নতুন যা জানলাম

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. খোঁজ মিলল পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণীর 

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় পর্বতমালার উপত্যকা থেকে মিলেছে নতুন কিছু জীবাশ্ম। নিলপেনা এডিয়াকারা ন্যাশনাল পার্কে পরিচালিত খনন কাজে এই জীবাশ্মগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এসব জীবাশ্মের মাধ্যমে বিভিন্ন যুগে পৃথিবীতে জীবনের বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারবেন তাঁরা।

ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও জীবাশ্মবিদ স্কট ইভান্সের নেতৃত্বে একদল গবেষক এসব জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছেন। তাঁরা প্রায় ৫৫৫ মিলিয়ন বছর আগের একটি সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। তাঁদের আশা, এই আবিষ্কার পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভবের রহস্য উন্মোচনে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। প্রাণীটির নাম দেওয়া হয়েছে কোয়েসটিও সিম্পসোনোরাম (Quaestio simpsonorum)। এই প্রাণীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাম ও ডান দিকের প্রতিসাম্য বা দ্বিপার্শীয় প্রতিসমতা লক্ষ্য করা গেছে।

প্রাণীটির আকার হাতের তালু থেকে একটু ছোট। এর দেহের মাঝখানে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো আকৃতির অংশ রয়েছে, যা এদের দেহের বাঁ ও ডান দিককে দুই ভাগে ভাগ করে। গবেষকেরা বলেন, ‘জীবাশ্মটি অনন্য। কারণ এটি এমন একটি প্রাণীর, যে নিজে থেকে চলতে-ফিরতে পারত এবং এর শরীরের গঠন এত পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে অন্য কোনো জীবাশ্মে এরকম কিছু দেখা যায়নি।’

বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, ‘সামুদ্রিক এই প্রাণীটি ছিল অনেকটা ‘রুম্বা ভ্যাকুয়াম’-এর মতো। সমুদ্রের তলদেশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এটি ছোট ছোট শৈবাল, ব্যাকটিরিয়া এবং অন্যান্য সুক্ষ্ম জীব খেয়ে ফেলত। এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ইভোল্যুশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

২. সবচেয়ে বড় মৌলিক সংখ্যার সন্ধান

গ্রেট ইন্টারনেট মার্সেন প্রাইম সার্চ বা গিম্পসের এক সদস্য ছয় বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি নতুন মৌলিক সংখ্যা আবিষ্কার করেছেন। গত ১২ অক্টোবর এনভিডিয়ার সাবেক কর্মচারী লুক ডুরান্ট খুঁজে পেয়েছেন মৌলিক সংখ্যাটি। নতুন এই মৌলিক সংখ্যায় ৪ কোটি ১০ লাখ ২৪ হাজার ৩২০টি ডিজিট বা অঙ্ক আছে। কেউ যদি এই বিশাল মৌলিক সংখ্যাটি খাতা কলমে লিখতে চায়, তাহলে কয়েক মাস সময় লাগবে। নতুন মৌলিক সংখ্যাটি হলো । আর সংখ্যাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘এম১৩৬২৭৯৮৪১’। সংখ্যাটি সম্পূর্ণ পড়তে প্রতি সেকেন্ডে দুটি সংখ্যা পড়লেও প্রায় ২৩৭ দিন সময় লাগবে।

৩৬ বছর বয়সী লুক ডুরান্ট গত বছরের অক্টোবর থেকে এই অনুসন্ধানে যোগ দেন। এই সংখ্যা খোঁজার জন্য বিশ্বের ১৭টা দেশের ২৪টি ডাটা সেন্টারে থাকা হাজার হাজার গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট ব্যবহার করেছেন তিনি। নতুন মৌলিক সংখ্যা আবিষ্কারের জন্য লুক ডুরান্টকে ৩ লাখ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এই পুরস্কারের অর্থ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা স্কুল অব ম্যাথেমেটিকস অ্যান্ড সায়েন্সের গণিত বিভাগে দান করবেন।

৩. মেক্সিকোর জঙ্গলে হারানো শহরের সন্ধান

আধুনিক লেজারের মাধ্যমে মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের জঙ্গলে শতাব্দী প্রাচীন মায়া সভ্যতার অবিশ্বাস্য এক শহর আবিষ্কৃত হয়েছে। এই শহরে প্রায় ৬ হাজার ৬৭৪টি অবকাঠামো ছিল, যা প্রায় ১৫০০ বছর আগের। অবকাঠামোগুলোর মধ্যে রয়েছে চিচেন ইত্জা ও তিকালের মতো পিরামিড। গত ২৯ অক্টোবর প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক অ্যাকাডেমিক জার্নাল অ্যান্টিকুইটিতে এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। গবেষকেরা জায়গাটির মানচিত্র তৈরিতে আগের একটি গবেষণার লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রানজিং (লিডার) ম্যাপ ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতিতে একটি লেজারের আলোকে কোনো বস্তুর ওপর ফেলা হয়। প্রতিফলিত আলোর ফিরে আসতে যে সময় লাগে, তা পরিমাপ করে বস্তুটির দূরত্ব নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গত কয়েক বছরে অনেক পুরাতন শহর আবিষ্কৃত হয়েছে।

