যেকোনো দেশেই বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগৎ স্বাভাবিক সামাজিক মানুষের চিন্তার জগৎ থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের নেশা, নতুন জ্ঞানার্জনের প্রতি প্রবল আগ্রহ। অনেক সময় দেখা যায়, তাঁদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলাফল যেসব জার্নালে প্রকাশিত হয়, আর যে বৈজ্ঞানিক ভাষায় সেসব লেখা হয়, সেগুলো থাকে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে। ফলে এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব অনেক সময় অজ্ঞাত থেকে যায়।
বৈজ্ঞানিক ভাষাকে সাধারণ ভাষায় রূপান্তর করে বিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকের কাছে নিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে বিজ্ঞান পত্রিকা বা ম্যাগাজিনগুলো। যেসব দেশে বিজ্ঞান পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের চাহিদা বেশি, সেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত। সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্যে শৈশব-কৈশোর থেকে প্রস্তুত হতে থাকে। বলা যায়, কোনো দেশের বিজ্ঞানচর্চার ভিত তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে প্রধান ভূমিকা রাখে এই বিজ্ঞান পত্রিকা ও ম্যাগাজিনগুলো। আমাদের দেশে গত দশ বছর ধরে সেই ভূমিকা রেখে চলেছে বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞানচিন্তার নবম বর্ষপূর্তিতে ম্যাগাজিনটির প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আছেন, সেই সঙ্গে লেখক ও পাঠকসহ সবাইকে অভিনন্দন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পরীক্ষানির্ভর। সেখানে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জনের কৌশল শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা হয় বেশি। তাই দেখা যায়, আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যত সংখ্যক বিজ্ঞানশিক্ষার্থী আছে, তার সংখ্যা অনেক দেশের মোট শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানী তৈরি হয় খুব কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সত্যিকারের বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যবর্তী ফাঁক পূরণ করতে পারে বিজ্ঞান সাময়িকী ও ম্যাগাজিন—প্রদীপ দেব
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নামী দুটো বিজ্ঞান সাময়িকীর নাম উল্লেখ করতে হলে প্রায় সবাই একমত হয়ে বলবেন সায়েন্স এবং নেচার-এর কথা। ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার যাত্রা শুরু করেছিল ১৮৬৯ সালে। আর মার্কিন বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স শুরু হয়েছে ১৮৮০ সাল থেকে। সেই থেকে প্রতি সপ্তাহে এই সাময়িকী দুটো প্রকাশিত হয়ে আসছে, এবং প্রতিটি সংখ্যায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এই সাময়িকী দুটোর যেকোনো একটিতে কোনো প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারলে বিজ্ঞানীদের গৌরব বেড়ে যায় তরতর করে। এই জার্নাল দুটোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জটিল প্রক্রিয়া এবং ফলাফল যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি সাধারণ পাঠকদের বোঝার জন্য পপুলার সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। সে জন্যই বিজ্ঞানীসমাজে তো বটেই, সাধারণ পাঠক সমাজেও এই সাময়িকী দুটোর গুরুত্ব অপরিসীম।
জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ের ম্যাগাজিনের নাম বলতে গেলে প্রথমেই আসে সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এর নাম। ১৮৪৫ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ম্যাগাজিন। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ফলাফল বিজ্ঞানসাময়িকীতে প্রকাশিত হলে বা কোনো গবেষণাগারে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেলে তা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য আকারে প্রকাশিত হয় সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এ। একই আদলে যুক্তরাজ্যের নিউ সায়েন্টিস্ট প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৫৬ সাল থেকে। সে তুলনায় আমাদের বিজ্ঞানচিন্তার নয় বছর সবেমাত্র যাত্রা শুরু হওয়ার সমতুল্য।
জনসংখ্যার অনুপাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যত বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশিত হয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশে বিজ্ঞান সাময়িকী বা ম্যাগাজিন নেই বললেই চলে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজ খুবই বিজ্ঞানবিমুখ সমাজ। এর পেছনে আর্থসামাজিক কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি খুব প্রকটভাবে আছে রাজনৈতিক কারণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পরীক্ষানির্ভর। সেখানে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জনের কৌশল শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা হয় বেশি। তাই দেখা যায়, আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যত সংখ্যক বিজ্ঞানশিক্ষার্থী আছে, তার সংখ্যা অনেক দেশের মোট শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানী তৈরি হয় খুব কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সত্যিকারের বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যবর্তী ফাঁক পূরণ করতে পারে বিজ্ঞান সাময়িকী ও ম্যাগাজিন। বিজ্ঞানচিন্তা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে, চাইছে কীভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করা যায়।
আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা নিয়মিত বিজ্ঞান পড়ান এবং যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান লেখকের সংখ্যা খুব কম, সম্ভবত পাঠকের সংখ্যাও । যেটুকু পড়াতে হবে, তার বাইরে নিজেরাও নতুন কিছু জানার জন্য কতটুকু পড়াশোনা করেন, তা আমার জানা নেই। তবে খুব ভালো হতো, যদি তাঁরাও নিয়মিত বিজ্ঞানচর্চা করতেন, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করতেন।
বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত লেখা প্রকাশের পাশাপাশি সারাদেশে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যেও অনেক প্রকল্প চালু রেখেছে। নানা বিষয়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজনে সক্রিয় সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি নিজেও বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞান আয়োজন করছে নিয়মিত। এসবের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ যে তৈরি করতে পারছে, তাতে বোঝা যায়, বিজ্ঞানচিন্তা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
বিজ্ঞানচিন্তার হাত ধরে আমাদের সমাজ আরও অনেক বিজ্ঞানপ্রেমী ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠবে—এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা।
