আটলান্টিক কি আগামী পৃথিবীর বৃহত্তম মহাসাগর?

বিশ্ব মানচিত্র ও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে মহাদেশগুলোকে অনেক সমুদ্রবেষ্টিত দেখতে পাই। কিন্তু অনেক আগে দৃশ্যটি এমন ছিল না। আজ থেকে ২০ কোটি বছর আগে একটি বিশাল মহাসাগর ও একটি বড় মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল। বড় মহাদেশটি পরিচিত ছিল প্যানগিয়া বা প্যানজিয়া নামে। এটি একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘সম্পূর্ণ ভূমি’। আর প্যানথালাসা নামে পরিচিত ছিল বিশাল মহাসাগরটি। তবে তারও আগে সম্পূর্ণ পৃথিবীই পানিতে পূর্ণ ছিল। ভূতাত্ত্বিক ট্রাইয়াসিক যুগে (প্রায় ২০ কোটি বছর আগে) বড় মহাদেশ প্যানজিয়া ভাঙ্গতে শুরু করে। এতে প্রথমে লরেসিয়া (উত্তরেরটি) ও পরে গন্ডোয়ানাল্যান্ড (দক্ষিণেরটি) নামে দুটি মহাদেশের সৃষ্টি হয়।

ভেঙ্গে যাওয়া মহাদেশগুলো বাড়তে থাকে। কোটি কোটি বছর ধরে বাড়তে বাড়তে আমরা পেয়েছি এখনকার মহাদেশ ও মহাসাগর। হয়ত কোটি কোটি বছর পরে এই অবস্থা পরিবর্তন হয়ে সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্যপট তৈরি হবে। মহাদেশগুলো কেন, কীভাবে বা কী হারে বাড়ছে, সেসবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভূতত্ত্ববিদেরা। তাঁদের এই ব্যাখ্যা প্লেট টেকটোনিক থিওরি নামে পরিচিত। আজ আর সে বিষয়ে আলোচনা করবো না।

বতর্মানে ভূপৃষ্ঠের ৭০ ভাগের বেশি এলাকা জলাশয়। বাকী অংশ স্থলভাগ। এর মধ্যে বৃহত্তম মহাসাগর হলো প্রশান্ত মহাসাগর। ইউনেস্কোর আন্তঃরাস্ট্রীয় মহাসাগরীয় কমিশন অনুযায়ী ১৬.৫ কোটি বর্গ কিলোমিটারের বেশি আয়তনের এ মহাসাগরটি ভূপৃষ্ঠের ৩০ শতাংশের বেশি এলাকা জুড়ে আছে। ওই কমিশনের মতে, এ মহাসাগরের প্রশস্ততম স্থান দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া ও এশিয়ার মালয় উপদ্বীপের মাঝের ১৯ হাজার কিলোমিটার। মজার ব্যাপার হলো, বৃহৎ এ মহাসাগরটি পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম মহাসাগরের অবশেষ মাত্র। অর্থাৎ আগে পৃথিবীতে আরও বিশাল মহাসাগর ছিল। এক সময়ে পৃথিবীতে একটি বড় মহাসাগর ছিল। যদিও তা মহাদেশবেষ্টিত ছিল না। কারণ পৃথিবীর জন্মের প্রায় ১৫ কোটি বছর পরে পৃথিবীতে মহাসমুদ্র থাকলেও কোন মহাদেশ ছিল না। অর্থাৎ একটি অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র গ্রহটিকে আবৃত করে রেখেছিল। এ মহাসাগরটি বিস্তৃত ছিল প্রায় ৪ হাজার ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। তার মানে, ভূপৃষ্ঠের ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল সেই মহাসাগরটি। তবে এখনো বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীর মহাসাগর একটিই—বিশ্ব মহাসাগর। কারণ বিভিন্ন জায়গায় সাগরের পানির সংযোগ আছে। যেমন, দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিক মহাসাগর একইসঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের ও আফ্রিকার ভারত মহাসাগরের সঙ্গে মিলেছে।

ভারতের সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ব্রেনডেন মার্ফির মতে, সাধারণত বড় মহাদেশ গড়ে উঠলে বড় মহাসাগর তৈরি হয়। অন্য কথায়, একটি বড় মহাসাগর কোনো মহাদেশকে ঘিরে থাকলে সেই মহাদেশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাঁর মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত বহুবার ঘটেছে। তবে সবশেষ বড় মহাদেশ ছিল প্যানজিয়া। প্রায় ৩০ থেকে ২০ কোটি বছর আগের বড় মহাদেশ প্যানজিয়ার চারদিক জুড়ে ছিল বিশাল প্যানথালাসা সাগর। কিন্তু স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটের মতে, প্রায় ৬৫ কোটি বছর আগে রডিনিয়া নামে আরেকটি বড় মহাদেশ পৃথিবীর ভূভাগগুলোকে ভিন্নভাবে যুক্ত করেছিল। তবে এ দুটির মাঝামাঝি সময়ে আরেকটি বড় মহাদেশের উদ্ভব ঘটেছিল কিনা, সে ব্যাপারে ভূতত্ত্ববিদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে।

আর্থ সাইন্স রিভিউ সাময়িকীর ২০২২ সালের পর্যালোচনা অনুযায়ী, প্যানথালাসার আয়তন ছিল প্রায় ৩৬ কোটি বর্গ কিলোমিটার। সেটা ছিল ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা জুড়ে। অন্যদিকে আন্তঃরাস্ট্রীয় মহাসাগরীয় কমিশনের হিসাবে, আজকের প্রশান্ত মহাসাগরের আয়তন ১৬.৫ বর্গ কিলোমিটারের চেয়ে কিছুটা বেশি। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের ৩০ শতাংশের বেশি। অধ্যাপক ব্রেনডেন মার্ফি বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরের প্রস্থের সাথে আরও কমপক্ষে ৩ হাজার কিলোমিটার যোগ করলে প্যানথালাসার প্রস্থের সমান হতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আটলান্টিক মহাসাগর তৈরি হওয়ায় প্যানজিয়ার বড় অংশ ভেঙ্গে গেছে। আটলান্টিক মহাসাগর বর্তমানে ব্রাজিল ও লাইবেরিয়ার মাঝামাঝি এলাকায় ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার জুড়ে আছে। উত্তর আমেরিকা ও উত্তর আফ্রিকার মাঝের এলাকার জায়গা ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার প্রশস্ত। আর এর আয়তনে ৮.২৪ বর্গ কিলোমিটার। অতীতে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ দুটি একসঙ্গে ছিল।

২০ কোটি বছর আগের প্যানজিয়ার বিলুপ্তির সময় থেকে প্রশান্ত মহাসাগর বৃহত্তম মহাসাগরের শিরোপা ধরে রেখেছে। অধ্যাপক মার্ফির মতে, আগামী ৭ কোটি বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ প্রশান্ত মহাসাগরকে দুই ভাগে ভাগ করবে। মজার ব্যাপার হলো, একই সময়ে আটলান্টিক মহাসাগর বেড়ে পৃথিবীর বৃহত্তম মহাসাগরের মুকুট পরবে।

লেখক: ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষক

সূত্র: লাইভ সাইন্স-এ প্রকাশিত মাইকেল ধর প্রণীত ‘পৃথিবীতে আদৌ থাকা বৃহত্তম মহাসাগরটি কী’ (What’s the largest ocean that ever existed on Earth?); ১৪ আগস্ট ২০২২