জ্ঞানের আলোকযাত্রায় বিজ্ঞানচিন্তার নয় বছর

বিজ্ঞানচিন্তার দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে আমি অভিনন্দন ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তাঁদের নিরলস প্রয়াসে এটি আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রগণ্য বিজ্ঞান ম্যাগাজিন। এ দেশের বাস্তবতায় অনেক সময়ই একটি বিজ্ঞানবিমুখ প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করে। সেই পটভূমিতে বিজ্ঞানচিন্তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে এটির ভূমিকা অনবদ্য। সৃষ্টিলগ্ন থেকে এর সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক রয়েছে, তাতে আমি গর্বিত। এ পত্রিকার মূল ভাবনা অজানাকে প্রশ্ন করা—আসলেই বিজ্ঞানের মূলমন্ত্র।

বিজ্ঞান কঠিন প্রশ্ন করে, গভীরভাবে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এই ভাবনার প্রক্রিয়া আমাদের সবার মধ্যেই আছে। এটি সহজাত। এর জন্য বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে হয় না। কিন্তু এখানে একটি শর্ত আছে। শর্তটি হলো, ভাবনার পদ্ধতিটি রন্ডম হওয়া যাবে না, অর্থাৎ আমাদের ইচ্ছেমতো যুক্তিশাস্ত্রের বাইরে গিয়ে মনগড়া কারণ দর্শানো যাবে না এবং ভাবনাটি আমাদের হাজার বছরের সম্মিলিত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে হবে। গভীর ভাবনাগুলো কী?

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে চান মহাবিশ্বের গঠনের আসল রূপ। কেন শূন্যতার বদলে ভর, শক্তি আর স্থান–কালের সমন্বয়ে এক মহাবিশ্ব গড়ে উঠল, কেন চারটি মৌলিক বল মহাবিশ্বের সব মিথস্ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে, কেন মহাবিশ্ব পদার্থ দিয়ে তৈরি, প্রতিপদার্থরা কোথায় গেল? এ অভিযানে বিজ্ঞান স্বীকার করে, সব উত্তর তার কাছে নেই। সে জানে না ডার্ক ম্যাটার কী অথবা ডার্ক এনার্জি। কিন্তু আগামীকাল নতুন প্রমাণিত তত্ত্ব এলে সে তার প্রচলিত স্বীকৃত ডগমাকে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না। কারণ, বিজ্ঞান ক্রমাগতই একটি মডেলের বদলে আরও উন্নত মডেলের খোঁজ করে, যা দিয়ে জগৎকে বর্ণনা করা যায়। এটি একটি অন্তহীন অধ্যবসায়, পুরোনো স্তবকের পুনরাবৃত্তি নয়; বরং নতুন জ্ঞানের দরজা খোলার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

