সাক্ষাৎকার

শুধু বিজ্ঞানী নয়, সৎ মানুষ হতে হবে—মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী, মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ। তাঁর দায়িত্বকালে বিজ্ঞান জাদুঘরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আরও আধুনিক হয়েছে জাদুঘরের কার্যক্রম, বেড়েছে সক্রিয়তা। এ সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মিউজু বাস প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে গেছে বিজ্ঞানের আকর্ষণীয় সব প্রদর্শনী, আয়োজিত হয়েছে ৭ হাজারের বেশি কর্মশালা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর কমপ্লেক্সে বসেছে খুদে বিজ্ঞানীদের মিলনমেলা, জাদুঘর পেয়েছে আন্তর্জাতিক আইএসও সনদ। মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে বিজ্ঞানচিন্তার আলাপে উঠে এসেছে এ রকম নানা বিষয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তায় আপনাকে স্বাগত। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। শুরুতেই জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: আমি ভালো আছি। ধন্যবাদ।

বিজ্ঞানচিন্তা:

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে সাড়ে চার বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। সময়টা কেমন কাটল? আপনার অভিজ্ঞতা বলুন।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সময়টা ভালো কেটেছে। কারণ, আমি এই প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক, নান্দনিক ও দর্শকবান্ধব করার জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এটা শুধু জাদুঘর নয়, জাদুঘরের বাইরেও এর ভূমিকা আছে। বিজ্ঞানের প্রচার-প্রসার ও তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করা, এ লক্ষ্যে আমরা এখানে কাজ করছি। লাখ লাখ দর্শক ও তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞানের সঙ্গে, বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে, বিজ্ঞানবিষয়ক চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছি এবং পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ করতে পেরেছি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে রয়েছে মজার সব প্রদর্শনী
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের বিভিন্ন কর্মসূচি আছে, যেমন মিউজু বাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায়। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চায় কতটুকু পরিবর্তন এসেছে বলে আপনি মনে করেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: দেখুন, পরিবর্তনের বিষয়টি আপেক্ষিক। তার পরও বলব, বিজ্ঞান শিক্ষাকে আমরা শুধু রাজধানী ঢাকার জাদুঘরকেন্দ্রিক রাখিনি। আমরা ভ্রাম্যমাণ বাসে বিজ্ঞান শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় যেমন মিউজিয়াম বাস (মিউজো বাস), মুভি বাস, টেলিস্কোপ বাস ইত্যাদির মাধ্যমে সারা দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার অপার সুযোগ তৈরি করেছি। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে শিশুরাও জানতে পেরেছে মহাকাশ কী। বিশাল মহাকাশের বিভিন্ন বিষয় আমরা তাদের সামনে তুলে ধরেছি। ভ্রাম্যমাণ মুভি বাসের মাধ্যমে সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, প্রকৃতির বৈচিত্র্য তুলে ধরেছি তাদের কাছে, যেন তারা প্রকৃতিকে জানতে পারে। কারণ, প্রকৃতিকে জানলে আবিষ্কারের চেতনা, প্রেরণা ও উদ্ভাবনের চিন্তা গড়ে ওঠে বলে মনে করি। এ লক্ষ্যে আমরা স্কুল, কলেজ, বিজ্ঞান ক্লাব এমনকি পাড়া–মহল্লাতেও এই মুভি বাস, মিউজিয়াম বাস ও অবজারভেটরি বাসগুলো পাঠিয়েছি। লাখ লাখ শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী—এ রকম অনেককে বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছি। আমাদের একটি বড় অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মানুষ দিন দিন অলস হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানবিমুখ হয়ে পড়ছে, ডুবে যাচ্ছে মোবাইল আসক্তির মধ্যে, গৃহবন্দী হয়ে পড়ছে। আমরা মানুষকে এ বলয় থেকে বেরিয়ে অজানাকে জানার সুযোগ করে দিচ্ছি, বিজ্ঞানের শিক্ষণীয় সব বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করছি। প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যাগুলো কীভাবে বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাধান করা যায়, তা চিন্তা করতে উৎসাহিত করছি। মূলত প্রান্তিক অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ বিজ্ঞান শিক্ষার যে ব্যবস্থা আমরা করেছি, তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও জনমানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের চেতনা বেড়েছে। এটিকে বড় পরিবর্তন বলা যায় কি না, সেটি আপেক্ষিক। তবে আমি বলব, এগুলো খুব প্রাসঙ্গিক।

বিজ্ঞানচিন্তা:

