বিজ্ঞান জগতে নতুন কী ঘটল অক্টোবর মাসে, দেখে নিন একনজরে

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূরপ্রসারী যে, সেগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. নতুন টাইরানোসরাস প্রজাতি আবিষ্কার

ডাইনোসর নিয়ে চার দশক ধরে চলা একটি বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে নতুন গবেষণা। বিতর্ক ছিল ন্যানোটাইরান্নাস নামে ছোট টাইরানোসরাস কি আসলেই আলাদা প্রজাতি, নাকি এটি শুধু একটি ছোট টি-রেক্স?

এই বিতর্কের জন্ম হয়েছিল ১৯৪২ সালে খুঁজে পাওয়া একটি ছোট টাইরানোসরের খুলি থেকে। ১৯৮৮ সালে বিজ্ঞানীরা যাকে ন্যানোটাইরান্নাস ল্যানসেনসিস (Nanotyrannus lancensis) নামে একটি আলাদা প্রজাতির মর্যাদা দেন। কিন্তু মাত্র একটি খুলি দেখে এর বাকি শরীর কেমন ছিল, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে এখন একটি প্রায় সম্পূর্ণ জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া গেছে। আর তা থেকেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, ন্যানোটাইরান্নাস একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি। এরা প্রায় ৬ কোটি ৭০ লাখ বছর আগে পশ্চিম উত্তর আমেরিকায় বাস করত।

সম্প্রতি পাওয়া এই জীবাশ্ম থেকে বোঝা গেছে, একটি ট্রাইসেরাটপসের সঙ্গে লড়াইরত অবস্থায় একটি মাঝারি আকারের টাইরানোসর ছিল। এটিকে এতদিন বাচ্চা টি রেক্স বলে মনে করা হলেও গবেষকেরা এখন বিস্তারিত পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, এটি আসলে প্রাপ্তবয়স্ক ন্যানোটাইরান্নাস ল্যানসেনসিস। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই ন্যানোটাইরান্নাসের দাঁতের সংখ্যা বেশি, হাত বড় এবং লেজ ছোট। এদের শরীরের গঠন ছোট টি-রেক্সের সঙ্গে মেলে না। নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক লিন্ডসে জ্যানো জানিয়েছেন, এটি একটি সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠা ন্যানোটাইরান্নাস। এর ওজন ছিল মাত্র ১ হাজার ৫০০ পাউন্ড। এই আবিষ্কার টি-রেক্সের জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণায় বড় পরিবর্তন আনবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে নেচার জার্নালে।

২. জেমস টেলিস্কোপের চোখে ভূতুরে রেড স্পাইডার নেবুলা

ছবিটা নক্ষত্রের মৃত্যুর পরের দৃশ্য। এদেরকে বলা হয় ‘গ্রহীয় নীহারিকা’। তবে গ্রহের সঙ্গে এদের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। এই নামটি এসেছে একটি ভুল ধারণা থেকে। অনেক আগে যখন বিজ্ঞানীরা প্রথমবার টেলিস্কোপে এদের দেখেন, তখন এদের গোল ও অস্পষ্ট চেহারা দেখে ভুল করে গ্রহ ভেবেছিলেন। আমরা এখন জানি, এই ধারণা একেবারেই ভুল। তবুও সেই ভুল নামেই এরা পরিচিত হয়ে আছে। রেড স্পাইডার নেবুলা পরিচিত এদের আশ্চর্যজনক সৌন্দর্যের কারণে। এই বিস্তারিত ছবি তুলেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরার সাহায্যে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি মৃত নক্ষত্র কীভাবে ধূলিকণা ও গ্যাস ছেড়ে দিয়ে নেবুলা তৈরি করছে। এর ভেতরের চিকন অংশগুলো এমনভাবে মোচড়ানো ও ছড়ানো যে দেখে মনে হয়, এটি কোনো মহাজাগতিক মাকড়সার হাত-পা। এই রেড স্পাইডার নেবুলা প্রায় ৩ আলোকবর্ষ লম্বা। গ্যাস দিয়ে তৈরি এই অংশগুলো আসলে নক্ষত্রের তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে হাজার হাজার বছর ধরে বিশাল বুদবুদে পরিণত হয়েছে। তা ছড়িয়ে আছে পুরো ছবি জুড়ে। গবেষকেরা ২৮ অক্টোবর দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।

