সুপারম্যানের অফিসে কেন হানা দিয়েছিল এফবিআই
১৯৪৫ সাল। এপ্রিল মাসের এক পড়ন্ত বিকেলে হুট করেই বিখ্যাত ডিসি কমিকসের নিউইয়র্ক কার্যালয়ে হানা দেয় একদল এফবিআই এজেন্ট। ভদ্র অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ সুরে তারা দেখা করতে চায় প্রকাশক হ্যারি ডোনেনফেল্ডের সঙ্গে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাটির সদস্যদের যত আপত্তি ছিল প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপারহিরো চরিত্র সুপারম্যানের সদ্য প্রকাশিত সংখ্যা নিয়ে। অনতিবিলম্বে এটিকে বাজার থেকে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা নিতে ডোনেনফেল্ডকে চাপ দিতে থাকে তারা। হতভম্ব প্রকাশক তৎক্ষণাৎ টেলিফোন করেন সেই সংখ্যার স্টোরিলাইনের সম্পাদক জ্যাক শিফকে। সব শুনে আকাশ থেকে পড়লেন তিনিও। এফবিআই সদস্যদের দিকে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘কেন? সুপারম্যান কি কোন রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করেছে?’
সদ্য প্রকাশিত ‘সায়েন্স অ্যান্ড সুপারম্যান’ সংখ্যায় ক্রিপ্টোনিয়ান সুপারহিরোকে পার্টিক্যাল অ্যাক্সিলারেটর যন্ত্রে কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অংশ নিতে দেখা যায়। যেখানে ঘন্টায় ১০০ মিলিয়ন মাইল বেগে চলমান তিন মিলিয়ন ভোল্ট শক্তির একদল ইলেকট্রন সজোরে আঘাত হানে এই এলিয়েনকে। এক্সপেরিমেন্টটির বিস্তারিত বিবরণ কাকতালীয়ভাবে মিলে গিয়েছিল সত্যিকারের কণাত্বরক যন্ত্রের সঙ্গে। আর তাতেই বাধে বিপত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় সামান্যতম ঝুঁকি নিতে চাননি গোয়েন্দা সংস্থার হর্তাকর্তারা। কমিকের গল্পের আড়ালে কেউ গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্য পাচার করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে দ্রুত অভিযান চালানো হয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটিতে। অবশ্য অচিরেই তাদের আশংকা ভুল প্রমাণিত হয়।১ আসলে কমিকটির লেখকদের একজন আলভিন শোর্টজ, ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ‘পপুলার মেকানিকস’ নামে জনপ্রিয় একটি ম্যাগাজিনের আর্টিকেল থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। সেই আর্টিকেলেই ছিল আর্নেস্ট লরেন্সের সাইক্লোট্রনের মূলনীতি।
২.
খুব সহজভাবে বললে, পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্রগুলো একেকটি বড়সড় আকারের বন্দুক। তবে বুলেটের পরিবর্তে এরা নিক্ষেপ করে চার্জিত কণা। বায়ুশূন্য টিউবে বেশ কয়েকটি তড়িৎদ্বারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় যন্ত্রগুলো। একদম ঠিক সময়ে তড়িৎদ্বারের মেরু (পোলারিটি) পরিবর্তনের মাধ্যমে চার্জিত কণাদের প্রবল ধাক্কা দেওয়া হয়। ফলে ক্রমশ গতিবেগ বাড়তে থাকে। অনেকটা একই রকম মূলনীতি ব্যবহার করেই চালানো হয় আমাদের অতি পরিচিত এক্স-রে মেশিন এবং পুরোনো আমলের সিআরটি টিভি বা মনিটরগুলো। প্রথম দিকের কণাত্বরক যন্ত্রগুলো ছিল লিনিয়ার বা সরলরৈখিক প্রকৃতির। অর্থাৎ, এদের মাঝে কণাদের গতিপথ নাক বরাবর সোজা। যন্ত্রগুলোর মূল সমস্যা হলো, এতে কণাদের গতিবেগ খুব বেশি মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব হয় না। পাশাপাশি এদের আকার হতে হয় বিশাল। শুধু নিউক্লিয়াসের কুলম্ব বাধা টপকানোর মতো শক্তি বা গতিবেগ অর্জন করতে হলেই যন্ত্রের আকার ছাড়িয়ে যায় লম্বায় ১০০ মিটার। এ কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ ল্যাবরেটরিতেই এ ধরণের কণাত্বরক যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব নয়।
