উইলবার রাইট: আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা এক বিজ্ঞানীর গল্প

উইলবার রাইট বিখ্যাত দুই ভাইয়ের জুটির একজন। ভাই অরভিল রাইটের সঙ্গে মিলে তিনিই প্রথম উড়োজাহাজ বানিয়েছিলেন। তাঁদের সেই উদ্ভাবন আজ মানুষকে আকাশে ওড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আজ উইলবার রাইটের জন্মদিন। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা… 

উড়োজাহাজে উড়ছেন উইলবার রাইটছবি: এয়ার অ্যান্ড স্পেস

১৯০৩ সাল। ঠান্ডা, হিমেল হাওয়া বইছে। উইলবার রাইট দাঁড়িয়ে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার কিটি হক সৈকতে। চোখ তুলে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। ওপরে উড়ছে একটি উড়োজাহাজ, আর সেটি চালাচ্ছেন তার আপন ভাই অরভিল রাইট। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার কোনো মানুষ ইঞ্জিনচালিত উড়োজাহাজে সফলভাবে উড়ছে। আর কিছুক্ষণ পর ওই উড়োজাহাজে চড়ে বসবেন তিনি নিজে। উড়োজাহাজটি চালাবেন তাঁর ভাইয়ের চেয়েও বেশি সময়। ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় উদ্ভাবক হিসেবে রাইট ভাইদের নাম উঠবে। উড়োজাহাজের উদ্ভাবক হিসেবে তাঁদের পৃথিবীর মানুষ স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে। 

অরভিল রাইট প্রথমবার উড়োজাহাজে উড়ছেন, পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন উইলবার রাইট
ছবি: এয়ার অ্যান্ড স্পেস

১৮৬৭ সালের ১৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের মিলভিল শহরে জন্ম গ্রহণ করেন উইলবার রাইট। বাবা মিল্টন রাইট ছিলেন একজন চার্চের বিশপ। মা সুজান রাইট ছিলেন গৃহিণী। উইলবার এই দম্পতির তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের পর মিলভিল ছেড়ে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ডেটন শহরে চলে যায় পরিবার। বাবা মিল্টন বিভিন্ন গির্জায় ঘুরতে যেতেন। সেখান থেকে ফেরার পথে ছেলেদের কিছু না কিছু খেলনা নিয়ে আসতেন। একদিন ছেলেদের খেলনা হিসেবে একটা হেলিকপ্টারের মতো জিনিস নিয়ে আসেন। এই খেলনাই রাইট ভাইদের উড়ন্ত যন্ত্রের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। 

১৮৮৪ সালে উইলবার হাই স্কুল সম্পন্ন করেন। পরের বছর তিনি গ্রিক ও ত্রিকোণমিতির বিশেষ ক্লাসে অংশ নেন। কিন্তু হকি খেলার সময় একটা দুর্ঘটনার আর তাঁর মায়ের অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণে উইলবার রাইট কলেজিয়েট স্কুলের পড়া শেষ করতে পারেননি। 

স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার এবং স্পেস মিউজিয়ামে রাখা রাইট ভাইদের উড়োজাহাজের প্রতিকৃতি
ছবি: উইকিপিডিয়া

১৮৮৯ সালের ১ মার্চ। অরভিল রাইট ওয়েস্ট সাইড নিউজ নামে একটি স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। উইলবার রাইট ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। প্রকাশক হিসেবে ছিলেন অরভিল। সারা জীবন উইলবার রাইট তাঁর ভাই অরভিলের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসা ও উদ্যোগ গড়ে তোলার জন্য দলবদ্ধভাবে কাজ করেছেন। রাইট ভাইদের বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ছিল একটি মুদ্রণ সংস্থা এবং একটি সাইকেলের দোকান। এই দুটি উদ্যোগই তাদের যন্ত্রের প্রতি দক্ষতা এবং নতুন কিছু করার চিন্তা করতে সাহায্য করেছিল।

উইলবার রাইট জার্মান গ্লাইডার উদ্ভাবক অটো লিলিয়েনথালের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ নিশ্চয়ই একদিন আকাশে উড়তে পারবে। তাই ওড়ার ব্যাপারে তৎকালীন সময়ে যেসব গবেষণা হয়েছিল, উইলবার সেগুলো সব পড়ে ফেলতেন। সেসব পড়েই তিনি ভাবেন, বিমানের ডানাকে একটু মোচড় দিলেই সেটা ডানে বা বাঁয়ে ঘুরতে পারে। এই ভাবনাই পরে তাকে বিমান উড়াতে সাহায্য করেছিল। 

১৯০১ সালে উইলবার রাইট একটা গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন, নাম ‘অ্যাঙ্গেল অব ইন্সিডেন্স’। অ্যারোনটিক্যাল জার্নালে সেই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। একই বছর আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয় জার্মান ভাষায়। এগুলি ছিল বিমান চালনা নিয়ে রাইট ভাইদের প্রথম প্রকাশিত লেখা। সে বছরই উইলবার রাইট ওয়েস্টার্ন সোসাইটি অব ইঞ্জিনিয়ার্সে রাইট ভাইদের গ্লাইডিং পরীক্ষা নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন।

উড়োজাহাজ মেরামতের কাজ করছেন রাইট ভাইয়েরা
ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর। উইলবার এবং অরভিল রাইট একটি ইঞ্জিনচালিত উড়োজাহাজ নিয়ে সফলভাবে আকাশে ওড়েন। বাতাসের চেয়ে ভারী কোনো মেশিন প্রথমবার আকাশে উড়ল। অবশ্য দুজন একসঙ্গে ওড়েননি। প্রথমবার অরভিল রাইট সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আকাশে ওড়েন। তিনি ১২ সেকেন্ড আকাশে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ১২০ ফুট উড়েছিলেন। উইলবার রাইট একইদিন চতুর্থবারের পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি সময় আকাশে ওড়েন। তিনি টানা ৫৯ সেকেন্ড আকাশে বিমান উড়িয়ে ৮৫২ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন। সেই থেকে বিমানের ইতিহাস শুরু। 

১৯১২ সালে টাইফয়েড জ্বরে ভুগে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে উইলবার রাইটের মৃত্যু হয়।

সূত্র: থটকো ডটকম ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কিডস