অনেক কিশোর-কিশোরী বা তরুণের স্বপ্ন থাকে, বড় হয়ে ভালো বিজ্ঞানী হবে। আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে বলুন, বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার পরিবেশ, স্কুল-কলেজ, অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। বিজ্ঞানী হয়ে যেন শুধু পুঁথিগত বিজ্ঞানী বা গবেষক নয়, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য সমস্যার সমাধান করতে পারে। বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য তাদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা অনুঘটকের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, পুরস্কার, প্রণোদনা, বিদেশে পাঠানোসহ গবেষণার জন্য নানাভাবে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানী হওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়া যেতে পারে। এটি তাদের মনোজগতে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। এভাবে তারা বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

সাক্ষাৎকারকালে মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে বেশ কিছু বিজ্ঞান ক্লাব আছে, যাদের আপনারা বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য এই ক্লাবগুলো কতটা সফল? এ বিষয়ে আরও কিছু করা সম্ভব কি না?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: অনেক বিজ্ঞান ক্লাব আছে। সব বিজ্ঞান ক্লাব যে সফল, আমি তা বলব না। বিজ্ঞান ক্লাবের সফলতার জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তাঁদের, যাঁরা বিজ্ঞান ক্লাব পরিচালনা করেন। একটি ক্লাব একা কিছু করতে পারে না। বিজ্ঞান ক্লাবগুলো যেন অচল হয়ে না পড়ে, সে জন্য দক্ষ ও ত্যাগী নেতৃত্ব দরকার। তাঁরা সারা দেশে বিজ্ঞান ছড়িয়ে দেবেন।

বিজ্ঞানচিন্তা:

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালনকালে কী কী পরিবর্তন নিয়ে এলেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর খুব অবহেলিত ছিল। এটি পরিচিতির সংকটে ভুগছিল নানা কারণে। যতটুকু দেওয়ার কথা ছিল, আমরা শিক্ষার্থীদের ততটা দিতে পারিনি। আমি যোগদান করার পর দেখলাম, এর পরিবেশগত পরিবর্তন আনা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। দর্শক কেন আসবে? কীভাবে আসবে? প্রচুর অবকাঠামোগত সমস্যা ছিল, ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা ছিল। আমরা আধুনিকায়নের কাজ করেছি। শৃঙ্খলা ও অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রত্যেক কর্মচারী ও কর্মকর্তা যেন কর্তব্যপরায়ণ হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করেন, তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। আমরা অবকাঠামো পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। বাহ্যিক অবয়ব, অভ্যন্তরীণ অবয়ব, কাঠামো, গ্যালারির ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজ করে ভৌত পরিবর্তন এনেছি। দৃষ্টিনন্দন গেট বা তোরণ নির্মাণ করেছি, টাইটানিক জাহাজের রেপ্লিকা স্থাপন করেছি। পুরোনো প্রদর্শনীগুলোর আধুনিকায়ন করেছি। আসলে জাদুঘরে সাধারণ মানুষ যেন আগ্রহ পায়, সে রকম আকর্ষণীয় জিনিস প্রয়োজন। এটি একটি মৌলিক বিষয়। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করেছি।

পাশাপাশি প্রকৃতি নিয়েও কাজ করেছি আমরা। প্রকৃতিকে রক্ষা করে, পরিবেশকে মূল্য দিয়ে যেন বিজ্ঞান টিকে থাকে, সেই সমন্বয় করার চেষ্টা করেছি। বিশাল এলাকা সবুজে আবৃত করেছি। বিভিন্ন উদ্ভিদের ইংরেজি নাম, বাংলা ও বৈজ্ঞানিক নাম যুক্ত করে দিয়েছি। মানে পুরো বাগান এখন প্ল্যান্ট মিউজিয়াম (উদ্ভিদ জাদুঘর)।

এখন দর্শকদের কমপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগে পুরোটা ঘুরে দেখতে। দর্শকেরা যাতে শেখার পাশাপাশি বিনোদন পায়, সে ব্যবস্থাও করেছি আমরা। রাজধানীতে বায়ুদূষণ, ট্রাফিক জ্যাম বা নাগরিক যে সমস্যাগুলো আছে, মানুষ তা থেকে মুক্ত হয়ে বিজ্ঞান জাদুঘরে প্রাণভরে শ্বাস ফেলতে পারছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