এরপর দৃশপটে আসে আর্নেস্ট লরেন্সের আবিষ্কার—সাইক্লোট্রন। ভিন্ন মেকানিজমে কাজ করা এ ধরণের কণাত্বরক যন্ত্রে চার্জিত কণারা পরিভ্রমণ করে স্পাইরাল বা সর্পিল পথে। সাধারণত ‘D’ আকৃতির দুটি শক্তিশালী চুম্বক ব্যবহার করে গতিপথ বাঁকিয়ে ফেলার কাজ করা হয়। সেজন্য সাইক্লোট্রনগুলোকে খুব স্বল্প পরিসরে স্থাপন করা সম্ভব। লরেন্সের তৈরি প্রথম সাইক্লোট্রনটি এঁটে যেত হাতের মুঠোতেই। তামার টিউব, ভ্যাকুয়াম পাম্প, তার, সিলিং ওয়াক্সের সমন্বয়ে তৈরি সেই যন্ত্রটির দাম ছিল মাত্র ২৫ ডলার। ১৯৩২ সালের মধ্যেই লরেন্স ৬৯ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি সাইক্লোট্রন বানিয়েছিলেন। সেটি ব্যবহার করে চার্জিত কণাদের শক্তি ৪.৮ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে উন্নত করা যেত। ক্ষুদ্র কণাদের জগতে শক্তির এই মান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।২ পরে তিনি আরও শক্তিশালী সাইক্লোট্রন তৈরি করেছিলেন। নোবেল জয়ের আগ পর্যন্ত তার তৈরি করা সবচেয়ে শক্তিশালী কণাত্বরক যন্ত্রের ব্যাস ছিল ১৫০ সেন্টিমিটার। এতে ব্যবহার করা চুম্বকগুলো এত বিশালাকার ছিল যে অনায়াসে এদের ওপরে উঠে আরাম করে বসে থাকা যেত। এমনকি পোজ দিয়ে তোলা যেত ছবিও। ১৯৩৯ সালের কোনো এক সকালে সাইক্লোট্রনটির সঙ্গে তোলা এমনই এক ছবিতে উপস্থিত ছিলেন বার্কলির রেডিয়েশন ল্যাবের তৎকালীন ৪৬ সদস্যের সবাই!
লিনিয়ার পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর এবং সাইক্লোট্রন উভয়ই সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে পর্যায় সারণির অজানা মৌলদের অনুসন্ধানে। অথচ প্রথমদিকে অনেক হোমরা-চোমরা বিজ্ঞানীরাও এদের ওপরে তেমন একটা আস্থা রাখতে পারেননি। ১৯৩৪ সালে স্বয়ং আইনস্টাইন এই যন্ত্রের কার্যপ্রণালিকে তুলনা করেছিলেন অন্ধকারে গুলি ছুঁড়ে পাখি শিকারের সঙ্গে! তার উপমাটি মোটেও ভুল ছিল না। তবে মজার বিষয় হলো, যদি অন্ধকারেও এক নাগাড়ে অবিরত গুলি ছোঁড়া হয়, তাহলে একসময় সেগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জোরালো সম্ভাবনা থাকে। ঠিক এমনটাই করা হয় সাইক্লোট্রনে। এটি যেন একটি সুপার মেশিন গান, যার গুলি কখনো ফুরায় না!
মার্ক স্টোয়ার নামে একজন একবার পুরো বিষয়টি স্কুলশিক্ষার্থীদের কাছে খুব সহজে হাতে কলমে উপস্থাপন করেছিলেন। প্রথমে তিনি তাদের দুটি দলে ভাগ হয়ে ক্লাসরুমের দুই প্রান্তে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন। তারপর তাদেরকে পরস্পরের মুখ লক্ষ্য করে চকলেট ছুঁড়ে মারতে বলেন। অনুমিতভাবেই সিংহভাগ চকলেটই লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে কদাচিৎ কয়েকটি চকলেট ঠিকই পথ খুঁজে নিত অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সহপাঠীর মুখে। তারপর স্টোয়ার শিক্ষার্থীদের খানিকটা কল্পনার আশ্রয় নিতে বলেন। তিনি বলনে, ‘যদি কয়েকটির পরিবর্তে প্রতি সেকেন্ডে ৬ বিলিয়ন চকলেট এক নাগাড়ে তিন মাস ধরে ছুঁড়ে মারা হয়, তাহলে কেমন হতো? নিশ্চিতভাবেই লক্ষ্যে পৌঁছানো চকলেটের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেত, তাই না? পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটরগুলোতে ঠিক সেটাই ঘটে।’