কিউলিসেটা অ্যানুলাটা প্রজাতির মশার দেখা মিলেছে মশামুক্ত আইসল্যান্ডে
ছবি: উইকিপিডিয়া

৩. প্রথমবারের মতো মশা দেখা গেল আইসল্যান্ডে

দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর কয়েকটি স্থানের মধ্যে আইসল্যান্ডই ছিল একমাত্র মশা মুক্ত দেশ। ঠান্ডার কারণে আইসল্যান্ডে মশার জন্মাতে পারত না। কিন্তু এবার টানা ১০ দিন গরম আবহাওয়া থাকার কারণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সম্প্রতি আইসল্যান্ডে প্রথমবারের মতো মশার সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় এক পোকা পর্যবেক্ষক বিয়র্ন হ্যালটাসন হিমবাহ উপত্যকায় তিনটি মশার সন্ধান পেয়েছেন। বিয়র্ন হ্যালটাসন তাঁর খুঁজে পাওয়া দুটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ মশা সংগ্রহ করে সেখানকার ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইনস্টিটিউটে পাঠান। ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ববিদ ম্যাথিয়াস আলফ্রেদসন নিশ্চিত করেন, এগুলো কুলিসেটা অ্যানুলাটা (Culiseta Annulata) প্রজাতির মশা। ঠান্ডার মধ্যেও এই প্রজাতির মশা টিকে থাকতে পারে।

বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। আইসল্যান্ডে সাধারণত মে মাসেও তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে দেখা যায় না। কিন্তু এই বছর মে মাসে তাপমাত্রা রেকর্ড ২৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছেছিল। তবে এই মশাগুলো পথ ভুলে এসেছে, নাকি সত্যিই  আইসল্যান্ডে ঘাঁটি গেড়েছে, তা নিশ্চিত হতে আরও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।

৪. বিরল অর্ধ-গোলাপি হীরার সন্ধান

সম্প্রতি এমন একটি হীরা খুঁজে পাওয়া গেছে, যা দেখতে অর্ধেক গোলাপি ও অর্ধেক বর্ণহীন। বিরল রঙের এই হীরা খন্ডটি খুঁজে পেয়েছেন আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানার করোয়ে খনির শ্রমিকরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বিরল হীরাটি দুটি ভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছিল। হীরাটির ওজন প্রায় ৩৭.৪১ ক্যারেট বা ৭.৫ গ্রাম।

গবেষণা সংস্থা জেমোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অব আমেরিকার বিশেষজ্ঞ স্যালি ইটন মাগানার জানান, হীরাটির গোলাপি অংশটি সম্ভবত প্রথমে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সে সময় রং গোলাপি ছিল না। লাখ লাখ বছর আগে কোনো পাহাড় তৈরির ঘটনার সময় এটি প্রচণ্ড চাপ বা বিকৃতির শিকার হয়। এই বিকৃতির ফলেই এর রং গোলাপি হয়ে যায়। আর হীরাটির বর্ণহীন অংশটি তৈরি হয়েছিল এর অনেক পরে। অর্থাৎ, এক হীরাতেই দুটি ভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস লুকিয়ে আছে।

গোলাপি হীরা পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে বিরল রত্নগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর এটি ঠিক কীভাবে তৈরি হয়, তা বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন। হীরা তৈরি হয় পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মাইলেরও বেশি গভীরে, যেখানে অত্যন্ত উচ্চ তাপ ও চাপ কার্বন পরমাণুগুলোকে শক্ত করে হীরা তৈরি করে। পরে আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে এই হীরা দ্রুত মাটির ওপরে উঠে আসে। কিন্তু গোলাপি হীরা এসব উপায়ে তৈরি হয় না। এদের রং আসে কাঠামোগত বিকৃতির কারণে।