প্রভাবশালী অস্ট্রিয়ান দার্শনিক কার্ল পপার বলেছিলেন, বিজ্ঞানের দর্শনে ভ্রান্তিকরণের (Falsifiability) ধারণা থাকতে হবে, অর্থাৎ একটি অনুকল্পকে (Hypothesis) তখনই বৈজ্ঞানিক বলা যাবে, যদি সেটি মিথ্যা বা ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো সুযোগ থাকে। সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নগুলোকেও বিজ্ঞানীরা এমনভাবে করেন, যাতে সেগুলো পরীক্ষা করা যায়, ভ্রান্ত প্রমাণ করা যায়। ‘এই ঘর এমন বিশেষ অদৃশ্য কণা দিয়ে ভর্তি, যা কিনা কোনো পর্যবেক্ষণ দ্বারাই দৃশ্যমান হবে না’—এটি বৈজ্ঞানিক অনুকল্প নয়। কারণ, এই প্রস্তাব প্রথমেই বলে দিয়েছে, কোনো পর্যবেক্ষণ দিয়েই সেই কণা দেখা যাবে না, অর্থাৎ এই প্রস্তাবকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। এর মানে এই নয় যে ওই ঘরে ‘বিশেষ অদৃশ্য কণা’ নেই। কিন্তু ভ্রান্তিকরণের কোনো সুযোগ না দেওয়ার জন্য অনুকল্পটি বিজ্ঞানের আওতায় পড়বে না। এ জন্য অনেক বিজ্ঞানীই ‘মাল্টিভার্স আইডিয়া’ বৈজ্ঞানিক অনুকল্প কি না, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত। আবার একই কারণে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী পপারের ‘ভ্রান্তিকরণ সংজ্ঞা’টি বদলাতে চান। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণাপদ্ধতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা একমত। এটি হলো (১) একটি অনুকল্পের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ভাবীকথন (Prediction) করবেন, (২) তারপর হয়তো একটি এক্সপেরিমেন্ট প্রস্তুত করবেন, যার ফলাফল সেই ভাবীকথনকে সত্য বা মিথ্যা (অথবা এদের কোনো মিশ্রিত রূপ) প্রমাণ করবে এবং (৩) সেই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অনুকল্পটি পরিমার্জন করে আবার নতুন এক্সপেরিমেন্ট করা হবে। যেখানে এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব নয় (যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, ভূবিদ্যা ইত্যাদি), সেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অনুকল্পটিকে প্রতিষ্ঠা বা পরিত্যাগ করা সম্ভব। অবশেষে সব ভাবীকথন উত্তীর্ণ হলে অনুকল্পটি একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পরিণত হবে।

বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকেরা একদিকে ভ্রান্তিকরণনীতি ও অন্যদিকে গবেষণাপদ্ধতির বিষয়টি মাথায় রাখবেন—এই আমার আশা। এ ভাবনাপ্রক্রিয়াই বিজ্ঞানের আসল সৌন্দর্য, ভুল স্বীকার করে এগিয়ে চলা। কিন্তু বিজ্ঞানকে যাঁরা বাইরে থেকে দেখেন, তাঁদের কাছে এই প্রক্রিয়াকে মাঝেমধ্যে দুর্বোধ্য মনে হয়।

অনেকে বিজ্ঞানকে ভয় পান, আবার অনেকে বিজ্ঞানের অবদানকে ছোট করার চেষ্টা করেন; অথচ আমাদের চারপাশে যা ঘটছে, সবই বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। অনেকে আবার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রয়োগকে দেখেও না দেখার ভান করেন। তাঁরা ফোনে অন্তর্জাল ব্যবহার করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন, কিন্তু চিন্তা করতে চান না আমাদের জীবনে বিজ্ঞানের উপহারগুলো। পৃথিবীর কক্ষপথে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র অবলম্বনে স্থাপিত হচ্ছে স্যাটেলাইট। আর সেখান থেকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে আমরা পাচ্ছি জিপিএস সংকেত। সেটা আমাদের পথ চলতে সাহায্য করে। তরল ও গ্যাসপ্রবাহের তত্ত্ব মেনে হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, গ্যাসের চুলা জ্বলছে, টারবাইন ঘুরিয়ে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। তাপগতিবিদ্যা দিয়ে কাজ করছে জেট ইঞ্জিন। বার্নুলি ও নিউটনের নীতি মেনে সেটাই আমাদের উড়োজাহাজে চড়িয়ে আকাশে উড়িয়ে নিচ্ছে। আলোর পোলারাইজেশনকে আয়ত্ত করে ফোনের উজ্জ্বল রঙিন স্ক্রিন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ফলে বিজ্ঞান যেখানে সর্বব্যাপী, সেখানে তাকে যতটুকু সম্ভব জানা আমাদের কর্তব্য। অন্ততপক্ষে বিজ্ঞানের গবেষণাপদ্ধতিটি আমাদের মাথায় রাখা দরকার। বিজ্ঞানচিন্তা গত ৯ বছর আমাদের এ শিক্ষাই দিয়ে চলেছে। সামনের বছরগুলোয় তাদের প্রকাশনা আরও উজ্জ্বল হোক, আরও জনপ্রিয় হোক, এ আমার কামনা।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র