জলবায়ু পরিবর্তন মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীতে অপরিকল্পিত ও মাত্রাতিরিক্ত অনবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, লাগামহীন মিথেন ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ। এসবই পৃথিবীকে দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। জীবজগতকে করছে বিপন্ন। মানবসভ্যতার ওপর বায়ুদূষণের পরিণতি বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানবদেহে বাড়ছে দূষণজনিত রোগবালাইয়ের ঝুঁকি। অকালে ঝরে পড়ছে বহু প্রাণ।
তবে বায়ু দূষণ প্রতিকারে আশার আলো দেখাচ্ছেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার একদল গবেষক। তাঁরা জানিয়েছেন, বজ্রপাতের কারণে বাতাসে এক ধরনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে বাতাস বিশুদ্ধ হয়। পাশাপাশি গ্রিনহাউস গ্যাসকেও বায়ুমণ্ডলের বাইরে অপসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বজ্রপাত। বজ্রঝড়ে আটকে পড়া একটি বিমানকে পরীক্ষা করতে গিয়ে বিষয়টি প্রথম নজরে আসে এই গবেষকদের। এ পরীক্ষায় দেখা যায়, আগের তুলনায় বিমানের ভেতরের বাতাস বেশি বিশুদ্ধ। সর্বোপরি বিশুদ্ধতা সূচকে বিমানের বাতাসের মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও জানা গেছে, বজ্রপাতের কারণে সৃষ্ট অতি শক্তিশালী রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো প্রচুর বায়ু বিশুদ্ধকারী অক্সিডেন্ট বা ফ্রি রেডিক্যাল (মুক্ত মূলক) তৈরি করতে পারে।
এ বিষয়ে সায়েন্স অনলাইন সাময়িকীতে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল। সেখানে বলা হয়, বজ্রপাতের প্রবল শক্তিশালী বিক্রিয়ায় তৈরি অক্সিডেন্টগুলো মিথেনের মতো গ্রিনহাউস দূষকগুলোর সঙ্গে বিক্রিয়া করে কম ক্ষতিকর যৌগ তৈরি করে। ফলে বাতাস বিশুদ্ধ হয়। আর নিরপেক্ষ যৌগগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে সন্নিবেশ অণু তৈরি করে। এগুলো সহজেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পৃথিবীপৃষ্ঠে চলে আসতে পারে।
আগে গবেষকরা জানতেন, বজ্রপাতে সংঘটিত রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে নাইট্রিক অক্সাইড গ্যাস তৈরি হয়। এ প্রক্রিয়ায়ও হাইড্রোক্সিল মূলক জাতীয় অক্সিডেন্ট তৈরি হতে পারে। কিন্তু বজ্রপাত থেকে সরাসরি এত বেশি অক্সিডেন্ট তৈরির বিষয়টি বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না।
এর আগে, ২০১২ সালের মে এবং জুন মাসে একটি অত্যাধুনিক জেটবিমানের সাহায্যে বজ্রঝড়ের মেঘে দুটি ভিন্ন অক্সিডেন্টের পরিমাপ নির্ণয় করেছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো, ওকলাহোমা এবং টেক্সাস শহরের ওসব বজ্রঝড়ের মেঘে শনাক্ত হওয়া একটি মূলক ছিল হাইড্রোক্সিল মূলক। অন্যটি হাইড্রোপারক্সিল মূলক। বজ্রপাতের প্রচণ্ড তড়িৎ এবং মেঘের অন্যান্য বিদ্যুতায়িত অঞ্চলের মিথস্ক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে উৎপাদিত হাইড্রোক্সিল মূলক ও হাইড্রোপারক্সিল মূলক অণুগুলোর সম্মিলিত ঘনত্ব বজ্রমেঘের কিছু স্থানে ১ হাজার পার্টস পার ট্রিলিয়ন (ppt) পর্যন্ত পৌঁছে। বজ্রঝড়ের আগে, বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোক্সিল মূলকের সর্বাধিক ঘনত্ব ট্রিলিয়ন প্রতি ছিল খুবই অল্প—৫০ থেকে ৭০ পিপিটি। আর সবচেয়ে বেশি হাইড্রোপারক্সিল মূলক ট্রিলিয়ন প্রতি নির্ণয় করা হয়েছিল ১৫০ পিপিটি। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায়, বজ্রপাতের কারণে প্রচুর বায়ু বিশোধক মূলক উৎপাদক হিসেবে প্রস্তুত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও বায়ুমণ্ডল বিষয়ক গবেষক স্যার উইলিয়াম ব্রুন। তিনি ল্যাবে প্রমাণ করেন, বজ্রবিদ্যুৎ সত্যিই প্রচুর অক্সিডেন্ট তৈরি করতে পারে। বিমানের অভ্যন্তরীণ বাতাসে বজ্রপাতের কারণে অক্সিডেন্ট তৈরি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সহায়তা করে এটা।
বর্তমানে বিজ্ঞানীদের আরও একটি দল এ বিষয়ে আরও বিস্তর গবেষণা করছেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রাকৃতিক বজ্রপাতের এ গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে বায়ু দূষণের প্রতিকার, তথা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করা যায়, তা নিয়েও গঠনমূলক আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: সায়েন্স নিউজ ফর স্টুডেন্টস ডট অর্গ