গবেষণাটি করেন নর্দার্ন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ লুক ওল্ড-থমাস ও তাঁর দল। মেক্সিকোর পূর্ব-মধ্য কাম্পেচেতে আগে কখনো মায়া কাঠামো অনুসন্ধান করা হয়নি। লুক ওল্ড-থমাস ও তাঁর দল ১২৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকার কার্বন বিশ্লেষণ করে লুকানো এই মায়া শহরের সন্ধান পান।  

৪. স্পেসএক্সের স্টারশিপের ঐতিহাসিক ঝুলন্ত-অবতরণ

গত ১৩ অক্টোবর ইতিহাস গড়ল স্পেসএক্স। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপ সেদিন সফলভাবে ঝুলন্ত-অবতরণ করে। ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের এই ঐতিহাসিক অর্জন মহাকাশ অভিযানে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ইলন মাস্কের নেতৃত্বে স্পেসএক্স রকেট পুনরায় ব্যবহারের চেষ্টা করে আসছিল। আগে রকেট উৎক্ষেপণের পর বুস্টার রকেটগুলো সাগরে গিয়ে পড়ত। এতে অতিরিক্ত খরচ হতো। পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর ছিল সেটা। কিন্তু স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেট এই প্রথমবারের মতো লঞ্চপ্যাডেই ফিরে এসেছে। লঞ্চপ্যাডের দুটি রোবটিক বাহু চপস্টিকের মতো রকেটটিকে শূন্যে থাকতেই লুফে নিয়েছে। তারপর নিরাপদে নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে বুস্টারটি।

ফ্লাইট ৫ রকেট উৎক্ষেপণের ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর রকেট থেকে বুস্টারটি আলাদা হয়ে যায়। প্রায় ৭ মিনিট পর বুস্টারটি টেক্সাসের বোকা চিকা অঞ্চলে ফিরে আসে। ফেরার সময় বুস্টারটির গতি কমিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং টাওয়ারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ল্যান্ডিং টাওয়ারের যান্ত্রিক হাত বুস্টারটিকে লুফে নেয়।

২০২৬ সালে চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য এই স্টারশিপ রকেট ব্যবহার করা হবে।এ ছাড়া ইলন মাস্ক মঙ্গলে যাত্রা করার পরিকল্পনা করছেন।সেখানে সমুদ্রে বুস্টার রকেট ফেলা বা লঞ্চপ্যাড বানিয়ে সমতল জায়গায় রকেট অবতরণ করানো ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এ অর্জনের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান মিলল। মূলত মঙ্গল বা ভিনগ্রহে নিরাপদে অবতরণের লক্ষ্যেই স্পেসএক্স এসব পরীক্ষা চালাচ্ছিল।এটি ছিল স্টারশিপের পঞ্চম পরীক্ষা।এর আগেও কয়েকবার পরীক্ষা চালানো হয়েছে, কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো সফল হলো স্পেসএক্স।

৫. প্রথমবারের মতো খোঁজ মিলল ট্রিপল ব্ল্যাকহোল সিস্টেমের

মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। এবার বিজ্ঞানীরা একসঙ্গে তিনটি ব্ল্যাকহোলের একটি সিস্টেম আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কার মহাবিশ্বের গঠন ও কৃষ্ণগহ্বরের গতিবিধিবিষয়ক গবেষণায় নতুন অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো। গত ২৩ অক্টোবর খ্যাতনামা নেচার জার্নালে এই তিন ব্ল্যাকহোলের সিস্টেম নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সিস্টেমটির নাম দেওয়া হয়েছে ভি৪০৪। সূর্যের চেয়ে প্রায় নয় গুণ বড় ও পৃথিবী থেকে প্রায় ৮ হাজার আলোকবর্ষ দূরে মিল্কিওয়েতে অবস্থিত এটি।

১৯৯২ সালে যখন ভি৪০৪ প্রথম আবিষ্কৃত হয়, তখন এটিকে একটি কৃষ্ণগহ্বর বলে ভাবা হয়েছিল। এটি একটি তারা গ্রাস করার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠে সে সময়। পরে এ সিস্টেমে দ্বিতীয় আরেকটি কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান মেলে। এবারে নতুন আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এখন এই সিস্টেমকে তিনটি ব্ল্যাকহোলের সমন্বিত ব্যবস্থা হিসেবে দেখছেন।

সূত্র: ফিজিকস ডটঅর্গ, আর্থ ডটকম, সায়েন্স এলার্ট, স্পেস ডটকম, লাইভ সায়েন্স, বিবিসি, সিএনএন, বিজ্ঞানচিন্তা

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