একসময় জামাল নজরুল ইসলামসহ আরও অনেক বিজ্ঞানী এখানে বক্তব্য দিয়েছেন। এই চর্চা এখন আর নেই। এটা কি নতুন করে চালু করার কোনো সম্ভাবনা আছে?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: হ্যাঁ, পরিকল্পনা আছে। বিজ্ঞান বক্তৃতা, অলিম্পিয়াড, সেমিনার, কুইজ, বিজ্ঞানমেলা, উদ্ভাবন—সব কটিতে আমরা পরপর তিন বছর শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মন্ত্রণালয় থেকে সনদ ও স্বীকৃতি পেয়েছি। এগুলো আমাদের সফলতা। তারপরও বলব, অনেক কিছু করা বাকি রয়ে গেছে। আরও বেশি অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়ন দরকার। আধুনিক প্রযুক্তির কিছু সন্নিবেশ থাকা দরকার। আমরা সেই চেষ্টা করছি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট, এ জন্য সবকিছু সমন্বয় করে আমরা একটু ধীরে এগোচ্ছি। বরেণ্য বিজ্ঞান ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞানে যাঁদের অনেক অবদান ছিল, তাঁদের স্মরণীয় করে রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে এ ধরনের বক্তব্য অনেক কাজে আসছে। তাই আমরা আপনাদের সুপারিশ গ্রহণ করছি। আশা করছি, নতুন বছরে (২০২৪) বিজ্ঞান বক্তৃতার আয়োজন আবার শুরু করব। বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামকে স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর নামে আমরা একটি বিজ্ঞানী কর্নার তৈরি করেছি। আরেকটি হচ্ছে, হানিফ উদ্দিন কর্নার, কম্পিউটারে তাঁর অবদান অনেক বড়। তাঁর পরিবারকেও আমরা এখানে এনে স্বীকৃতি দিয়েছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা সুনাম অর্জন করেছেন ও বড় ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের স্মরণে স্মারক বক্তৃতামালা চালু করব ইনশা আল্লাহ। বক্তব্যগুলো নিয়ে সংকলন বের হতো, তা আবার চালু করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কর্মকর্তা ও কর্মীদের একাংশ
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি তো সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালন করলেন। এই সময়কাল শেষে আপনি কি সন্তুষ্ট?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: না, আমি সন্তুষ্ট নই। আমার অনেক কিছু করার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু বাস্তবে আমি সব করতে পারিনি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এক কোকিলে যেমন বসন্ত আসে না, তেমনি একজন ব্যক্তি দিয়ে সব হয় না। সম্মিলিত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্কের প্রয়োজন আছে।

জাদুঘরকে আরও আধুনিক, আরও বিজ্ঞান উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ করা এবং বিজ্ঞানচর্চায় আরও বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু বিনোদন দিয়ে হবে না, তাহলে উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যাবে। বিনোদনের পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষাকে উজ্জীবিত করা, আবিষ্কারের দিকে উৎসাহী করা—এটা অনেক বড় কাজ বিজ্ঞান জাদুঘরের। আমি আবারও বলি, জাদুঘরকে আমরা শুধু জাদুঘর হিসেবে রাখিনি। গত কয়েক বছরে আমরা প্রায় ৪৫ লাখ ভার্চ্যুয়াল ও সশরীর দর্শককে জাদুঘরমুখী করতে পেরেছি। মুভি বাসের মাধ্যমে আমরা প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে যুক্ত করেছি। প্রান্তিক অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান ল্যাব নেই, এ রকম ৩০০ প্রতিষ্ঠানকে আমরা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে বিজ্ঞান ল্যাবগুলো সুসজ্জিত করেছি। বিজ্ঞানচর্চা যেন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকে, সে ব্যবস্থা করেছি। বিজ্ঞান বিশেষায়িত জ্ঞান। বিজ্ঞান জানলে প্রকৃতিকে জানা যায়। দেশের উন্নতিতে ভূমিকা রাখা যায়। আমি মনে করি, এ নিয়ে আরও অনেক কাজ করতে হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এখানে আসার আগে তো আপনি দুর্নীতি দমন কমিশনে ছিলেন। আগে কি ভেবেছিলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে আসবেন এবং এ জন্য কাজ করবেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: কখনো কল্পনা করিনি বিজ্ঞান জাদুঘরে আমার পদায়ন হবে। আমি কর্মজীবনে বিজ্ঞান জাদুঘরের একান্ত নিকটতম প্রতিবেশী প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তরে কাজ করেছি। পরিবেশ সুরক্ষায় দীর্ঘ দুই বছর সারা দেশে অভিযান চালিয়েছি। তখনো জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর আমার কাছে পরিচিত ছিল না। বিজ্ঞান জাদুঘর শুধু আমার কাছে নয়, অনেকের কাছেই অপরিচিত ও অজানা ছিল। যাই হোক, এখানে পদায়নকে তুচ্ছ মনে না করে আমি কাজের সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। এ সুযোগে দেশে বিজ্ঞান প্রসারে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার আত্মার বন্ধন তৈরি হয়েছে। যদি আরও কিছুটা সময় পেতাম, এ প্রতিষ্ঠানকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার পরে যিনি এই অবস্থানে দায়িত্বে আসবেন, তাঁর উদ্দেশে কি আপনার কিছু বলার আছে?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: তাঁর উদ্দেশে, অর্থাৎ আমার উত্তরসূরিকে বলব, তিনি যেন এই প্রতিষ্ঠানকে হৃদয়ে স্থান দেন। যেন সময়নিষ্ঠ, কর্তব্যনিষ্ঠ ও ত্যাগী হয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য সময় দেন। হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দেন এবং বর্তমান সুশৃঙ্খল কর্মপরিবেশ যেন অব্যাহত থাকে। কোনোভাবেই যেন এই প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিহীন না থাকে।

