আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কেউ গুগলের সেরা বিজ্ঞানী হচ্ছেন, কেউ কেউ স্থান করে নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ বিজ্ঞানীদের তালিকায়। কারো কারো উদ্ভাবন পাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই খবরগুলো আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা টিভি চ্যানেলগুলোতে খুব বেশি স্থান পায় না। কারণ, সবাই ব্যস্ত রাজনীতি, নায়ক-নায়িকাদের চটকদার খবর কিংবা নতুন ভাইরাল হওয়া কোনো মানুষকে নিয়ে। এত নেইয়ের মাঝেও একটা জায়গা থেকে নিয়মিত খবর রাখা হচ্ছে বাংলাদেশ কোথায় বিজ্ঞানে একটু এগিয়ে গেল কিংবা একটু আশার আলো দেখাচ্ছে। বিজ্ঞানের কোনো উদ্যোগ দেখলেই তারা পাশে দাঁড়ায়, ভরসা দেয়। আর আমাদের সেই ভরসা ও ভালোবাসার জায়গাটা হচ্ছে বিজ্ঞানচিন্তা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের গবেষণাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। আর এ ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের শতভাগ অধিকার আছে এই গবেষণাগুলো কী, কেন হচ্ছে এবং এর ফলাফল কীভাবে দেশে কিংবা বিশ্বে কাজে লাগবে, তা জানা। কারণ, এই গবেষণা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হচ্ছে। এই গবেষণাগুলোর ফলাফল এ জন্যই উঠে আসতে হবে গণমাধ্যমে। এতে একদিকে যেমন তৈরি হবে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ, তেমনি বাড়বে বিজ্ঞানক্ষেত্রে বিনিয়োগ। একইসঙ্গে মানুষ বুঝতে শিখবে, বিজ্ঞানীরা কীভাবে একটা সুন্দর আগামীর জন্য এই গবেষণাগুলো করছেন। বিজ্ঞানচিন্তা ঠিক এ কাজটাই করছে। যখনি কোনো নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, আমার কাছে কল আসে বিজ্ঞানচিন্তা থেকে। কী নিয়ে কাজ করছেন, কী কী ফলাফল পেয়েছেন, প্লিজ এখুনি জানান। গবেষকদের প্রতি ভালোবাসার এই জায়গাটাই বিজ্ঞানচিন্তাকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
দেশে অন্যরকম একটা ট্রেন্ড চালু করেছে বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞানের গল্পগুলো শোনার জন্য ‘নোবেল বিজ্ঞান বক্তৃতা’ আয়োজন করছে। নোবেলজয়ী অসাধারণ সব আবিষ্কারের গল্প শুনতে আসেন বিজ্ঞানপিপাসু মানুষ। নতুন করে আগ্রহ আর ভালোবাসা জন্ম হয় বিজ্ঞানের জন্য। আমরা চট্টগ্রামে ২০১৯ সাল থেকে নিয়মিত আয়োজন করি এই বক্তৃতা। সবগুলো আয়োজনেই আমাদের পাশে ছিল বিজ্ঞানচিন্তা।
বিজ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হলে অনেক আনন্দময় আয়োজন থাকতে হবে বিজ্ঞানকে ঘিরে। তেমনি একটা আয়োজন বিজ্ঞান উৎসব। বিজ্ঞানচিন্তার আয়োজনে বিজ্ঞান উৎসব শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি করে উদ্দীপনা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিজ্ঞান সংগঠন। যত বেশি বিজ্ঞান সংগঠন তৈরি হবে, বিজ্ঞান ঘিরে তত বেশি বড় বড় উদ্যোগ হবে।
ঢাকার বাইরের আমাদের মতো বিজ্ঞান সংগঠকদের কাছে বিজ্ঞানচিন্তা একটা ইতিবাচক আশার আলো। আমাদের যেকোনো আয়োজনে বিজ্ঞানচিন্তা পাশে থাকে, তুলে ধরে গণমাধ্যমে, শিক্ষার্থীদের হাতে চলে আসছে বিজ্ঞানচিন্তার পুরস্কার। এই ম্যাগাজিন আমার মাঝে যে অনুভূতি তৈরি করে দিয়েছে, তা অনেকটা উৎসাহ দিয়ে পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মতো। বিজ্ঞানচিন্তার ইতিবাচক সাড়া দেখে সব সময় মনে হয়, আমরা ভালো কিছু করছি, আমাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য, প্রশংসা করার জন্য কেউ একজন পাশে আছে।
আমার খুব দুঃখের একটা জায়গা হলো, আমাদের দেশে জীবপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ এখনো অবহেলিত। কত মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে এ সংক্রান্ত গবেষণা, কত শিশুকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে পারে এই প্রযুক্তি! জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে নতুন উৎকর্ষ আর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার হাতিয়ার। স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, খাদ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল—সবখানে রয়েছে এক বিশাল ক্ষেত্র। কিন্তু বাংলাদেশে নেই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, নেই যথাযথ মূল্যায়ন, নেই সচেতনতা। আমরা চাই বিজ্ঞানচিন্তা আরও এগিয়ে আসুক। বিজ্ঞানচিন্তা এই বোধ তৈরি করুক প্রতিটি ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিজ্ঞানচিন্তা তুলে ধরুক প্রতিটি গবেষণাগারের গল্প, বলুক আগামীর সম্ভাবনার কথা। বিজ্ঞানের বার্তা নিয়ে পৌঁছে যাক পাহাড়ে কিংবা গ্রামে।