বিজ্ঞানী ও লেখক ড. রেজাউর রহমানকে স্মরণ
ড. রেজাউর রহমানকে নিয়ে আয়োজিত হলো স্মরণসভা। ১৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারের প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনের ১০ তলার সভাকক্ষে বিকেল ৪ টায় এই সভা আয়োজিত হয়। বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা রেজাউর রহমানের প্রয়াণে এই সভা আয়োজন করে। এতে অংশ নেন ড. রেজাউর রহমানের পরিবারের সদস্যরা এবং তাঁর সহকর্মী, বন্ধু, স্নেহভাজনেরা।
শুরুতে নন্দিত এই বিজ্ঞানী ও লেখকের স্মরণে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘এখন বিজ্ঞান ও এআইয়ের যুগে আমাদের চিন্তায় এগিয়ে যেতে হবে রেজাউর রহমানের মতো মনোভাব নিয়ে’।
স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের তড়িৎকৌশল ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। তিনি বলেন, ‘রেজা স্যারকে চিনি ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে। তিনি তখন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত জ্যোতির্বিজ্ঞান কর্মশালায় আসতেন। তাঁর আলোচনার বিষয় ছিল বহিঃবিশ্বের প্রাণ। সেখানে তিনি সহজ ভাষায় পৃথিবীর বাইরের প্রাণের প্রকৃতি কী হবে, তা নিয়ে দারুণ ও সহজবোধ্য আলোচনা করতেন।’ অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বিজ্ঞানচিন্তা এবং প্রথম আলোকে অনুরোধ করেন, বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে।
ড. রেজাউর রহমানের আরেকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী। তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘স্যার বহুল প্রতিভার মানুষ ছিলেন। স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১১ সাল থেকে। তিনি যখন অফিসে যেতেন, প্রায়ই আমাকে ফোন দিতেন। স্যারের সঙ্গে গাড়িতে একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করতাম। তিনি প্রতি বছর বইমেলায় যেতেন। আমিও স্যারের সঙ্গে যেতাম। বিভিন্ন সময় আমরা একসঙ্গে আলোচনা করেছি।’
ড. রেজাউর রহমানের মেয়ে ড. মঞ্জুলিকা রহমান তাঁর বাবার স্মৃতিতে স্মরণসভা আয়োজন করার জন্য বিজ্ঞানচিন্তাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘যখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি হতো, আমরা ঢাকায় বেড়াতে আসতাম। একবার বাবা আমাকে বারান্দায় নিয়ে একটি কদম গাছ দেখালেন। সেই গাছে অনেক ফুল ফোটে। গাছটি দেখিয়ে বাবা বললেন, ‘‘শহরের মধ্যে এত বড় একটা কদম গাছ আছে, আর সেটা ফুল ফুটিয়ে চলছে, এটাই বিস্ময়।’’’
তাঁর কথার সঙ্গে যোগ করেন ড. রেজাউর রহমানের ছোট মেয়ে নীলাঞ্জনা রহমান। তিনি স্মৃতিচারণ করে বললেন, তিনি তাঁর বাবার লেখা ও প্রচেষ্টা বয়ে নিয়ে যেতে চান।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে প্রথম আলোর ট্রান্সপোর্ট বিভাগের সমন্বয়ক একরামুল হক স্মৃতিচারণ করেন ড. রেজাউর রহমানের শেষ দিনগুলোর। কীভাবে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, শেষ পর্যন্ত দেখভাল করলেন, তা সবার সামনে তুলে ধরেন। তাঁর মতে ড. রেজাউর রহমান আমাদের মধ্যে বহুকাল টিকে থাকবেন, তাঁর মৃত্যু নেই।
রেজাউর রহমানের মানবিকতা ও নৈতিকতার কথা বলেন লেখক ও গবেষক খান রবিউল আনাম। তাঁর মতে, ‘রেজাউর রহমান শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না, তাঁর মানবিক গুণ ছিল। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ভালো মানুষ। প্রাণিজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীকেও তিনি গুরুত্ব দিতেন। এদের অস্তিত্বের গুরুত্ব বুঝতেন। তাঁর ভাষা ছিল কোমল। জটিল বিষয়কে সহজ করে বলতেন।’
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘রেজা ভাই মাটির মানুষ ছিলেন। তিনি বিজ্ঞানী নাকি লেখক, তা নিয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে যেতাম। ছোটকে ছোট মনে না করে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, এটা আমি তাঁর কাছেই শিখেছি। তিনি সব সবসময় দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করতেন।’
ড. রেজাউর রহমানের ছোট ভাই ডাক্তার জাকিউর রহমান শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার গলা বা স্বর তাঁর মতো। আমার বন্ধুরা বাসায় ফোন করে আমাকে চাইলে তিনি যদি বলতেন আমি বাসায় নেই, বন্ধুরা বিশ্বাস করত না। ভাবত, আমিই বাসায় থেকে মিথ্যা কথা বলছি। তিনি বিজ্ঞান নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন।’ ডাক্তার জাকিউর রহমানের মতে, ‘বিজ্ঞানের মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়েও আলোচনা করা উচিত। কারণ, আমি মানুষের মৃত্যুর সঠিক কারণাজানতে চাই।’
এরপর ড. রেজাউর রহমানকে স্মরণ করে আলোচনা করেন প্রথমা প্রকাশনীর উপদেষ্টা, লেখক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে রেজাউর রহমান নামটির প্রথম পরিচয় তাঁর লেখা প্রথমদিকের উল্ল্যেখযোগ্য বই সাপ দিয়ে। আমার সাপ নিয়ে কিছু তথ্য দরকার ছিল। কিন্তু আমি বইটি পড়া শুরু করার পর শুধু তথ্য না নিয়ে পুরো বইটি পড়ে ফেলেছিলাম।’
স্মরণ অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আলোচনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক ও ড. রেজাউর রহমানের ভাই মতিউর রহমান। তিনি তাঁর ভাইয়ের জীবনের বেশ কিছু ঘটনা সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ার খুব ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়ার ভ্রমণের খুব শখ ছিল। তিনি প্রায়ই ঘুরতে যেতেন। ছোটবেলা থেকে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার ভীষণ ঝোঁক ছিল তাঁর। বাংলা একাডেমি পুরস্কার তাঁকে ভীষণভাবে উজ্জীবিত করেছিল। বিজ্ঞানচিন্তাকে ধন্যবাদ তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য।’
এই স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন উচ্ছ্বাস তৌসিফ। গান পরিবেশন করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। এছাড়া এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন, প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র, মেরিনা ইয়াসমিন, প্রথম আলোর যুগ্ম ফিচার সম্পাদক জামিল বিন সিদ্দিক, বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার এবং সহসম্পাদক কাজী আকাশ।
ড. রেজাউর রহমান ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, লেখক এবং শিক্ষক। সারাজীবন বিজ্ঞানকে সহজ ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি চেষ্টা করেছেন। ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়া রেজাউর রহমানের শৈশব কেটেছে ঢাকায়। বাবা ফজলুর রহমান, মা লুৎফুন্নেসা বেগমের সন্তান তিনি। নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা, সেখানেই শুরু লেখালেখির হাতেখড়ি। ১৯৬৯ সালে তাঁর লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৬৫ সালে এমএসসি শেষ করেন। পরে রাজশাহী সরকারি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয় পেশাগত জীবন। বিজ্ঞান প্রসারে তিনি ছিলেন একজন সার্বক্ষণিক কর্মী। গবেষণার প্রতি তাঁর গভীর টান ছিল। ১৯৭০ সালে তিনি যান চেক একাডেমি অব সায়েন্সেসে। সেখানে তিনি ‘রেডিয়েশন অ্যাফেক্টস অন ইনসেক্টস’ নিয়ে গবেষণা করে ১৯৭৯ সালে কীটতত্ত্বে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
দেশে ফিরে দীর্ঘ ৩৫ বছর কাজ করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে। গবেষণার বিষয় ছিল ফলের মাছি। এই অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর আচরণ, বিকাশ ও বিকিরণের প্রভাব নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও প্রশংসা পেয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন অধ্যাপক।
ড. রেজাউর রহমান জীবনের শেষ পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে। বিজ্ঞানচিন্তার শুরু ২০১৬ সালে। তখন থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।