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে তিমির কংকাল
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার দায়িত্বকালে তো জাদুঘর আইএসও সনদ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এটি। অনেক বড় বিষয়, বলা যায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: হ্যাঁ, আইএসও সনদ প্রাপ্তি অবশ্যই বিজ্ঞান জাদুঘরের জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি বিষয়। আমি বলব, এটি রাতারাতি অর্জন করা যায়নি। দীর্ঘ দুই বছর ধরে আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পুরো জাদুঘরের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি আঙিনা, প্রতিটি স্থান, প্রতিটি ইঞ্চিকে আমরা সব ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা থেকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছি। সবাইকে কর্তব্যনিষ্ঠ করতে পেরেছি। প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও সরকারি স্থাপনাকে আমরা সুরক্ষিত রাখতে পেরেছি এবং যে যত্ন দিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠানকে আগলে রেখেছি, তার সুফল হিসেবে এটা পেয়েছি। তবে অর্জন করা যেমন কঠিন, ধরে রাখা আরও অনেক কঠিন। এ কারণে আমি বলি, আমরা প্রত্যেকেই সব কাজ করব। আমি মহাপরিচালক হয়েও আমার চোখের সামনে যদি কোনো পলিথিন বা ময়লা পড়ে থাকে, সেটা আমি নিজেই তুলে পরিষ্কার করি। সব যে আমার অধীনস্থরা করবে, তা নয়। আমরা অফিসারদের বলি, কেউ যেন আমলাতান্ত্রিক আচরণ না করি। সবাই আমরা এখানে জাদুঘরের কর্মী—আমি ডিজি, আরেকজন মালি বা সুইপার; তবে সবাই কর্মী। আমরা এখানে প্রতিটি অনুষ্ঠানে, প্রতিটি আয়োজনে সমতার অনুশাসন প্রতিপালন করি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

দেখে শেখার পাশাপাশি বই পড়ে শেখাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বই পড়াকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে একটি লাইব্রেরি আছে। আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিজ্ঞান বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। কিন্তু একটি বড় সংকটকাল অতিক্রম করছে পুরো জাতি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা। যেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। শিক্ষার্থীদের বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট ও মোবাইল আসক্তির কারণে। এতে তাদের মেধার চর্চা, সৃজনশীলতা বা সৃষ্টিশীলতা যেটা আছে, সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাতে-কলমে শেখা, বই পড়ে শেখা, সেগুলো সব কেন যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্ক সুপার কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিশালী। মস্তিষ্কের নিউরন অনেক শক্তিশালী। অথচ এই মস্তিষ্ককে প্রখর করার চেষ্টা বাদ দিয়ে, বই পড়া বাদ দিয়ে আমরা মস্তিষ্ককে অকার্যকর করে ফেলছি। এ থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই বই পড়তে হবে। যতই হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিখুক, পাশাপাশি বই পড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী? ভবিষ্যতে কী করার স্বপ্ন দেখেন?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: ভবিষ্যতে আমার একটাই স্বপ্ন। মানুষকে—দেশের তরুণ প্রজন্মকে—অনুপ্রাণিত করা। দেশ গঠনে, পরিবেশ সুরক্ষায়, দুর্নীতি দমনে এবং মানুষের সেবায় যেন তারা উদ্বুদ্ধ হয়। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে জনসাধারণ এবং শিক্ষার্থী, অর্থাৎ আমরা সবাই যেন জনকল্যাণে নিজের সময় ব্যয় করি। জাতিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাই। নিজেরা সচেতন থাকি, নিবেদিতপ্রাণ থাকি। সে লক্ষ্যে মানুষকে অনুপ্রাণিত করাই আমার জীবনের লক্ষ্য।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর-তরুণ। তাদের উদ্দেশে যদি কিছু বলেন।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: আমি বলব, শুধু বিজ্ঞানী নয়, সৎ মানুষ হতে হবে। বিজ্ঞান শিখে যেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করলেও সেখানে শিক্ষার সফলতা, পূর্ণতা ও লোভনীয় জীবনের ফাঁকে দেশকে ভুলে না যায়। যেন দেশে ফিরে আসে। তাদের মেধা যেন দেশের কাজে লাগে। দেশ ও দেশের মানুষের কাজে লাগলেই শিক্ষা পূর্ণতা পায়।

অনুলিখন: মুশফিকুর প্রিয়, শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়