৫. ইস্পাতের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী কাঠ

ইস্পাতের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী কাঠ তৈরি করেছে মার্কিন কোম্পানি ইনভেন্টউড। তাঁদের দাবি, সুপারউড ইস্পাতের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তি নিয়ে ওজন বহন করার ক্ষমতা রাখে। এটি একই সঙ্গে সাধারণ কাঠের চেয়ে ছয় গুণ পর্যন্ত হালকা। সম্প্রতি বাজারে এসেছে এই পণ্য। এই কোম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা পদার্থবিজ্ঞানী লিয়াংবিং হু। এক দশকের বেশি আগে অধ্যাপক লিয়াংবিং হু এই কাঠ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নতুন ধরনের কাঠ তৈরি করা।

অধ্যাপক হু ‘স্বচ্ছ কাঠ’ তৈরির জন্যও বিখ্যাত। তবে এটি একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ম্যাটেরিয়ালস ইনোভেশনে কাজ করার সময় লিয়াংবিং হু কাঠকে আরও শক্তিশালী করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাঁদের প্রথম বড় সাফল্য আসে ২০১৭ সালে। এই পদ্ধতিতে সাধারণ কাঠকে প্রথমে রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যাতে লিগনিন ও হেমিসেলুলোজের মতো বাইন্ডারগুলো আংশিক দূর হয়। এরপর সেই কাঠকে উচ্চ চাপ ও তাপে সংকুচিত করা হয়। ফলে কাঠের প্রাকৃতিক শক্তি প্রদানকারী উপাদান সেলুলোজ ফাইবারগুলো অত্যন্ত ঘন হয়ে ওঠে। এই ঘন ও সংকুচিত কাঠই উন্নত নির্মাণসামগ্রীতে পরিণত হয়, যা ইস্পাতের চেয়েও শক্তিশালী।

বিজ্ঞানীরা রস সাগরে যা খুঁজে পেয়েছেন, তা তাঁদের রীতিমতো অবাক করেছে

৬. ‘ভয়াবহ’ জিনিস মিলল অ্যান্টার্কটিকার সাগরতলে

অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল সমুদ্রের গভীরে ফাটলগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসছে। এই মিথেন নির্গমনের হার বিজ্ঞানীদের কাছে ‘আশ্চর্যজনক’ মনে হচ্ছে। কারণ খুব দ্রুত নতুন নতুন গ্যাস নির্গমনের উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এই ঘটনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর আশঙ্কা তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ভবিষ্যতের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে তাঁরা এখন পর্যন্ত যে ধারণা বা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এই অপ্রত্যাশিত মিথেন নির্গমনের ফলে তা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। অর্থাৎ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি হতে চলেছে।

সাগরতলের নিচে হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া বিপুল পরিমাণ মিথেন জমা হয়ে আছে। এই অদৃশ্য ও জলবায়ুদূষণকারী গ্যাস ফাটলের মাধ্যমে পানির সঙ্গে মিশে যায় এবং অনেক সময় বুদবুদের স্রোত হিসেবে সাগরপৃষ্ঠেও দেখা যায়। এই মিথেন গ্যাস এত বেশি ক্ষতিকর যে এটি বায়ুমণ্ডলে এর প্রথম ২০ বছরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ৮০ গুণ বেশি তাপ আটকে রাখে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য এটা মারাত্মক বিপজ্জনক। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না, এই নির্গমন ঠিক কীভাবে কাজ করে, কতগুলো উৎস আছে এবং সাগরের নিচে থাকা মিথেন-খাওয়া ব্যাকটেরিয়া এই গ্যাসের কতটা অংশ শোষণ করে নেয়। এই গবেষণার বিস্তারিত তথ্য নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক: ঢাকা কলেজ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, নিউইয়র্ক টাইমস ও বিবিসি, সায়েন্স এলার্ট, বিবিসি সায়েন্স, অ্যানথ্রোপিক, ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, এনবিসি নিউজ, নিউ সায়েন্টিস্ট ও বিজ্ঞানচিন্তা