বলিভিয়ায় মিলল ১৮ হাজার ডাইনোসরের পায়ের ছাপ
কিছু সময়ের জন্য ধরে নিন, ডাইনোসরের যুগে কোনো এক সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। চারপাশে কোনো মানুষ নেই, দালানকোঠা নেই। আছে শুধু বিশাল বিশাল আকৃতির সব প্রাণী। কোনোটা দৌড়াচ্ছে, কোনোটা অলস পায়ে হাঁটছে; আবার কোনোটা পানিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আজকের দিনে সেই দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন, তাই না?
কিন্তু সম্প্রতি বলিভিয়ার বিজ্ঞানীরা এক জাতীয় উদ্যানে মাটির নিচে ডাইনোসরের পায়ের ছাপের এক বিশাল ভান্ডার খুঁজে পেয়েছেন। সংখ্যাটা শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। ১৮ হাজার! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, প্রায় ১৮ হাজার ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে একই জায়গায়। এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড় জায়গা, যেখানে একসঙ্গে এতগুলো ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে।
মধ্য বলিভিয়ার তোরোতোরো ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে ‘কারেরা পাম্পা’ নামে এক জায়গায় এই চিহ্ন পাওয়া গেছে। আজ যেখানে ধু ধু প্রান্তর, কোটি কোটি বছর আগে এটি ছিল এক বিশাল সমুদ্রের উপকূলরেখা বা কোস্টলাইন।
গবেষণার সহ-লেখক এবং যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের সাউথওয়েস্টার্ন অ্যাডভেন্টিস্ট ইউনিভার্সিটির প্যালিন্টোলজিস্ট জেরেমি ম্যাকলার্টি বলছেন, ‘একই জায়গায় এত বেশি ডাইনোসরের পায়ের ছাপ এর আগে পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়নি।’
বিজ্ঞানীরা গুনে গুনে মোট ১৬ হাজার ৬০০টি সাধারণ পায়ের ছাপ এবং ১ হাজার ৩৭৮টি সাঁতারের দাগ খুঁজে বের করেছেন। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ১৮ হাজারের কাছাকাছি। এই বিশাল এলাকাটি প্রায় ৮০ হাজার ৫৭০ বর্গফুটজুড়ে বিস্তৃত। বিজ্ঞানীরা ঝাড়ু দিয়ে ওপরের ধুলোবালি সরানোর পর পাথরের বুকে ভেসে ওঠে এই প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকর্ম।
পায়ের ছাপগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, সবগুলো ডাইনোসর শুধু হাঁটছিল না, কোনোটা দৌড়াচ্ছিলও। আবার কারও কারও ভারী লেজ মাটি দিয়ে ঘষতে ঘষতে যাওয়ার দাগও রয়ে গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই পায়ের ছাপগুলো মূলত থেরোপড ডাইনোসরদের। থেরোপড হলো সেই সব ডাইনোসর, যারা দুই পায়ে হাঁটত এবং মাংসাশী ছিল। এদের০ পায়ে সাধারণত তিনটি করে আঙুল থাকত। এই ছাপগুলো তৈরি হয়েছিল ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষ দিকে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৪ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগের কোনো একসময়ে।
শুধু ডাইনোসর নয়, তাদের পাশাপাশি প্রাচীন পাখিদের পায়ের ছাপও পাওয়া গেছে এখানে। মনে হচ্ছে যেন বিকেলবেলা সবাই মিলে সৈকতে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল!
এই আবিষ্কারের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো সাঁতারের দাগ বা সুইম ট্র্যাকস। ডাইনোসররা যে পানিতে নামত এবং সাঁতার কাটত, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছে এখানে।
ম্যাকলার্টি বিষয়টি খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দাগগুলো দেখলে বোঝা যায়, থেরোপডেরা পানির ওপর ভেসে ভেসে পা চালাচ্ছিল। তাদের পায়ের আঙুলগুলো পানির নিচে কাদামাটিতে আঁচড় কাটছিল। এই আঁচড়গুলো দেখতে অনেকটা কমার (,) মতো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এখানে বাঁ পা এবং ডান পায়ের আঁচড়গুলো একে অপরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়েছে। অর্থাৎ তারা যে ছন্দ মেনে সাঁতার কাটছিল, তা একদম স্পষ্ট। বিশ্বে আর কোথাও এত বেশি সংখ্যক সাঁতারের দাগ একসঙ্গে পাওয়া যায়নি।’
সাধারণত জীবাশ্ম বা ফসিল দেখলে মনে হয় প্রাণীটি স্থির হয়ে আছে। কিন্তু কারেরা পাম্পার এই জায়গাটি যেন একটা জীবন্ত ভিডিও ফুটেজ!
পায়ের ছাপগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, সবগুলো ডাইনোসর শুধু হাঁটছিল না, কোনোটা দৌড়াচ্ছিলও। আবার কারও কারও ভারী লেজ মাটি দিয়ে ঘষতে ঘষতে যাওয়ার দাগও রয়ে গেছে। ডাইনোসরের লেজের ছাপ পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা, যা এই জায়গাকে আরও বিশেষ করে তুলেছে।
এখানে পাওয়া পায়ের ছাপগুলো সব এক সাইজের নয়। কিছু ছাপ মাত্র ৪ ইঞ্চি লম্বা। এগুলো হয়তো ছোট প্রজাতির কোনো থেরোপড অথবা বড় ডাইনোসরের বাচ্চাদের পায়ের ছাপ।
বলিভিয়া এমনিতেই ডাইনোসরের পায়ের ছাপের জন্য বিখ্যাত। এর আগে ‘ক্যাল ওর্কো’ নামের এক জায়গায় খাড়া পাহাড়ে প্রচুর পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল।
আবার কিছু ছাপ প্রায় ১২ ইঞ্চি লম্বা। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো মাঝারি আকারের কোনো মাংসাশী ডাইনোসরের ছাপ। তবে টি-রেক্স বা জাইগ্যান্টোসরাসের মতো বিশাল দানবদের কোনো চিহ্ন এখানে পাওয়া যায়নি।
এত বিপুলসংখ্যক পায়ের ছাপ এবং তাদের সমান্তরাল অবস্থান দেখে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এটি ছিল ডাইনোসরদের চলাচলের ব্যস্ত রাস্তা। হয়তো তারা দলবেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছিল।
বলিভিয়া এমনিতেই ডাইনোসরের পায়ের ছাপের জন্য বিখ্যাত। এর আগে ‘ক্যাল ওর্কো’ নামের এক জায়গায় খাড়া পাহাড়ে প্রচুর পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কারেরা পাম্পার এই আবিষ্কার আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
মাটির বুকে পাথরে খোদাই করা এই ১৮ হাজার পায়ের ছাপ আমাদের কোটি বছর আগের গল্প বলছে। সেখানে মানুষ ছিল না, কিন্তু জীবন ছিল তার আপন গতিতে চঞ্চল!
