানোর লক্ষ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি হাইড্রোজেন জ্বালানীকে উত্তপ্ত করতে এনআইএফ ডিভাইস ব্যবহার করে থাকে। এটাকে ডিভাইস বলা হলেও এর সাইজ তিনটি ফুটবল মাঠের সমান।

রানার-আপ ৭: মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহারে সফলতা

গবেষণাগারে তৈরি অ্যান্টিবডি বা মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহারে সফলতা এসেছে এ বছর। এর আগে কিছু ক্যান্সার ও অটোইমিউন রোগে এর সফল প্রয়োগ করা হলেও সংক্রামক রোগে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। কোভিড-১৯ ছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা, জিকা ও সাইটোমেগালো ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যও এটিকে প্রস্তুত করা হচ্ছে।

রানার-আপ ৮: মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ গঠন

প্রথমবারের মতো মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ গঠন আমাদের সামনে তুলে ধরেছে নাসার ইনসাইট ল্যান্ডার। এতে থাকা সিসমোমিটার মঙ্গলের কেন্দ্রস্থলে গলিত অবস্থার বিষয়ে একটি ধারণা দিয়েছে। ইনসাইট যতদিন থাকবে, সে সময়ে মঙ্গলে ঘটা অনেকগুলো ভূমিকম্প (মার্সকোয়েক) থেকে সিসমোমিটার মঙ্গলের ভূত্বক, ম্যান্টল ও কেন্দ্রস্থল সম্পর্কে এই তথ্য জানায়। এ থেকে মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে আমাদের আগের জানা অনেক কিছুই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

রানার-আপ ৯: পিটিএসডির চিকিৎসা

ভয়ঙ্কর কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া অনেকেই পরবর্তীতে মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আনন্দ পাওয়ার মতো বিষয়ে আনন্দ না পাওয়া, ঘুমাতে না পারা বা কোন কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, বাজে অভিজ্ঞতার ফ্ল্যাশব্যাক, নিজের আশপাশ নিয়ে অতি সতর্কতা ও ভয় এবং ঘটনাস্থল ও এর সাথে সম্পর্কিত সবকিছু এড়িয়ে চলার মতো কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এগুলোর সম্মিলিত অবস্থাই হচ্ছে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস সিনড্রোম। গবেষকরা দেখেছেন, সাইকোথেরাপির পাশাপাশি ড্রাগস এক্সটেসির ব্যবহার পিটিএসডির চিকিৎসায় এক মাইলফলক হতে পারে।

এছাড়াও নাসার পার্কার সোলার প্রোব সম্প্রতি সূর্যের সর্বোচ্চ আবহমণ্ডলকে স্পর্শ করেছে। একটি নক্ষত্র কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার উদ্দেশ্যে নাসা এই মিশনটি পরিচালনা করছে।

লেখক: চিকিৎসক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল